রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন আসলেই বাঁশি বাজাচ্ছিলেন?

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১: ১০
Thumbnail image

বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত প্রবাদ—‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ সাধারণত জরুরি পরিস্থিতে সাড়া না দেওয়া শাসকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বোঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহার হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় প্রবাদটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিরে আসে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নারী চিকিৎসক মৌমিতা দেবনাথকে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে দ্রোহের কার্নিভ্যাল পালন করে চিকিৎসকসহ ছাত্র-জনতা। ঠিক পাশেই আরেকটি মঞ্চে উৎসবে যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপরীতমুখী দুই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে কলকাতার একটি পেজ লিখেছে, ‘রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ 

সত্যিই রোম যখন পুড়ছিল, নিরো কি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন? 
রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জুলিও-ক্লদিয়ান বংশের শেষ শাসক ছিলেন নিরো। ৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পঞ্চম সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন নিরো। ১০ বছর পর জুলাই মাসে অ্যান্টিমে (ইতালির সমুদ্রতীরবর্তী শহর আনজিও) ছুটি কাটাতে যান। ঠিক তখনই ভয়াবহ আগুন রোমে, টানা ছয় দিন জ্বলে–পুড়ে রোমের ৭০ শতাংশ ধ্বংস হয়। গৃহহারা হয় অর্ধেক মানুষ। 

দাবি করা হয়, রোমান সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে ‘নিষ্ঠুর’ ও ‘পাগলাটে’ শাসক নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সেই দাবি থেকে বাংলায় বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’ কার্যক্ষেত্রে বারবারই উচ্চারিত হয়। বিশ্বজুড়েই মানুষ এটা বিশ্বাস করে। 

বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত প্রবাদ—‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ ছবি: ফেসবুক তবে প্রবাদের সত্যতা সর্বজনীন নয়। প্রবাদটির ইংরেজি শব্দগুচ্ছ থেকে সন্দেহের সূত্রপাত হয়েছে। ইতিহাসভিত্তিক টিভি চ্যানেল হিস্ট্রি ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘Nero fiddles while Rome burns’— এই প্রবাদে ‘Fiddle’ (ফিডল) বা বেহালার মতো যে বাদ্যযন্ত্রের কথা বলা হয়, প্রাচীন রোমে সেটির অস্তিত্বই ছিল না। 

সংগীতবিষয়ক ইতিহাসবেত্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, ফিডল নামে  বাদ্যযন্ত্রটির অস্তিত্ব ১১ শতকের আগ পর্যন্ত ছিলই না। তখন নিরো যদি কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েই থাকে, তাহলে সেটা হতে পারে ‘কিতারা’ নামের বাদ্যযন্ত্র, যেটাকে আধুনিক কালের গিটার বলা যায়। এটি ছিল চার থেকে সাত তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র। তবে রোমের অগ্নিকাণ্ডের সময় নিরো বাজিয়েছিলেন তেমন অকাট্য প্রমাণ নেই। 

হিস্ট্রি চ্যানেলের এই বর্ণনার কাছাকাছি ভাষ্য পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিরো–বিষয়ক এক প্রতিবেদনে। 

তাহলে দাবিটির সূত্রপাত কীভাবে? 
নিরোর সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাকিটাস দাবিটির সূত্রপাত সম্পর্কে লিখেন, রোম আগুনে পোড়ার সময় নিরো ধ্বংসযজ্ঞ দেখছিলেন এবং উপভোগ করছিলেন—এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এই দাবির কোনো সত্যতা নেই। 

অগ্নিকাণ্ডের খবর জেনে নিরো অ্যান্টিম থেকে তাৎক্ষণিক রোমে ফিরে আসেন এবং ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর প্রতি আস্থাহীনতার কারণে অনেকেই বিশ্বাস করত, রোমের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরোর নির্দেশেই হয়েছে। তবে এর কিছু কারণও আছে—আগুনে পুড়ে খালি হওয়া জায়গায় নিজের জন্য রাজপ্রাসাদ ও বিলাসী বাগান গড়ে তোলেন নিরো। আবার ঘটনার জন্য খ্রিষ্টানদের দায়ী করেন এবং এই কারণে অনেককে গ্রেপ্তার ও প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তবে নিরোর কুখ্যাতি থাকলেও রোমের আগুনের ঘটনায় তাঁর বাঁশি বাজানোর দাবিকে ‘বহুল প্রচলিত রূপকথা’ বলাই শ্রেয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইমেরিটাস অধ্যাপক (গবেষণা) হ্যারল্ড ড্রেক বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সকে বলেন, নিরো সম্পর্কে যেসব ইতিহাস পাওয়া যায়, সেসব ইতিহাসের রচয়িতারা সবাই ছিল তাঁর প্রতিপক্ষ। যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের নিরো প্রজেক্টের কিউরেটর প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রান্সেসকা বোলোগনাও ড্রেকের এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

রোম যখন পুড়ছিল, নিরো কোথায় ছিলেন, আসলেই কি সে সময় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন তিনি। ছবি: সংগৃহীতড্রেক বলেন, আগুনের ঘটনার পরপরই নিরো রোমে ফিরে এসে বিপন্নদের জন্য আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। এমনকি আশ্রয়প্রার্থী মানুষের জন্য নিজের প্রাসাদ ও বাগান পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। তাহলে ‘রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’ এই গল্প কীভাবে এল? 

এ প্রসঙ্গে ড্রেক বলেন, নিরো নিজেকে গায়ক ভাবতে পছন্দ করতেন। রোমের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার মানুষের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম চলার সময়ই তাঁকে নিয়ে গুজবটি ছড়িয়ে পড়ে যে রোমের আগুনের সময় নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। 

এ ছাড়া নিজের শৈল্পিক ঝোঁক থেকেই তিনি এ অগ্নিকাণ্ডকে ট্রয়ের পতনের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বলে জানান ড্রেক। 

তাহলে কেন ইতিহাসে নিরোকে খারাপ শাসক হিসেবে দেখায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড্রেক বলেন, সম্রাট নিরো সম্পর্কে আধুনিক বিশ্বে যত তথ্য পাওয়া যায়, তার প্রায় সবগুলোই রোমান সিনেটর এবং খ্রিষ্টানদের দ্বারা রচিত এবং উভয়ই ছিল নিরোর ঘোর শত্রু।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত