শাইখ সিরাজ
প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। ষড়্ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্য ঠিক আগের মতো নেই। ঘোর বর্ষা থাকার সময়ে থাকছে বৃষ্টিহীন। শীতও ঠিক নেই আগের মতো। গ্রীষ্মেও দেখা মেলে কুয়াশার। কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। আগে থেকে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
এটিই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের বারতা। যার প্রকট প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষিতে। এই সময়টা আমাদের কৃষির পটপরিবর্তনের একটা সময়। শিল্পোদ্যোক্তারা আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষিতে বিনিয়োগে। ফলে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে প্রযুক্তিবহুল বাণিজ্যিক কৃষি। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব অনিশ্চিত করে দিতে পারে অনেক কিছু। তাই এই সময়ে কৃষিবিমার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরেশোরে অনুভূত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে আমি কৃষকদের শস্যবিমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলে এসেছি। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। বন্যা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি হয়। ফলে কৃষক ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হন। এ ধরনের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য যে বিমাপত্র গ্রহণ করা হয় তা-ই হচ্ছে শস্যবিমা। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে বিমার জন্য প্রিমিয়াম দিতে হয়। শস্যবিমার প্রচলন প্রথম জার্মানিতে শুরু হলেও পরে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই শস্যবিমার প্রচলন আছে।
হৃদয়ে মাটি ও মানুষের বিশেষ আয়োজন ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের শুরু থেকে কৃষকেরা কৃষিবিমার দাবি জানিয়ে আসছেন; বিশেষ করে যাঁরা উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের আবাদ করেন তাঁরা খুব দৃঢ়ভাবেই কৃষিবিমার প্রত্যাশী ছিলেন। আমি বরাবরই জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর সুপারিশমালা অর্থমন্ত্রীর হাতে তুলে দিই। সেখানে প্রতিবারই কৃষকের পক্ষ থেকে কৃষিবিমার দাবির উল্লেখ থাকে। মনে আছে, টাঙ্গাইলে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে কিষাণি মমতাজ বেগম প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার গাড়িটার যদি বিমা হতে পারে, তবে আমার গরুটার কেন বিমা হবে না?’
আমি যত দূর জানি, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রচলিত শস্যবিমা চালু করে সাধারণ বীমা করপোরেশন। তবে খরচ বেশি হওয়ায় ১৯৯৬ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালে পাইলট প্রকল্প আকারে আবারও শস্যবিমা চালু করে সাধারণ বীমা করপোরেশন। আবহাওয়া সূচকভিত্তিক এই শস্যবিমা ছিল একটি নতুন সংযোজন। কিন্তু এই প্রকল্পের পাইলটিং পর্যায়টা ছিল দীর্ঘ। শস্য কৃষির বাইরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বিমার জোরালো দাবি আছে খামারিদের। খুব স্বল্প পরিসরে কয়েকটি বিমা প্রতিষ্ঠান অবশ্য শস্যবিমা নিয়ে কাজ করছে।
মনে পড়ছে, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য কৃষিবিমা চালু করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রবিমা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক একটি সমীকরণ অনুযায়ী, প্রাকৃতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করে, তাদের ক্ষতি কীভাবে মেটানো যায় এবং তাদের জীবন কীভাবে নিরাপদ করা যায়, সে জন্য তাদের বিশেষ বিমার ব্যবস্থা করে দিলে তারা নিরাপদ থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কৃষিবিমা চালু করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
এশিয়ার অনেক দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড সরকার কৃষিবিমার ওপর বিশেষ গুরুত্ব এবং প্রাধান্য আরোপ করেছে। পাশের দেশ ভারতের সরকার কৃষিবিমার ওপর জোর দিয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। ফসলের চাষকে বিমার আওতায় আনতে চালু করা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’। খবরে জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার অধীনে ৩ দশমিক ৫ কোটি কৃষকের বিমা করা হয়েছে এবং বিমার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উর্বরতা রক্ষা করে একই জমিতে অধিক ফসল তোলার জন্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি সয়েল হেলথ কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।
বছর দুয়েক আগে আমার ফিলিপাইনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কাজের প্রয়োজনে সেখানকার প্রত্যন্ত গ্রামেও গিয়েছি। ফিলিপাইনের ইলিকস নর্থ প্রদেশের পিদিমের আবুকাই গ্রামের লইতা, আরথুর, সান্তোসসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, ফিলিপাইনের নিবন্ধিত কৃষকের শতভাগ রয়েছেন কৃষিবিমার আওতায়। বীজ, সার থেকে শুরু করে সব কৃষি সহযোগিতা তাঁরা সরকারের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন, বিনিময়ে তাঁরা নিয়মিত তাঁদের প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন।
আমাদেরও উচিত হবে কৃষকদের দ্রুত শস্যবিমাসহ কৃষিবিমার আওতায় নিয়ে আসা। প্রথমে হয়তো কৃষকদের প্রিমিয়াম দেওয়ায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হতে পারে। তবে এর ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ হবে। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপ খাত—গবাদি পশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদের বিমার কথা বললে আগে বলা হতো, গরু-ছাগলের স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি কী? বিমাকৃত প্রাণীটি আদৌ সুস্থ কি না, জানা যেত না। কিংবা পুকুরে পানির নিচে কী পরিমাণ মাছ আছে, সেটাও জানা যেত না।
কিন্তু এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে যন্ত্রই সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। গরুর পেটে থাকা বোলাস সার্বক্ষণিক তথ্য পাঠাচ্ছে গরুর রোগবালাই থেকে শুরু করে কতটুকু খাবার খাচ্ছে, কী পরিমাণ বিশ্রাম নিচ্ছে সব তথ্য। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকা হোক না কেন মোবাইল ফোনে মুহূর্তেই সব তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। এত দিন আমাদের কাছে সব গরুই এক রকম দেখতে মনে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ফেলে আলাদা আলাদাভাবে চিনে নিতে পারছে প্রতিটি গরু। যন্ত্রই বলে দিতে পারছে পুকুরের নিচে কী পরিমাণ মাছ আছে, তাদের আকার-আকৃতিই-বা কী। ফলে তাদের কৃষিবিমার আওতায় নিয়ে আসা খুব কঠিন বিষয় নয়।
নেদারল্যান্ডসে দেখেছি প্রযুক্তির কৃষির নান্দনিক বিকাশ। বিশাল একেকটা গ্রিনহাউস যেন একেকটা কৃষিপণ্যের কারখানা। মানুষের পাশাপাশি কাজ করছে রোবটও। সংখ্যার হিসাবে মানুষের চেয়ে রোবটের সংখ্যাই বেশি। একেকটা গ্রিনহাউসে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ। যেখানে বিমার সুবিধা না থাকলে কেউই হয়তো এত বেশি ঝুঁকি নিতেন না।
উন্নত দেশগুলোর আদলে আমাদের দেশেও প্রযুক্তির কৃষিতে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। একে বিকশিত করতে কয়েকটি বিমা কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এতে কৃষক বা উদ্যোক্তা এবং বিমা কোম্পানি উভয়ই যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে অবস্থান করতে পারে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সরকারের বিমা প্রকল্প দ্রুত সম্প্রসারণ করা জরুরি।
আমার সৌভাগ্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিনির্ভর আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি দেখেছি, এ দেশের কৃষক কতটা ঘাতসহ, কতটা বৈরী অবস্থানে থেকেও খাদ্য উৎপাদনের নেশায় চাষে মগ্ন থেকেছেন।
পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠেনি। কৃষক এগিয়েছেন তাঁর নিজস্ব গতিতে। সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা ছিল বটে, তবে কৃষকের অবদান এককভাবে সেখানে আরও অনেক বেশি জায়গাজুড়ে। সেই অন্তর্মুখী কৃষককে এখন দাঁড় করাতে হবে বিশ্ব কৃষকের পাশে।
সময় এখন বিশ্বায়নের। কৃষকের বাজার এখন পৃথিবীব্যাপী। এই সময়ে আমাদের কৃষককে সামনে এগিয়ে নিতে না পারলে পিছিয়ে যাবে আমাদের কৃষি। পিছিয়ে যাব আমরা। আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষির সঙ্গে তাঁদের যেমন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে, আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত কৃষিবিমা নীতিমালা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। ষড়্ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্য ঠিক আগের মতো নেই। ঘোর বর্ষা থাকার সময়ে থাকছে বৃষ্টিহীন। শীতও ঠিক নেই আগের মতো। গ্রীষ্মেও দেখা মেলে কুয়াশার। কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। আগে থেকে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
