মৃত্যুঞ্জয় রায়
কিছুদিন আগে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাউই কাউন্টিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দাবানলের স্মৃতি এখনো সেখানকার মানুষকে পোড়াচ্ছে। শহরটির প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা দাবানলে পুড়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে ঐতিহাসিক নগরী লাহাইনার অন্তত ১ হাজার ৭০০ ঘরবাড়ি, শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা। সেই দাবানলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর লাগবে। সেখানকার গভর্নর জোস গ্রিন বলেছেন, এটিই সম্ভবত হাওয়াই রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অন্যদিকে সম্প্রতি গ্রিসের রোডসে দাবানল থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়েছিল।
গ্রীষ্মকালীন দাবানল গ্রিসে যেন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবার সে দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবানলের মতো ঘটনা ঘটছে। দাহ্য বন, গরম আবহাওয়া ও গাছপালার অব্যবস্থাপনার জন্য এরূপ ঘটনা ঘটছে বলে সে দেশের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ফায়ার রিসার্চের পরিচালক স্তেফান ডোয়ের মনে করেন। তবে এর পেছনে মূলত দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন।
দাবানলে পুড়েছে কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার আয়তন গ্রিসের চেয়েও বড়। সেই দাবানলের প্রকোপে কানাডার উত্তরের শহর ইয়েলোনাইফ ছেড়েছে হাজার হাজার মানুষ, বাতিল হয়েছে অনেক ফ্লাইট। দাবানলে সে দেশের বায়ুদূষণও বেড়ে গেছে। শহরের বাসিন্দাদের ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে এন৯৫ মাস্ক পরার অনুরোধ করা হয়েছিল। ওই অঞ্চলে সে সময় ২৪০টির বেশি দাবানল সক্রিয় ছিল বলে বিবিসি এক সংবাদ প্রতিবেদনে জানিয়েছিল। কানাডার পরিবেশমন্ত্রী স্টিভেন গিলবল্ট একে কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল ও বড় ধরনের শহর ত্যাগের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
আজ কানাডা, গ্রিস ও হাওয়াই রাজ্যে যা ঘটেছে, তা যে কাল পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটবে না, তা নয়। সেখানকার বনে কেউ আগুন দেয়নি, প্রাকৃতিক কারণেই বনের শুকনো পাতায় আগুন ধরে দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে দাবানলের এ রকম ঝুঁকি না থাকলেও আমাদের অপকর্ম আমাদের দেশেও সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। গত ২০ বছরে সুন্দরবনে অন্তত ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সব দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হলেও দাবানল ও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
২. আজকের পত্রিকায় ৩০ জুলাই প্রকাশিত এক সংবাদে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছিলেন, বিশ্ব আর এখন উষ্ণায়নের যুগে নেই, বিশ্ব এখন ফুটন্ত যুগে প্রবেশ করেছে। উত্তর গোলার্ধজুড়ে বয়ে চলা তীব্র দাবদাহের কারণেই এরূপ দাবানলের সৃষ্টি হয়েছিল। এই দাবদাহের কারণে বিভিন্ন দেশে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়েছিল সব হিসাব-নিকাশের বাইরে। এত দিন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এবারের গ্রীষ্মকাল সেই সব পূর্বাভাসে দেওয়া তাপমাত্রার বাইরে চলে গেছে। কোনো কোনো দেশের কোনো স্থানে এ বছরের জুলাই মাসে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গ্রীষ্মকালে প্রায় প্রতিদিনই তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি বিগত কয়েক শ বছরের মধ্যে জুলাই মাসে এত বেশি তাপমাত্রা আর কখনো দেখা যায়নি। এই গ্রীষ্মকালকে এ জন্য ‘নিষ্ঠুর গ্রীষ্ম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। নাসার জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গেভিন শ্মিডট সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সে সময় বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন পরিবর্তন দেখছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনে আমরা যে তাপপ্রবাহ এবার দেখছি, তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।’ এর কারণ হিসেবে শুধু এল নিনো পরিস্থিতিকে দায়ী করা যায় না। কেননা, এল নিনো শুরু হয়েছে কয়েক দিন আগে। কিন্তু তাপপ্রবাহ ও তার প্রভাব চলছে তারও আগে থেকে। এর ফলে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে চরম গরম পড়া, দাবানল, প্রবল বৃষ্টিপাত ও বন্যা বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। তাপমাত্রা বাড়লে ভূপৃষ্ঠের পানি বেশি বাষ্পীভূত হয়ে বেশি মেঘের সৃষ্টি করে। এতে বৃষ্টিপাতও বেড়ে যায়। এ বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রভাব দেখা গেছে চীনের বেইজিং, জাপান, কোরিয়া, ভারতসহ বেশ কিছু দেশে। বেশি বৃষ্টিতে পাহাড়ধস ও বন্যা দেখা দিয়েছে সেই সব দেশে। এ দেশেরও নদ-নদীর পানি বেড়ে আমাদের জন্য বিপর্যয়ের সংকেত দিচ্ছে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার পৃথিবীজুড়ে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। ইউরোপীয় জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা কোপার্নিকাস বলছে, এর আগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছিল, ২০২৩ সালে এসে তা ২০.৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে, যা এই সময়ের স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনেক জীবের বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটাবে, বিরূপ প্রভাব ফেলবে খাদ্য ও কৃষি উৎপাদনের ওপর। কেননা, মহাসাগর ও সাগরগুলো পৃথিবীর জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক। এসব সাগর-মহাসাগর বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাপ শুষে নেয় এবং পৃথিবীর জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেক জোগান দেয়। মহাসাগর ও সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড কম শোষিত হওয়ার কারণে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া। আর এ কথা এখন আমরা সবাই জানি যে, সাগরের পানি ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়লে তা মেরু অঞ্চলের বিশাল হিমবাহ ও বরফকে গলিয়ে দেবে। যার অর্থ সাগরের পানি বেড়ে যাওয়া এবং উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া।
৪. বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা এখন ধারণার চেয়ে বেশি বাড়ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ বছর চীনের শিনজিংয়াংয়ের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বোচ্চ ৫২.২ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রিডিকশন (এনওএএ) ১৯৭৯ সাল থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করছে। সংস্থাটির মতে, জুলাইয়ের প্রথম দিকে গড় তাপমাত্রা (৩ জুলাই ২০২৩) ছিল ১৭.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গবেষকেরা ইতিমধ্যে আগামী ২০২৪ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম বছর হতে চলেছে বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাপমাত্রার এরূপ বৃদ্ধি বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। অধিক গরম সহ্য করতে না পেরে অনেক দেশে মানুষ ঘর ও গাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে বা আসছে। এতে ফলটা হচ্ছে উল্টো। এসব এসি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার জন্য সেই সব যন্ত্র প্রস্তুতকারী শিল্প কলকারখানা চালনা করা হচ্ছে, যন্ত্র চালানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করা হচ্ছে, তা থেকে ও যন্ত্র থেকে অধিক হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসারণ হচ্ছে। তাতে বাতাসের তাপমাত্রা আরও বাড়ছে। মানুষের ভোগবিলাসী জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার কলকারখানা নতুনভাবে স্থাপিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমাতে পারে গাছপালা। সেগুলো লাগানোর চেয়ে বরং উজাড় করায় আমরা বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। কাঠ ছাড়া যে আমাদের বিলাস হবে না!
৫. শেষে জাপানি লেখক ও দার্শনিক মাসানোবু ফুকুওকার ‘দ্য ওয়ান স্ট্র রেভল্যুশন’ বইয়ের একটি পঙ্ক্তি মনে পড়ল, ‘পৃথিবীর বর্তমান সংকটাবস্থার মূল কারণ হলো মানুষের মাত্রাতিরিক্ত ভোগস্পৃহা।’ আমরা যেদিন থেকে প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে নিজেদের বাহাদুরি জাহির করা শুরু করেছি, প্রকৃতিকে মান্য করা ছেড়ে দিয়েছি, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে মানুষের প্রতি প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার পালা, আমাদের বিপর্যয়। ধ্বংসের রাস্তা আমরাই তৈরি করেছি, তারই প্রত্যক্ষ ফল আমরা অতি দ্রুত দেখতে পাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে তা অবধারিত, কিন্তু এত দ্রুত যে সবকিছু ঘটবে, তা বিজ্ঞানীরাও ভাবেননি! তাই প্রকৃতিকে সম্মান করে, প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে এখন সব ধরনের উন্নয়নকর্মে আমাদের সবুজ পথে হাঁটতে হবে। যত দ্রুত সেই পথে আমরা হাঁটতে পারব, ততই তা পৃথিবীর জন্য মঙ্গলজনক হবে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
কিছুদিন আগে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাউই কাউন্টিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দাবানলের স্মৃতি এখনো সেখানকার মানুষকে পোড়াচ্ছে। শহরটির প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা দাবানলে পুড়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে ঐতিহাসিক নগরী লাহাইনার অন্তত ১ হাজার ৭০০ ঘরবাড়ি, শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা। সেই দাবানলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর লাগবে। সেখানকার গভর্নর জোস গ্রিন বলেছেন, এটিই সম্ভবত হাওয়াই রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অন্যদিকে সম্প্রতি গ্রিসের রোডসে দাবানল থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়েছিল।
গ্রীষ্মকালীন দাবানল গ্রিসে যেন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবার সে দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবানলের মতো ঘটনা ঘটছে। দাহ্য বন, গরম আবহাওয়া ও গাছপালার অব্যবস্থাপনার জন্য এরূপ ঘটনা ঘটছে বলে সে দেশের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ফায়ার রিসার্চের পরিচালক স্তেফান ডোয়ের মনে করেন। তবে এর পেছনে মূলত দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন।
দাবানলে পুড়েছে কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার আয়তন গ্রিসের চেয়েও বড়। সেই দাবানলের প্রকোপে কানাডার উত্তরের শহর ইয়েলোনাইফ ছেড়েছে হাজার হাজার মানুষ, বাতিল হয়েছে অনেক ফ্লাইট। দাবানলে সে দেশের বায়ুদূষণও বেড়ে গেছে। শহরের বাসিন্দাদের ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে এন৯৫ মাস্ক পরার অনুরোধ করা হয়েছিল। ওই অঞ্চলে সে সময় ২৪০টির বেশি দাবানল সক্রিয় ছিল বলে বিবিসি এক সংবাদ প্রতিবেদনে জানিয়েছিল। কানাডার পরিবেশমন্ত্রী স্টিভেন গিলবল্ট একে কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল ও বড় ধরনের শহর ত্যাগের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
আজ কানাডা, গ্রিস ও হাওয়াই রাজ্যে যা ঘটেছে, তা যে কাল পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটবে না, তা নয়। সেখানকার বনে কেউ আগুন দেয়নি, প্রাকৃতিক কারণেই বনের শুকনো পাতায় আগুন ধরে দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে দাবানলের এ রকম ঝুঁকি না থাকলেও আমাদের অপকর্ম আমাদের দেশেও সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। গত ২০ বছরে সুন্দরবনে অন্তত ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সব দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হলেও দাবানল ও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
২. আজকের পত্রিকায় ৩০ জুলাই প্রকাশিত এক সংবাদে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছিলেন, বিশ্ব আর এখন উষ্ণায়নের যুগে নেই, বিশ্ব এখন ফুটন্ত যুগে প্রবেশ করেছে। উত্তর গোলার্ধজুড়ে বয়ে চলা তীব্র দাবদাহের কারণেই এরূপ দাবানলের সৃষ্টি হয়েছিল। এই দাবদাহের কারণে বিভিন্ন দেশে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়েছিল সব হিসাব-নিকাশের বাইরে। এত দিন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এবারের গ্রীষ্মকাল সেই সব পূর্বাভাসে দেওয়া তাপমাত্রার বাইরে চলে গেছে। কোনো কোনো দেশের কোনো স্থানে এ বছরের জুলাই মাসে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গ্রীষ্মকালে প্রায় প্রতিদিনই তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি বিগত কয়েক শ বছরের মধ্যে জুলাই মাসে এত বেশি তাপমাত্রা আর কখনো দেখা যায়নি। এই গ্রীষ্মকালকে এ জন্য ‘নিষ্ঠুর গ্রীষ্ম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। নাসার জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গেভিন শ্মিডট সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সে সময় বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন পরিবর্তন দেখছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনে আমরা যে তাপপ্রবাহ এবার দেখছি, তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।’ এর কারণ হিসেবে শুধু এল নিনো পরিস্থিতিকে দায়ী করা যায় না। কেননা, এল নিনো শুরু হয়েছে কয়েক দিন আগে। কিন্তু তাপপ্রবাহ ও তার প্রভাব চলছে তারও আগে থেকে। এর ফলে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে চরম গরম পড়া, দাবানল, প্রবল বৃষ্টিপাত ও বন্যা বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। তাপমাত্রা বাড়লে ভূপৃষ্ঠের পানি বেশি বাষ্পীভূত হয়ে বেশি মেঘের সৃষ্টি করে। এতে বৃষ্টিপাতও বেড়ে যায়। এ বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রভাব দেখা গেছে চীনের বেইজিং, জাপান, কোরিয়া, ভারতসহ বেশ কিছু দেশে। বেশি বৃষ্টিতে পাহাড়ধস ও বন্যা দেখা দিয়েছে সেই সব দেশে। এ দেশেরও নদ-নদীর পানি বেড়ে আমাদের জন্য বিপর্যয়ের সংকেত দিচ্ছে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার পৃথিবীজুড়ে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। ইউরোপীয় জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা কোপার্নিকাস বলছে, এর আগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছিল, ২০২৩ সালে এসে তা ২০.৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে, যা এই সময়ের স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনেক জীবের বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটাবে, বিরূপ প্রভাব ফেলবে খাদ্য ও কৃষি উৎপাদনের ওপর। কেননা, মহাসাগর ও সাগরগুলো পৃথিবীর জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক। এসব সাগর-মহাসাগর বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাপ শুষে নেয় এবং পৃথিবীর জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেক জোগান দেয়। মহাসাগর ও সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড কম শোষিত হওয়ার কারণে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া। আর এ কথা এখন আমরা সবাই জানি যে, সাগরের পানি ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়লে তা মেরু অঞ্চলের বিশাল হিমবাহ ও বরফকে গলিয়ে দেবে। যার অর্থ সাগরের পানি বেড়ে যাওয়া এবং উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া।
৪. বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা এখন ধারণার চেয়ে বেশি বাড়ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ বছর চীনের শিনজিংয়াংয়ের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বোচ্চ ৫২.২ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রিডিকশন (এনওএএ) ১৯৭৯ সাল থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করছে। সংস্থাটির মতে, জুলাইয়ের প্রথম দিকে গড় তাপমাত্রা (৩ জুলাই ২০২৩) ছিল ১৭.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গবেষকেরা ইতিমধ্যে আগামী ২০২৪ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম বছর হতে চলেছে বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাপমাত্রার এরূপ বৃদ্ধি বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। অধিক গরম সহ্য করতে না পেরে অনেক দেশে মানুষ ঘর ও গাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে বা আসছে। এতে ফলটা হচ্ছে উল্টো। এসব এসি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার জন্য সেই সব যন্ত্র প্রস্তুতকারী শিল্প কলকারখানা চালনা করা হচ্ছে, যন্ত্র চালানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করা হচ্ছে, তা থেকে ও যন্ত্র থেকে অধিক হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসারণ হচ্ছে। তাতে বাতাসের তাপমাত্রা আরও বাড়ছে। মানুষের ভোগবিলাসী জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার কলকারখানা নতুনভাবে স্থাপিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমাতে পারে গাছপালা। সেগুলো লাগানোর চেয়ে বরং উজাড় করায় আমরা বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। কাঠ ছাড়া যে আমাদের বিলাস হবে না!
৫. শেষে জাপানি লেখক ও দার্শনিক মাসানোবু ফুকুওকার ‘দ্য ওয়ান স্ট্র রেভল্যুশন’ বইয়ের একটি পঙ্ক্তি মনে পড়ল, ‘পৃথিবীর বর্তমান সংকটাবস্থার মূল কারণ হলো মানুষের মাত্রাতিরিক্ত ভোগস্পৃহা।’ আমরা যেদিন থেকে প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে নিজেদের বাহাদুরি জাহির করা শুরু করেছি, প্রকৃতিকে মান্য করা ছেড়ে দিয়েছি, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে মানুষের প্রতি প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার পালা, আমাদের বিপর্যয়। ধ্বংসের রাস্তা আমরাই তৈরি করেছি, তারই প্রত্যক্ষ ফল আমরা অতি দ্রুত দেখতে পাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে তা অবধারিত, কিন্তু এত দ্রুত যে সবকিছু ঘটবে, তা বিজ্ঞানীরাও ভাবেননি! তাই প্রকৃতিকে সম্মান করে, প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে এখন সব ধরনের উন্নয়নকর্মে আমাদের সবুজ পথে হাঁটতে হবে। যত দ্রুত সেই পথে আমরা হাঁটতে পারব, ততই তা পৃথিবীর জন্য মঙ্গলজনক হবে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৮ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে