ইশতিয়াক হাসান
কালিম্পংয়ে ঘুরতে যাবেন যেসব জায়গায়
ভারতের পাহাড়ি শহর কালিম্পং সম্পর্কে ভালোভাবে জানা সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজের বই পড়ে। অর্জুনের সঙ্গে কালিম্পংয়ে ‘সীতাহরণ রহস্যে’ বুঁদ হয়ে ছিলাম রীতিমতো। সেই কালিম্পংয়ে যাওয়া হয় হঠাৎ করেই। দার্জিলিং গিয়েছিলাম। ভ্রমণের তৃতীয় রাতে মনে হলো, কালিম্পং গেলে কেমন হয়! ব্যাস পরদিন সকালেই একটি গাড়ি ভাড়া করে চললাম কালিম্পং। ভ্রমণে আমার সঙ্গী স্ত্রী পুনম, মেয়ে ওয়াফিকা, শাশুড়ি ও খালা শাশুড়ি।
কালিম্পংয়ের পথে
‘ঘুম’ পর্যন্ত পরিচিত পথ মানে তেনজিং নোরগে রোড ধরে চলল গাড়ি। তারপর জোড় বাংলো পেরিয়ে নতুন এক রাস্তায় ঢুকল। এটা পেশক-রিশি রোড। মুহূর্তে বদলে গেল প্রকৃতি। দার্জিলিং এসে সে অর্থে কোনো জঙ্গলে ঢুঁ না মারায় মন ভার ছিল। এখন দেখলাম দুই পাশে গভীর বনানী। উঁচু উঁচু পাইন, বার্চ গাছ দাঁড়িয়ে।
আমাদের চালক হিন্দিতে যা বলল, তা আরও আশা জোগাল মনে। দুই পাশের জঙ্গলে ল্যাপার্ড ও লাল পান্ডা আছে। অনুমান করলাম এই উঁচু পাহাড়ি বনটা সেনচাল ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়েরির মধ্যে পড়েছে। ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেনচাল, ভারতের সবচেয়ে পুরোনো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যগুলোর একটি। বড় দুটো লেক আছে জঙ্গলের সীমানায়। দার্জিলিংয়ের অন্য অংশে সিংগালিলার জঙ্গলে লাল পান্ডারা আছে জানি, তবে সেনচালে লাল পান্ডার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি আসার পরও।
গাড়ি চালকের কথা অনুয়ায়ী পথের ওপর ভোরে বা সন্ধ্যার দিকে হরিণ ওঠে আসে। একটু পরেই মোটামুটি মাঝ রাস্তায় বসে ভোজে ব্যস্ত দুই জোড়া বানরের দেখা মিলল। আমাদের দেখে কেবল এক পাশে সরে পড়ল। ওয়াফিকা এদের দেখে, খোলা জানালা পথে মুখ বের করে, চিৎকার জুড়ে দিল। বানরের দল নতুন পাগলের আমদানিতে একটু অবাকই হলো মনে হয়!
পাহাড়ি শহরের দেখা
দুই পাশে পাহাড়, অরণ্যের মাঝ দিয়ে গাড়ি যখন ছুটছিল তখন মনে হচ্ছিল আহ এই পথ যদি শেষ না হতো! কোনো গন্তব্যে পৌঁছার চেয়ে পথের সৌন্দর্যটা কখনোই কম আনন্দদায়ক নয় আমার কাছে। একটু পর গাড়িটা যখন বাঁক নিচ্ছে আশ্চর্য একটা জিনিস খেয়াল করলাম। অনেক দূরে উঁচু পাহাড়ের গায়ে অনেকই বাড়ি ঘর। যেন পাহাড়ের বুকে কোনো শহর। চালককে জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পেলাম তাতে চমকালাম, ওটাই সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। একটু পর দূরের আরেক পাহাড়রাজ্যে বাড়ি-ঘর দেখিয়ে নেপালি লোকটা বলল, ওটা কালিম্পং। এরপর আমার চোখ একবার যায় গ্যাংটকের দিকে, আরেকবার কালিম্পংয়ের দিকে।
তিস্তায় মুগ্ধ
পথের চমক এখানেই শেষ হলো না, নেপালি চালক, জানাল সামনে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। ওখান থেকে তিস্তাকে দেখায় অপরূপ! আমরা খুশি মনে নেমে পড়লাম। ডান পাশে পাইনের জঙ্গল। ভিউ পয়েন্টটা একটু উঁচুতে। শান বাধানো এক জায়গা। চারপাশে কয়েকটা দোকান। চা, বিস্কুট, চকলেট এমনকি আশপাশের বাগান থেকে তুলে আনা কমলাও আছে। এক কাপ কফি হাতে এসে দাঁড়ালাম শান বাধানো জায়গাটির কিনারে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাক্কা খেলাম, এতটাই যে আরেকটু হলে হাত থেকে কাপই পড়ে যেত, বুনো সৌন্দর্যের ধাক্কা।
সবুজ গাছপালায় ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়, মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে তিস্তা। কোথাও কোথাও পাহাড়ি নদীর পাড়ে চিকন বালুর রেখা, কোথাও আবার জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটা বালিয়াড়ির মতো দেখা যাচ্ছে। ভাবছিলাম ইস যদি ওখানে, ওই জল-পাহাড়ের রাজ্যে কতকটা সময় কাটানো যেত! যেন সম্মোহিত এক মানুষ আমি, চোখ সরাতে পারছিলাম না। তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার চেপে বসলাম গাড়িতে। আমাদের গোমড়ামুখো কিন্তু ভালোমানুষ চালক এই পর্যায়ে দিল নতুন তথ্য পাহাড়ি নদী তিস্তায় আছে র্যাফটিং করার ব্যবস্থা।
কালিম্পংয়ের সীমানায়
এক সময় নিচে নেমে এলো গাড়ি, তারপর আবার উঠতে শুরু করল, কালিম্পংয়ের দিকে। এদিকটায়ও পথ অনেকই সুন্দর। এক পাশে রাস্তার পরেই পাহাড়, অন্য পাশে ঢালু হয়ে নেমে গেছে জমি, দূরে পাহাড়ের রেখা। আমাদের পাশ কাটিয়ে টুরিস্ট মিনি বাস গেল, জানলাম কালিম্পং-শিলিগুড়ি রোডে চলে ওগুলো। এক সময় ডানে একটা-দুটো বাড়ি-ঘর, হোটেল দেখা যেতে লাগল। বুঝলাম কালিম্পংয়ের সীমানায় চলে এসেছি।
কালিম্পংয়ের বেশি হোটেল-মোটেল বাজারের ধারে, জায়গাটি বেশ ঘিঞ্জি। একটু খুঁজে-পেতে এখানেই একটা হোটেল ঠিক করে ফেলি। ভাড়া ১৮০০ রুপি। নিচে বার থাকায় কড়া একটা গন্ধ সব সময় মাথা ধরিয়ে তুলত আমার। তবে অন্যদের তেমন হেলদোল দেখিনি। এখানে কালিম্পংয়ের আশপাশে বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান দেখার জন্য গাড়ি ঠিক করি। কালিম্পং থেকে গাড়িতে চেপে লাভা, ললেগাঁও, রিসপের মতো জায়গায় চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। তবে আজ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে শহরের ভেতরের কিংবা শহরলগোয়া কিছু স্পটের সঙ্গে। এগুলোর বেশিরভাগেই সশরীরে গিয়েছিলাম কালিম্পং ভ্রমণে।
হনুমান মন্দির
হনুমান টেম্পল বা হনুমান মন্দির আমার আর ওয়াফিকার দুজনেরই দারুণ পছন্দ হয়। শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়, একেবারে কাছেও নয়। আট কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তবে পৌঁছাই দেলো পাহাড়ের হনুমান টেম্পলের সামনে। কেউ কেউ চেনেন জায়গাটিকে হনুমান পিক নামে। সিঁড়ি ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় বিশালদেহী হনুমান ভাস্কর্যের কাছে।
তবে সোজা পথটা না ধরে, বেশ কতকটা আঁকাবাঁকা কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া ঘুরপথটা ব্যবহার করলে বেশি আনন্দ পাবেন। এখান থেকে চারপাশের পাহাড়রাজ্যের অনেকটাই চোখে পড়ে। একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখার চেয়ে একটু দূর থেকে দেখলেই হনুমানের ওপর সমীহ জাগে বেশি। ২০০৪ সালে উদ্বোধন হওয়া মূর্তিটির উচ্চতা ত্রিশ ফুট।
দুর্গা মন্দির
হনুমান টেম্পলের কাছেই দুর্গা মন্দির। কাজেই দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। সব ধরনের পর্যটকই জায়গাটিতে একবার ঢুঁ মেরে যান। কিছুক্ষণ সময় কাটানোর এর জন্য তুলনা নেই। চারপাশে গাছপালা লাগিয়ে বাগানের মতো করা হয়েছে, সুদৃশ্য একটা ঘণ্টা আছে, আমরা সবাই ওটা বাজালাম, এমনকি ওয়াফিকাকেও উঁচু করে ধরতে হলো। এখান থেকে চারপাশের পাহাড়রাজ্যের অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ে।
দেলো পার্ক
যাওয়ার পথটা অনেকই সুন্দর। দেলো হিল কালিম্পং শহরের সবচেয়ে উচ্চতম পয়েন্ট। এটি এখানকার সবচেয়ে মশহুর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি। পরিষ্কার দিনে হিমালয় পর্বতমালা, আশপাশের রাজ্য এবং রেল্লি ও তিস্তা উপত্যকার গ্রামগুলোর চমৎকার দৃশ্য উপভোগের সুযোগ পাবেন এখান থেকে। এখানে নানা ধরনের রাইডের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে বিখ্যাত প্যারা গ্লাইডিং।
পাইন ভিউ নার্সারি
আতিশা রোডের এই নার্সারিটি উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় পাওয়া যাওয়া হরেক জাতের ক্যাকটাসে ভরপুর। একসঙ্গে এত জাতের কাটার রাজাদের আর কোথাও দেখিনি। কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম এই নার্সারিতে। ওয়াফিকা তো কোনোভাবেই নার্সারি ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না।
মঙ্গলধাম
মঙ্গলধামটাও ঘুরে আসতে ভুলবেন না। মন্দিরটির নির্মাণশৈলী চোখে পড়ার মতো। দুই একর জায়গা নিয়ে মন্দিরটি, ঢোকার মুখেই বাহারি সব বৃক্ষ দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠেছিল। ওপরের তলায় মন্দিরের প্রার্থনার জায়গা।
থংসা গুম্ফা
মঙ্গলধামের কাছেই থংসা গুম্ফা। কালিম্পংয়ের সবচেয়ে পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির এটি। ভুটান গুম্ফা নামে পরিচিত মনাস্ট্রিটি ১৬৯২ সালে ভুটানের রাজার সরাসরি তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়। পরে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উনিশ শতকে নতুন করে তৈরি করা হয়।
আর্মি গলফ কোর্স
বেশ কতকটা জঙ্গল, পাহাড়কে সঙ্গী করে এগোতে হয় বলে আবার খুব পছন্দ হয়েছিল আর্মি গলফ কোর্সটা। পাহাড়ের ওপর ৯ গর্তের গলফ মাঠটা। ক্লাবের রেস্তোরাঁটি বনেদি, তবে খাবার-দাবারের দাম চড়া। এখানে বসে অনেকটা সময় গলফারদের মনের আনন্দে খেলে বেড়াতে দেখেছি মাঠে।
লেপচা জাদুঘর
মূল শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে লেপচা মিউজিয়ামের অবস্থান। এটি একই সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। স্থানীয়দের ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে জায়গাটিতে ভ্রমণ জরুরি। স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র, পোশাকসহ নানা সামগ্রী আপনাকে লেপচাদের জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করবে।
মরগান’স হাউস
এখন ওয়েস্ট বেঙ্গল টুরিস্ট ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের আওতাধীন পর্যটন বাংলোটি ব্রিটিশ আমলের পুরোনো এক বাংলো। এর নির্মাণশৈলী আপনাকে আকৃষ্ট করবে। তেমনি প্রকৃতিপ্রেমিক হলে ভেতরের নানা জাতের গাছপালা আর পাখিও টানবে। উত্তম কুমার, কিশোর কুমারের মতো মানুষেরা এখানে থেকেছিলেন। শুনে অবাক হবেন ভুতুড়ে হিসেবেও নাম আছে এর।
খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য
কালিম্পংয়ে খাওয়া নিয়ে আমার একটু ঝামেলা হয়েছে। পুনম অবশ্য ওদের থালিতে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল। আমার ওদের ভাতটা খুব শক্ত লেগেছে। তবে রাস্তার ধারে এক দোকানে মমোটা ভালো জমেছিল। রাতে বাজারের পাশের একটা পথ ধরে হেঁটেছি অনেকটা, তখন গা কেমন ছম ছম করেছে নির্জনতায়, এখান থেকেই সবুজ পাহাড়গুলোকে দিনে ভারি সুন্দর লেগেছিল।
এ ছাড়াও কালিম্পংয়ে পাবেন আরও অনেক গুম্ফা, জাদুঘর ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা বাজারের কাছে একটা হোটেলে ওঠায় কিছু সুবিধা পেয়েছি সত্যি, তবে আমি বলব আপনারা একটু নীরব এলাকায় কোনো হোটেল কিংবা হোম স্টেতে উঠবেন, যেখান থেকে পাহাড়রাজ্য এমনকি কাঞ্চনজঙ্ঘার ভালো ভিউ পাওয়া যায়। অবশ্য দুনিয়ার তৃতীয় উচ্চতম পাহাড়ের দেখা পেতেই হবে তা নয়, এ ছাড়াও কালিম্পংয়ের সবুজ, কখনো বরফে ঢাকা পাহাড়, বনাঞ্চল অনেকই সুন্দর। কালিম্পং থেকে গিয়েছিলাম লাভা। সেখানকার গল্প জমা থাকুক অন্য কোনো দিনের জন্য।
কীভাবে যাবেন
ভারত যাওয়ার জন্য ভিসাটা করে নিতে হবে শুরুতে। বাসে গেলে চেংড়াবান্দা (বাংলাদেশ অংশে বুড়িমারী) হয়ে শিলিগুড়ি যাবেন। এ ছাড়া ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেসে করে চলে যেতে পারবেন নিউ জলপাইগুড়ি। জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে জিপ বা বাসে চলে যেতে পারবেন কালিম্পং। সেখান থেকে এক দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে এই জায়গাগুলি ঘুরে আসতে পারবেন অনায়াসে।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল ট্রায়াঙ্গল
কালিম্পংয়ে ঘুরতে যাবেন যেসব জায়গায়
ভারতের পাহাড়ি শহর কালিম্পং সম্পর্কে ভালোভাবে জানা সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজের বই পড়ে। অর্জুনের সঙ্গে কালিম্পংয়ে ‘সীতাহরণ রহস্যে’ বুঁদ হয়ে ছিলাম রীতিমতো। সেই কালিম্পংয়ে যাওয়া হয় হঠাৎ করেই। দার্জিলিং গিয়েছিলাম। ভ্রমণের তৃতীয় রাতে মনে হলো, কালিম্পং গেলে কেমন হয়! ব্যাস পরদিন সকালেই একটি গাড়ি ভাড়া করে চললাম কালিম্পং। ভ্রমণে আমার সঙ্গী স্ত্রী পুনম, মেয়ে ওয়াফিকা, শাশুড়ি ও খালা শাশুড়ি।
কালিম্পংয়ের পথে
‘ঘুম’ পর্যন্ত পরিচিত পথ মানে তেনজিং নোরগে রোড ধরে চলল গাড়ি। তারপর জোড় বাংলো পেরিয়ে নতুন এক রাস্তায় ঢুকল। এটা পেশক-রিশি রোড। মুহূর্তে বদলে গেল প্রকৃতি। দার্জিলিং এসে সে অর্থে কোনো জঙ্গলে ঢুঁ না মারায় মন ভার ছিল। এখন দেখলাম দুই পাশে গভীর বনানী। উঁচু উঁচু পাইন, বার্চ গাছ দাঁড়িয়ে।
আমাদের চালক হিন্দিতে যা বলল, তা আরও আশা জোগাল মনে। দুই পাশের জঙ্গলে ল্যাপার্ড ও লাল পান্ডা আছে। অনুমান করলাম এই উঁচু পাহাড়ি বনটা সেনচাল ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়েরির মধ্যে পড়েছে। ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেনচাল, ভারতের সবচেয়ে পুরোনো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যগুলোর একটি। বড় দুটো লেক আছে জঙ্গলের সীমানায়। দার্জিলিংয়ের অন্য অংশে সিংগালিলার জঙ্গলে লাল পান্ডারা আছে জানি, তবে সেনচালে লাল পান্ডার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি আসার পরও।
গাড়ি চালকের কথা অনুয়ায়ী পথের ওপর ভোরে বা সন্ধ্যার দিকে হরিণ ওঠে আসে। একটু পরেই মোটামুটি মাঝ রাস্তায় বসে ভোজে ব্যস্ত দুই জোড়া বানরের দেখা মিলল। আমাদের দেখে কেবল এক পাশে সরে পড়ল। ওয়াফিকা এদের দেখে, খোলা জানালা পথে মুখ বের করে, চিৎকার জুড়ে দিল। বানরের দল নতুন পাগলের আমদানিতে একটু অবাকই হলো মনে হয়!
পাহাড়ি শহরের দেখা
দুই পাশে পাহাড়, অরণ্যের মাঝ দিয়ে গাড়ি যখন ছুটছিল তখন মনে হচ্ছিল আহ এই পথ যদি শেষ না হতো! কোনো গন্তব্যে পৌঁছার চেয়ে পথের সৌন্দর্যটা কখনোই কম আনন্দদায়ক নয় আমার কাছে। একটু পর গাড়িটা যখন বাঁক নিচ্ছে আশ্চর্য একটা জিনিস খেয়াল করলাম। অনেক দূরে উঁচু পাহাড়ের গায়ে অনেকই বাড়ি ঘর। যেন পাহাড়ের বুকে কোনো শহর। চালককে জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পেলাম তাতে চমকালাম, ওটাই সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। একটু পর দূরের আরেক পাহাড়রাজ্যে বাড়ি-ঘর দেখিয়ে নেপালি লোকটা বলল, ওটা কালিম্পং। এরপর আমার চোখ একবার যায় গ্যাংটকের দিকে, আরেকবার কালিম্পংয়ের দিকে।
তিস্তায় মুগ্ধ
পথের চমক এখানেই শেষ হলো না, নেপালি চালক, জানাল সামনে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। ওখান থেকে তিস্তাকে দেখায় অপরূপ! আমরা খুশি মনে নেমে পড়লাম। ডান পাশে পাইনের জঙ্গল। ভিউ পয়েন্টটা একটু উঁচুতে। শান বাধানো এক জায়গা। চারপাশে কয়েকটা দোকান। চা, বিস্কুট, চকলেট এমনকি আশপাশের বাগান থেকে তুলে আনা কমলাও আছে। এক কাপ কফি হাতে এসে দাঁড়ালাম শান বাধানো জায়গাটির কিনারে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাক্কা খেলাম, এতটাই যে আরেকটু হলে হাত থেকে কাপই পড়ে যেত, বুনো সৌন্দর্যের ধাক্কা।
সবুজ গাছপালায় ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়, মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে তিস্তা। কোথাও কোথাও পাহাড়ি নদীর পাড়ে চিকন বালুর রেখা, কোথাও আবার জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটা বালিয়াড়ির মতো দেখা যাচ্ছে। ভাবছিলাম ইস যদি ওখানে, ওই জল-পাহাড়ের রাজ্যে কতকটা সময় কাটানো যেত! যেন সম্মোহিত এক মানুষ আমি, চোখ সরাতে পারছিলাম না। তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার চেপে বসলাম গাড়িতে। আমাদের গোমড়ামুখো কিন্তু ভালোমানুষ চালক এই পর্যায়ে দিল নতুন তথ্য পাহাড়ি নদী তিস্তায় আছে র্যাফটিং করার ব্যবস্থা।
কালিম্পংয়ের সীমানায়
এক সময় নিচে নেমে এলো গাড়ি, তারপর আবার উঠতে শুরু করল, কালিম্পংয়ের দিকে। এদিকটায়ও পথ অনেকই সুন্দর। এক পাশে রাস্তার পরেই পাহাড়, অন্য পাশে ঢালু হয়ে নেমে গেছে জমি, দূরে পাহাড়ের রেখা। আমাদের পাশ কাটিয়ে টুরিস্ট মিনি বাস গেল, জানলাম কালিম্পং-শিলিগুড়ি রোডে চলে ওগুলো। এক সময় ডানে একটা-দুটো বাড়ি-ঘর, হোটেল দেখা যেতে লাগল। বুঝলাম কালিম্পংয়ের সীমানায় চলে এসেছি।
কালিম্পংয়ের বেশি হোটেল-মোটেল বাজারের ধারে, জায়গাটি বেশ ঘিঞ্জি। একটু খুঁজে-পেতে এখানেই একটা হোটেল ঠিক করে ফেলি। ভাড়া ১৮০০ রুপি। নিচে বার থাকায় কড়া একটা গন্ধ সব সময় মাথা ধরিয়ে তুলত আমার। তবে অন্যদের তেমন হেলদোল দেখিনি। এখানে কালিম্পংয়ের আশপাশে বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান দেখার জন্য গাড়ি ঠিক করি। কালিম্পং থেকে গাড়িতে চেপে লাভা, ললেগাঁও, রিসপের মতো জায়গায় চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। তবে আজ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে শহরের ভেতরের কিংবা শহরলগোয়া কিছু স্পটের সঙ্গে। এগুলোর বেশিরভাগেই সশরীরে গিয়েছিলাম কালিম্পং ভ্রমণে।
হনুমান মন্দির
হনুমান টেম্পল বা হনুমান মন্দির আমার আর ওয়াফিকার দুজনেরই দারুণ পছন্দ হয়। শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়, একেবারে কাছেও নয়। আট কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তবে পৌঁছাই দেলো পাহাড়ের হনুমান টেম্পলের সামনে। কেউ কেউ চেনেন জায়গাটিকে হনুমান পিক নামে। সিঁড়ি ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় বিশালদেহী হনুমান ভাস্কর্যের কাছে।
তবে সোজা পথটা না ধরে, বেশ কতকটা আঁকাবাঁকা কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া ঘুরপথটা ব্যবহার করলে বেশি আনন্দ পাবেন। এখান থেকে চারপাশের পাহাড়রাজ্যের অনেকটাই চোখে পড়ে। একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখার চেয়ে একটু দূর থেকে দেখলেই হনুমানের ওপর সমীহ জাগে বেশি। ২০০৪ সালে উদ্বোধন হওয়া মূর্তিটির উচ্চতা ত্রিশ ফুট।
দুর্গা মন্দির
হনুমান টেম্পলের কাছেই দুর্গা মন্দির। কাজেই দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। সব ধরনের পর্যটকই জায়গাটিতে একবার ঢুঁ মেরে যান। কিছুক্ষণ সময় কাটানোর এর জন্য তুলনা নেই। চারপাশে গাছপালা লাগিয়ে বাগানের মতো করা হয়েছে, সুদৃশ্য একটা ঘণ্টা আছে, আমরা সবাই ওটা বাজালাম, এমনকি ওয়াফিকাকেও উঁচু করে ধরতে হলো। এখান থেকে চারপাশের পাহাড়রাজ্যের অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ে।
দেলো পার্ক
যাওয়ার পথটা অনেকই সুন্দর। দেলো হিল কালিম্পং শহরের সবচেয়ে উচ্চতম পয়েন্ট। এটি এখানকার সবচেয়ে মশহুর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি। পরিষ্কার দিনে হিমালয় পর্বতমালা, আশপাশের রাজ্য এবং রেল্লি ও তিস্তা উপত্যকার গ্রামগুলোর চমৎকার দৃশ্য উপভোগের সুযোগ পাবেন এখান থেকে। এখানে নানা ধরনের রাইডের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে বিখ্যাত প্যারা গ্লাইডিং।
পাইন ভিউ নার্সারি
আতিশা রোডের এই নার্সারিটি উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় পাওয়া যাওয়া হরেক জাতের ক্যাকটাসে ভরপুর। একসঙ্গে এত জাতের কাটার রাজাদের আর কোথাও দেখিনি। কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম এই নার্সারিতে। ওয়াফিকা তো কোনোভাবেই নার্সারি ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না।
মঙ্গলধাম
মঙ্গলধামটাও ঘুরে আসতে ভুলবেন না। মন্দিরটির নির্মাণশৈলী চোখে পড়ার মতো। দুই একর জায়গা নিয়ে মন্দিরটি, ঢোকার মুখেই বাহারি সব বৃক্ষ দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠেছিল। ওপরের তলায় মন্দিরের প্রার্থনার জায়গা।
থংসা গুম্ফা
মঙ্গলধামের কাছেই থংসা গুম্ফা। কালিম্পংয়ের সবচেয়ে পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির এটি। ভুটান গুম্ফা নামে পরিচিত মনাস্ট্রিটি ১৬৯২ সালে ভুটানের রাজার সরাসরি তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়। পরে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উনিশ শতকে নতুন করে তৈরি করা হয়।
আর্মি গলফ কোর্স
বেশ কতকটা জঙ্গল, পাহাড়কে সঙ্গী করে এগোতে হয় বলে আবার খুব পছন্দ হয়েছিল আর্মি গলফ কোর্সটা। পাহাড়ের ওপর ৯ গর্তের গলফ মাঠটা। ক্লাবের রেস্তোরাঁটি বনেদি, তবে খাবার-দাবারের দাম চড়া। এখানে বসে অনেকটা সময় গলফারদের মনের আনন্দে খেলে বেড়াতে দেখেছি মাঠে।
লেপচা জাদুঘর
মূল শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে লেপচা মিউজিয়ামের অবস্থান। এটি একই সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। স্থানীয়দের ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে জায়গাটিতে ভ্রমণ জরুরি। স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র, পোশাকসহ নানা সামগ্রী আপনাকে লেপচাদের জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করবে।
মরগান’স হাউস
এখন ওয়েস্ট বেঙ্গল টুরিস্ট ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের আওতাধীন পর্যটন বাংলোটি ব্রিটিশ আমলের পুরোনো এক বাংলো। এর নির্মাণশৈলী আপনাকে আকৃষ্ট করবে। তেমনি প্রকৃতিপ্রেমিক হলে ভেতরের নানা জাতের গাছপালা আর পাখিও টানবে। উত্তম কুমার, কিশোর কুমারের মতো মানুষেরা এখানে থেকেছিলেন। শুনে অবাক হবেন ভুতুড়ে হিসেবেও নাম আছে এর।
খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য
কালিম্পংয়ে খাওয়া নিয়ে আমার একটু ঝামেলা হয়েছে। পুনম অবশ্য ওদের থালিতে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল। আমার ওদের ভাতটা খুব শক্ত লেগেছে। তবে রাস্তার ধারে এক দোকানে মমোটা ভালো জমেছিল। রাতে বাজারের পাশের একটা পথ ধরে হেঁটেছি অনেকটা, তখন গা কেমন ছম ছম করেছে নির্জনতায়, এখান থেকেই সবুজ পাহাড়গুলোকে দিনে ভারি সুন্দর লেগেছিল।
এ ছাড়াও কালিম্পংয়ে পাবেন আরও অনেক গুম্ফা, জাদুঘর ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা বাজারের কাছে একটা হোটেলে ওঠায় কিছু সুবিধা পেয়েছি সত্যি, তবে আমি বলব আপনারা একটু নীরব এলাকায় কোনো হোটেল কিংবা হোম স্টেতে উঠবেন, যেখান থেকে পাহাড়রাজ্য এমনকি কাঞ্চনজঙ্ঘার ভালো ভিউ পাওয়া যায়। অবশ্য দুনিয়ার তৃতীয় উচ্চতম পাহাড়ের দেখা পেতেই হবে তা নয়, এ ছাড়াও কালিম্পংয়ের সবুজ, কখনো বরফে ঢাকা পাহাড়, বনাঞ্চল অনেকই সুন্দর। কালিম্পং থেকে গিয়েছিলাম লাভা। সেখানকার গল্প জমা থাকুক অন্য কোনো দিনের জন্য।
কীভাবে যাবেন
ভারত যাওয়ার জন্য ভিসাটা করে নিতে হবে শুরুতে। বাসে গেলে চেংড়াবান্দা (বাংলাদেশ অংশে বুড়িমারী) হয়ে শিলিগুড়ি যাবেন। এ ছাড়া ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেসে করে চলে যেতে পারবেন নিউ জলপাইগুড়ি। জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে জিপ বা বাসে চলে যেতে পারবেন কালিম্পং। সেখান থেকে এক দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে এই জায়গাগুলি ঘুরে আসতে পারবেন অনায়াসে।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল ট্রায়াঙ্গল
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
৪ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
৪ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
৪ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
৪ দিন আগে