এটিই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের বারতা। যার প্রকট প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষিতে। এই সময়টা আমাদের কৃষির পটপরিবর্তনের একটা সময়। শিল্পোদ্যোক্তারা আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষিতে বিনিয়োগে। ফলে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে প্রযুক্তিবহুল বাণিজ্যিক কৃষি। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব অনিশ্চিত করে দিতে পারে অনেক কিছু। তাই এই সময়ে কৃষিবিমার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরেশোরে অনুভূত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে আমি কৃষকদের শস্যবিমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলে এসেছি। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। বন্যা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি হয়। ফলে কৃষক ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হন। এ ধরনের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য যে বিমাপত্র গ্রহণ করা হয় তা-ই হচ্ছে শস্যবিমা। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে বিমার জন্য প্রিমিয়াম দিতে হয়। শস্যবিমার প্রচলন প্রথম জার্মানিতে শুরু হলেও পরে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই শস্যবিমার প্রচলন আছে।
হৃদয়ে মাটি ও মানুষের বিশেষ আয়োজন ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের শুরু থেকে কৃষকেরা কৃষিবিমার দাবি জানিয়ে আসছেন; বিশেষ করে যাঁরা উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের আবাদ করেন তাঁরা খুব দৃঢ়ভাবেই কৃষিবিমার প্রত্যাশী ছিলেন। আমি বরাবরই জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর সুপারিশমালা অর্থমন্ত্রীর হাতে তুলে দিই। সেখানে প্রতিবারই কৃষকের পক্ষ থেকে কৃষিবিমার দাবির উল্লেখ থাকে। মনে আছে, টাঙ্গাইলে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে কিষাণি মমতাজ বেগম প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার গাড়িটার যদি বিমা হতে পারে, তবে আমার গরুটার কেন বিমা হবে না?’
আমি যত দূর জানি, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রচলিত শস্যবিমা চালু করে সাধারণ বীমা করপোরেশন। তবে খরচ বেশি হওয়ায় ১৯৯৬ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালে পাইলট প্রকল্প আকারে আবারও শস্যবিমা চালু করে সাধারণ বীমা করপোরেশন। আবহাওয়া সূচকভিত্তিক এই শস্যবিমা ছিল একটি নতুন সংযোজন। কিন্তু এই প্রকল্পের পাইলটিং পর্যায়টা ছিল দীর্ঘ। শস্য কৃষির বাইরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বিমার জোরালো দাবি আছে খামারিদের। খুব স্বল্প পরিসরে কয়েকটি বিমা প্রতিষ্ঠান অবশ্য শস্যবিমা নিয়ে কাজ করছে।
মনে পড়ছে, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য কৃষিবিমা চালু করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রবিমা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক একটি সমীকরণ অনুযায়ী, প্রাকৃতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করে, তাদের ক্ষতি কীভাবে মেটানো যায় এবং তাদের জীবন কীভাবে নিরাপদ করা যায়, সে জন্য তাদের বিশেষ বিমার ব্যবস্থা করে দিলে তারা নিরাপদ থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কৃষিবিমা চালু করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
এশিয়ার অনেক দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড সরকার কৃষিবিমার ওপর বিশেষ গুরুত্ব এবং প্রাধান্য আরোপ করেছে। পাশের দেশ ভারতের সরকার কৃষিবিমার ওপর জোর দিয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। ফসলের চাষকে বিমার আওতায় আনতে চালু করা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’। খবরে জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার অধীনে ৩ দশমিক ৫ কোটি কৃষকের বিমা করা হয়েছে এবং বিমার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উর্বরতা রক্ষা করে একই জমিতে অধিক ফসল তোলার জন্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি সয়েল হেলথ কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।
বছর দুয়েক আগে আমার ফিলিপাইনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কাজের প্রয়োজনে সেখানকার প্রত্যন্ত গ্রামেও গিয়েছি। ফিলিপাইনের ইলিকস নর্থ প্রদেশের পিদিমের আবুকাই গ্রামের লইতা, আরথুর, সান্তোসসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, ফিলিপাইনের নিবন্ধিত কৃষকের শতভাগ রয়েছেন কৃষিবিমার আওতায়। বীজ, সার থেকে শুরু করে সব কৃষি সহযোগিতা তাঁরা সরকারের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন, বিনিময়ে তাঁরা নিয়মিত তাঁদের প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন।
আমাদেরও উচিত হবে কৃষকদের দ্রুত শস্যবিমাসহ কৃষিবিমার আওতায় নিয়ে আসা। প্রথমে হয়তো কৃষকদের প্রিমিয়াম দেওয়ায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হতে পারে। তবে এর ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ হবে। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপ খাত—গবাদি পশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদের বিমার কথা বললে আগে বলা হতো, গরু-ছাগলের স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি কী? বিমাকৃত প্রাণীটি আদৌ সুস্থ কি না, জানা যেত না। কিংবা পুকুরে পানির নিচে কী পরিমাণ মাছ আছে, সেটাও জানা যেত না।
কিন্তু এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে যন্ত্রই সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। গরুর পেটে থাকা বোলাস সার্বক্ষণিক তথ্য পাঠাচ্ছে গরুর রোগবালাই থেকে শুরু করে কতটুকু খাবার খাচ্ছে, কী পরিমাণ বিশ্রাম নিচ্ছে সব তথ্য। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকা হোক না কেন মোবাইল ফোনে মুহূর্তেই সব তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। এত দিন আমাদের কাছে সব গরুই এক রকম দেখতে মনে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ফেলে আলাদা আলাদাভাবে চিনে নিতে পারছে প্রতিটি গরু। যন্ত্রই বলে দিতে পারছে পুকুরের নিচে কী পরিমাণ মাছ আছে, তাদের আকার-আকৃতিই-বা কী। ফলে তাদের কৃষিবিমার আওতায় নিয়ে আসা খুব কঠিন বিষয় নয়।
নেদারল্যান্ডসে দেখেছি প্রযুক্তির কৃষির নান্দনিক বিকাশ। বিশাল একেকটা গ্রিনহাউস যেন একেকটা কৃষিপণ্যের কারখানা। মানুষের পাশাপাশি কাজ করছে রোবটও। সংখ্যার হিসাবে মানুষের চেয়ে রোবটের সংখ্যাই বেশি। একেকটা গ্রিনহাউসে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ। যেখানে বিমার সুবিধা না থাকলে কেউই হয়তো এত বেশি ঝুঁকি নিতেন না।
উন্নত দেশগুলোর আদলে আমাদের দেশেও প্রযুক্তির কৃষিতে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। একে বিকশিত করতে কয়েকটি বিমা কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এতে কৃষক বা উদ্যোক্তা এবং বিমা কোম্পানি উভয়ই যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে অবস্থান করতে পারে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সরকারের বিমা প্রকল্প দ্রুত সম্প্রসারণ করা জরুরি।
আমার সৌভাগ্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিনির্ভর আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি দেখেছি, এ দেশের কৃষক কতটা ঘাতসহ, কতটা বৈরী অবস্থানে থেকেও খাদ্য উৎপাদনের নেশায় চাষে মগ্ন থেকেছেন।
পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠেনি। কৃষক এগিয়েছেন তাঁর নিজস্ব গতিতে। সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা ছিল বটে, তবে কৃষকের অবদান এককভাবে সেখানে আরও অনেক বেশি জায়গাজুড়ে। সেই অন্তর্মুখী কৃষককে এখন দাঁড় করাতে হবে বিশ্ব কৃষকের পাশে।
সময় এখন বিশ্বায়নের। কৃষকের বাজার এখন পৃথিবীব্যাপী। এই সময়ে আমাদের কৃষককে সামনে এগিয়ে নিতে না পারলে পিছিয়ে যাবে আমাদের কৃষি। পিছিয়ে যাব আমরা। আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষির সঙ্গে তাঁদের যেমন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে, আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত কৃষিবিমা নীতিমালা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে