শব্দের আড়ালে গল্প: জগদ্দল পাথর

রাজীব কুমার সাহা
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০: ৩৯
আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১১: ১৩

আমাদের দৈনন্দিন ভাষা ব্যবহারে একটি অতিপরিচিত শব্দবন্ধ হলো ‘জগদ্দল পাথর’। যাপিত জীবনের দুঃসহ কোনো পরিস্থিতিতে আমরা সচরাচর এ শব্দবন্ধটির ব্যবহার লক্ষ করি। কিন্তু এই জগদ্দল পাথর আসলে কী? এটা কি বিশেষ কোনো পাথর? এর কি আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে? আর এটি কেনই-বা এত যন্ত্রণাদায়ক পাথর? তবে চলুন আজ জানব, জগদ্দল পাথরের আদ্যোপান্ত।

জগদ্দল ও পাথর শব্দ দুটো মিলে তৈরি হয়েছে জগদ্দল পাথর শব্দবন্ধটি। এটি বিশেষ্য পদ। আমরা যদি জগদ্দল শব্দটি খেয়াল করি তাহলে দেখব, ‘জগৎ’ এবং ‘দল’ শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে ‘জগদ্দল’ শব্দটি। জগদ্দল বিশেষণ পদ। ‘দল’ শব্দটির ব্যুৎপত্তির দিকে তাকালে আমরা দেখব, শব্দটি এসেছে দলন (√দল্+অন) থেকে। যার অর্থ মর্দন, চূর্ণীকরণ বা নিপীড়ন। জগদ্দল শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো জগৎকে দলনে সক্ষম এমন ক্ষমতাধর, জগতের দলনকর্তা প্রভৃতি।

সুতরাং জগদ্দল পাথরের অর্থ হলো জগৎকে দলনে সক্ষম এমন গুরুভার পাষাণ বা সরানো বা নড়ানো যায় না এমন অতিশয় ভারী পাথর। সুতরাং এখান থেকে সহজেই অনুমেয় যে এ পাথর কতটা ওজনদার, যা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও দলিত করতে পারে। এ তো গেল এই শব্দবন্ধের আক্ষরিক অর্থের কথা। এবার আসি এর আলংকারিক অর্থে।

আলংকারিক অর্থে জগদ্দল পাথরের অর্থ হলো যে পাথর দলিত করে বা পীড়া দেয় এবং যে পাথরের ভার বহন করা অতি কষ্টকর। আবার অন্যভাবে বলা যায়, এই শব্দবন্ধ বিশাল গুরুভার তথা অত্যন্ত ভারী অর্থেও প্রযুক্ত। সাধারণত যখন কোনো দুঃসহ বেদনা বা অসীম কষ্ট জগদ্দলের মতো পাথরস্বরূপ বুকের ভেতর চেপে বসে, তখন সচরাচর এ শব্দবন্ধটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন ‘অকালপ্রয়াত সন্তানের শোক বাবার বুকে জগদ্দল পাথর হয়ে আছে।’ অর্থাৎ এ শোক বা অকালপ্রয়াত সন্তানের স্মৃতিরাশি বাবার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো আটকে আছে, যা থেকে কোনোভাবেই মুক্তি মেলা সম্ভব নয়।

পরিস্থিতির প্রসঙ্গভেদে আলংকারিক প্রয়োগে কখনো কখনো জগদ্দল পাথরকে ব্যক্তির সঙ্গেও প্রতিতুলনা করা হয়; অর্থাৎ তিনিই জগদ্দল পাথর যিনি কাউকে কষ্ট দেন বা নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায়ও আমরা এ শব্দবন্ধের উল্লেখ পাই। তিনি তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ভারতবর্ষ ইংরেজের সভ্যশাসনের জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে তলিয়ে পড়ে রইল নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে।’

আবার তাঁর যোগাযোগ উপন্যাসের এক স্থানে বলেছেন, ‘আর সংসারের উপর চেপে আছে ওর নিজের আইবুড়ো-দশা, জগদ্দল পাথর, তার যত বড় দুঃখ, তত বড় অপমান। কিছু করবার নেই, কপালে করাঘাত ছাড়া।’ পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা অনুসারে কবিগুরুর উপরিউক্ত বাক্যদ্বয়ে ‘জগদ্দল পাথর’-এর অর্থ পাঠকের কাছে অবশ্যই সুস্পষ্ট।

প্রাসঙ্গিকভাবে পাঠকদের আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো তা হলো, নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে ধামইরহাট উপজেলার জগদ্দল গ্রামে জগদ্দল বিহার নামে একটি বৌদ্ধবিহার রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ৯১৭ বছরের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের ব্যতিক্রমধর্মী কিছু সংযোজন রয়েছে এই জগদ্দল বৌদ্ধবিহারে। এই বিহারের চারপাশেও অনেক ভারী ভারী পাথর রয়েছে।

এই পাথরগুলোর দৈর্ঘ্য এবং অবস্থানগত দিক থেকে এটিও সহজেই অনুমেয় যে এগুলো কারও পক্ষে উত্তোলন করা সম্ভব নয়। এই পাথরগুলো যেন এ ধরার বুকে ভূমিকম্প বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলস্বরূপ চেপে বসেছে। এই অবস্থাদৃষ্টেই এর নামকরণ হয়েছে জগদ্দল বৌদ্ধবিহার। ইউনেসকো ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সম্ভাব্য তালিকায় জগদ্দল বৌদ্ধবিহারের নাম রয়েছে।

রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত