এক কাপ টি–ব্যাগের চায়ে শত কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিক, প্রবেশ করে কোষে: গবেষণা

অনলাইন ডেস্ক    
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১: ৫৮
Thumbnail image
প্লাস্টিকের তৈরি টি ব্যাগ দিয়ে চা তৈরি করার সময় প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক কণা নিঃসৃত হয় ছবি: ভিয়েতনাম টি

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় চা। তবে স্বাস্থ্যের ওপর চুপিসারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এই পানীয়। শরীরকে উজ্জীবিত করার উপাদান ছাড়াও এর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে কিছু ক্ষতিকর কণা। স্পেনের এক নতুন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি টি ব্যাগ থেকে কোটি কোটি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা নিঃসৃত হয়, যা মানবদেহে প্রবাহিত হতে পারে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

স্পেনের অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএবি) গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিকের তৈরি টি ব্যাগ দিয়ে চা তৈরি করার সময় প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক কণা নিঃসৃত হয়, যা মানুষের অন্ত্রের কোষে প্রবেশ করে এবং রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য এক ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় প্লাস্টিক দূষণ। সাধারণত শ্বাসপ্রশ্বাস বা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রবাহিত হয়। নতুন গবেষণাটি এই সমস্যাটিকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে এবং প্লাস্টিকের টি ব্যাগকে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিঃসরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

প্লাস্টিক টি ব্যাগ এবং কণা নিঃসরণ

গবেষকেরা নাইলন-৬, পলিপ্রোপিলিন এবং সেলুলোজ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের টি ব্যাগ বিশ্লেষণ করেছেন। চা তৈরি করার সময় এই উপাদানগুলো বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিক কণা নিঃসৃত করে—

পলিপ্রোপিলিন: প্রতি মিলিলিটারে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন কণা, যার গড় আকার ১৩৬ দশমিক ৭ ন্যানোমিটার।

সেলুলোজ: প্রতি মিলিলিটারে প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন কণা, যার গড় আকার ২৪৪ ন্যানোমিটার।

নাইলন-৬: প্রতি মিলিলিটারে ৮ দশমিক ১৮ মিলিয়ন কণা, যার গড় আকার ১৩৮ দশমিক ৪ ন্যানোমিটার।

এই কণাগুলো খুব ছোট এবং খালি চোখে দেখা যায় না। তবে এগুলো একটি গুরুতর দূষণের কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

গবেষকেরা এই কণাগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে ছিল স্ক্যানিং এবং ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি (এসইমি এবং টিইএম), ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কোপি এবং ন্যানোপার্টিকেল ট্র্যাকিং বিশ্লেষণ (এনটিএ) এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা প্লাস্টিক কণাগুলোর আকার, গঠন এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেছেন।

প্লাস্টিক কণাগুলো মানব কোষে প্রবাহিত হয় যেভাবে

এই গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নতুন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন গবেষকেরা, যার মাধ্যমে তারা মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক–কে ‘স্টেইন’ করে মানব অন্ত্রের কোষের সঙ্গে তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্টেইন করার মানে হচ্ছে, তারা প্লাস্টিক কণাগুলোকে বিশেষ রঞ্জক বা রং দিয়ে চিহ্নিত করেছেন, যাতে এগুলো মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং তাদের কোষের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা যায়।

গবেষণার ফলাফল দেখিয়েছে যে, যেসব কোষ অন্ত্রের মিউকাস (স্লিমি পদার্থ) তৈরি করে, সেগুলো এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলো বেশি শোষণ করে। সাধারণত, অন্ত্রের মিউকাস স্তরটি আমাদের পাচনতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে। তবে, এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, মিউকাস স্তরটি এই ক্ষতিকর কণাগুলো শোষণে সাহায্য করতে পারে, যার ফলে কণাগুলো কোষে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি কিছু কণা কোষের নিউক্লিয়াসে (যেখানে জিনগত উপাদান রাখা থাকে) প্রবেশ করে, যা একটি বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ।

একবার এই কণাগুলো কোষে শোষিত হলে, সেগুলো রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে।

যদিও মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক কণাগুলোর মানবস্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে এই কণাগুলো কোষে প্রবাহিত হতে এবং জিনগত উপাদানের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম, যা ভবিষ্যতে গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে।

গবেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন যে, দীর্ঘমেয়াদি এসব প্লাস্টিক মানুষের দেহে প্রবেশ করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক, বিশেষত খাদ্য সংশ্লিষ্ট উৎস থেকে। তারা এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্লাস্টিকের ব্যবহারে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার দূষণ বাড়ছে, এবং এটি জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বার্মিংহামে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবা গার্সিয়া বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্লাস্টিক দূষণ কমানোর কার্যকরী কৌশল নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই গবেষণার ফলাফলটি এক নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি লুকানো প্লাস্টিক দূষণের উৎসকে উদ্ঘাটন করেছে।

গবেষণাপত্রটি ‘কেমোস্ফিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত