জাহাজ নির্মাণশিল্পে চীনা আধিপত্যের লাগাম টানতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image
চীনের শানডং প্রদেশের ওয়েইহাই শহরে একটি শিপইয়ার্ডে নির্মাণাধীন চায়না ওশান শিপিং কোম্পানির একটি জাহাজে কাজ করছেন কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

বৈশ্বিক সামুদ্রিক শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করতে চীন দীর্ঘদিন ধরে অন্যায্য নীতি ও পদ্ধতি ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ-বিষয়ক একটি তদন্তের ফলাফলে উঠে এসেছে চীনের অর্থনৈতিক ভর্তুকি, প্রযুক্তি হস্তান্তরের চাপ ও মেধাস্বত্ব চুরির মতো কর্মকাণ্ডের চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদন চীনের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনাকে আরও তীব্র করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বলেছে, চীন অন্যায্য নীতি ও পদ্ধতির মাধ্যমে বৈশ্বিক সামুদ্রিক পরিবহন, লজিস্টিকস ও জাহাজ নির্মাণশিল্পে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। মাসব্যাপী চলা একটি বাণিজ্য তদন্ত শেষে তিনটি নির্ভরযোগ্য সূত্র রয়টার্সকে এই তথ্য জানিয়েছে।

২০২৪ সালের এপ্রিলে মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) ক্যাথরিন টাই ইউনাইটেড স্টিলওয়ার্কার্স এবং আরও চারটি মার্কিন ইউনিয়নের অনুরোধে ট্রেড অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর ৩০১ ধারা অনুযায়ী এই তদন্ত শুরু করেন। এই আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি কোনো দেশের অন্যায্য বা অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডের কারণে নিজস্ব বাণিজ্যে ক্ষতির সম্মুখীন হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে দেখা গেছে, চীন অর্থনৈতিক সহায়তা, বিদেশি কোম্পানির জন্য বাধা, প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য চাপ এবং মেধাস্বত্ব চুরির মাধ্যমে জাহাজ নির্মাণ ও সামুদ্রিক শিল্পে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া চীন শ্রমিকদের মজুরি কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রেখেছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

তবে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০ সালে বৈশ্বিক ১৫০ বিলিয়ন ডলারের জাহাজ নির্মাণশিল্পে চীনের শেয়ার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, একসময়ের প্রভাবশালী মার্কিন জাহাজ নির্মাতারা এখন তাদের অংশ ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। আর দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান পরবর্তী বৃহৎ জাহাজ নির্মাণশিল্পের দেশ হতে চলেছে।

প্রতিবেদনে চীনের জাহাজ নির্মাণ খাতে আধিপত্য বিস্তার মার্কিন শিল্পের জন্য প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নতুন প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে; যেমন শুল্ক আরোপ বা চীনা জাহাজে পোর্ট ফি বসানোর প্রস্তাব। তবে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে জনমত যাচাই করা হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেওয়ার আগে তাঁর দল এই প্রতিবেদনকে চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য হাতিয়ার হিসেবে দেখছে। এর আগে ট্রাম্প প্রশাসন ১৯৭৪ সালের বাণিজ্য আইনের ৩০১ ধারা ব্যবহার করে চীনা পণ্যে কয়েক শ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আরোপ করেছিল।

মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর), হোয়াইট হাউস কিংবা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিম এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। একইভাবে চীনা কর্মকর্তারাও এ নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাননি।

রয়টার্সের সূত্র অনুযায়ী, ইউএসটিআর চলতি সপ্তাহে তদন্তের ফল প্রকাশ করবে, যা বাইডেনের মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগেই জনসমক্ষে আসবে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির কঠোর সমালোচনার মধ্যে প্রতিবেদনটি সামনে এসেছে। চীনের আক্রমণাত্মক শিল্পনীতি, ইস্পাতসহ বিভিন্ন পণ্যের অতিরিক্ত উৎপাদন নীতির কারণে এই সমালোচনা তৈরি হয়েছে।

এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ নির্মাণশিল্প পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বিরল দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যকে প্রতিফলিত করে। তবে চীন কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

চীনের আধিপত্য কমাতে বাইডেন প্রশাসন গত চার বছরে ট্রাম্প আমলের শুল্ক বজায় রেখে নতুন শুল্ক আরোপ করেছে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক যানবাহনসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

গত মাসে ইউএসটিআর চীনা সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে তদন্তের ঘোষণা দেয়। ফলে এখন দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্য; যেমন অটোমোবাইল, ওয়াশিং মেশিন এবং টেলিকম সরঞ্জামের জন্য ব্যবহৃত চিপগুলোর ওপর আরও শুল্ক আরোপ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের সমৃদ্ধ জাহাজ নির্মাণশিল্প পুনর্গঠন করতে কয়েক দশক সময় এবং বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। শুধু শুল্ক আরোপ যথেষ্ট নয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের একটি উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, ‘চীনের সামুদ্রিক শিল্প, লজিস্টিকস এবং জাহাজ নির্মাণ খাতে আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা।

আমেরিকান অ্যালায়েন্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের প্রেসিডেন্ট স্কট পল মনে করেন, এই অনুসন্ধানের ফল খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, আমাদের জাহাজ নির্মাণশিল্পের অবক্ষয় বন্ধ এবং এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে একটি সহায়ক প্রক্রিয়া চালু করা হবে।’

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে চীনের সামুদ্রিক শিল্পে আধিপত্যের নীতির সমালোচনা করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনা নীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমাদের অবশ্যই পথ পরিবর্তন করতে হবে।’ তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয় জাহাজ নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে মিত্রদের সাহায্য নিতে হতে পারে বলেও জানান।

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ এই ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ডেমোক্র্যাট সিনেটর মার্ক কেলির সঙ্গে একটি দ্বিদলীয় বিল প্রণয়নে কাজ করেছেন, যা জাহাজ নির্মাণশিল্পের পুনরুজ্জীবনে সহায়ক হবে।

পল আরও বলেন, ‘আমরা বিশেষত চীনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আমাদের জরুরি প্রয়োজনীয়তার জায়গাগুলো খুবই দুর্বল। একটি সুপারপাওয়ারের জন্য এটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ২০টি জাহাজ নির্মাণ কারখানা রয়েছে, যেখানে ১৯ শতকের আশির দশকে এই সংখ্যা ছিল ৩ শতাধিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসামরিক ও সামরিক জাহাজের চাহিদা এখনো ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত