Ajker Patrika

বিশ টাকার সালাম ও বাংলা সংস্কৃতি

স্বপ্না রেজা
বৈশাখ উদ্‌যাপন থেকে বাঙালি জাতিকে কখনো বিরত রাখা যায়নি। ফাইল ছবি
বৈশাখ উদ্‌যাপন থেকে বাঙালি জাতিকে কখনো বিরত রাখা যায়নি। ফাইল ছবি

বেশ কিছুদিন ধরেই মনটা খারাপ। ইদানীং বেশি রকম ভালো থাকে না। কারণ বহুবিধ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণই উল্লেখযোগ্য। কাজের মূল্য চাইতে গেলে পুরোটা পাওয়া যায় না। বলা হয়, আর্থিক সংকট। অপেক্ষা করতে হবে। শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা দেশটাই অনেক দিন ধরে আর্থিক দৈন্যে দোল খাচ্ছে। এই দোলায় মাথা ধরে। এই দুলুনি বেড়ে যায় বাজারে গেলে। নিত্যপণ্যের দাম শুনে নিজেকে ভিখারি মনে হয়। আবার সামাজিক অবস্থা দেখে পেছনে হাঁটি। পথেঘাটে নারীকে যেভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে তা দেখে মনে হয়, দেশটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরছে তার কক্ষপথে। আইন নেই, আইনের শাসন নেই। অনেকে তো বলে বসেন, এ দেশে সরকার নেই। কথায় কথায় নারীর প্রতি সহিংসতা দেখানো যেন এখন সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এত প্রকাশ্যে এসব করা হচ্ছে, যেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীবিদ্বেষী যুগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় কারণে-অকারণে এবং ঘুরেফিরে। নারী জাতিকে ঘরের ভেতরে ঢোকানোর পাঁয়তারা বলে অনেকে সেটা মনে করছেন। এসব ঘটনা যাঁরা ঘটাচ্ছেন, বয়সে তাঁরা তরুণ, যেটা অনেকের কাছেই রীতিমতো অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু নারী নয়, পথেঘাটে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতিও অশোভন ও আপত্তিকর আচরণ করতে দেখা যায়। এখন যেন এমন নেতিবাচক আচরণের মাত্রা একটু বেশিই।

যখন একটা অদ্ভুত ও অস্বস্তিকর সামাজিক পরিবেশে চলাচলে বেশ শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়, তখন একটা বিষয় বেশ চোখে পড়ে, মানে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। এই যেমন—যখন কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামার সময় কোনো নিরাপত্তাকর্মীই চোখে পড়ে না। দেখা যায় না। কাজ শেষ করে যখন গাড়িতে উঠতে যাওয়া হয়, ঠিক তখন কোথা থেকে যেন নিরাপত্তাকর্মী (পোশাক বলে) উড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে স্মার্টলি বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম।’ পথেঘাটে এমন সালাম মন্দ না। আজকাল তো অন্যের মঙ্গল চাওয়া বা সম্মান দেখানোর চলটা প্রায় বিলুপ্তই বলা যায়। যা হোক, উত্তর দিতেই হয়, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’। কিন্তু এমন উত্তরে তার চেহারায় কোনো সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি দেখা যায় না। মানে বেশ বোঝা যায় যে, সে অন্য কোনো ধরনের রেসপন্সের অপেক্ষায় রয়েছে। এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমার গাড়িতে উঠে বসার পরও তার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে। গাড়ির চালক বলে ওঠেন, ‘ম্যাডাম, ওয়ালাইকুম আসসালাম কইলে হইব না। হ্যারে ২০ টাকা দ্যান। আপনারে সালাম দিছে টাকার জন্য।’ ‘তার মানে, সালামের মূল্য ২০ টাকা!’ ‘হ।’

এমন অভিজ্ঞতা এখন রাস্তাঘাটে অহরহ। সালাম দেওয়া এবং সালামের উত্তর দেওয়াটা যে এখন টাকায় স্থান পেয়েছে, তা ধর্মপ্রাণ মানুষেরা জেনেছে কি না, জানা নেই। তবে বিশ্বাস, প্রকৃত ধার্মিকেরা এটাকে পছন্দ করবেন না, করতে পারেন না। এভাবে টাকা নেওয়াটা একধরনের চাঁদাবাজি কি না, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন—ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের প্রচলন ঘটেছে বহু আগেই।

এবার আসি নববর্ষ প্রসঙ্গে। পয়লা বৈশাখ বাংলা ও বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। বাংলা বছরের শুরুর দিন। নতুন বছরকে বরণ করা আর পুরোনো বছরকে বিদায় জানানোর অনুভূতি প্রকাশ পায় বাংলা ও বাঙালি জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে; যেখানে মিলেমিশে থাকে বাংলা সংস্কৃতির নানান রং, ঢং, আয়োজন ও ঐতিহ্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবনের জন্মের পরপরই দেখে আসছি, দিনটি ঘিরে কত আয়োজন পোশাকে ও আয়োজনে। লাল-সাদা বা বর্ণিল কাপড় পরিধানে, পান্তা-ইলিশ, ভর্তা, মুড়ি-মুড়কি, আরও কত আহারের আয়োজন, সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন—যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, পল্লিগীতি ইত্যাদি সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে কল্যাণের আহ্বান চলে। পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে সূর্যোদয়ের মুহূর্তেই শুরু হয় বছরের সূচনাসংগীত। যেখানে কল্যাণ আর মঙ্গলের প্রার্থনা করা হয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। বাংলা ও বাঙালি জাতির জীবনে পয়লা বৈশাখ নিজস্ব ভঙ্গিতে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে বলে সবার অপেক্ষা থাকে দিনটির জন্য। চিত্রকলা, পুথি, পুস্তক, সাহিত্যও থাকে এমন নানান বর্ণে, রঙে সাজানো, যার মধ্য দিয়ে বাংলা ও বাঙালি জাতির নিজস্বতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে বাংলা ও বাঙালি জাতির পরিচিতির এক অন্যতম দিবস, উৎসব। এই উৎসব ঘিরে নতুন কোনো চিন্তাচেতনা, যা বিগত দিনের বৈশিষ্ট্য ও ধারাকে ব্যাহত করে, বাধা দেয়, তা কিন্তু বাংলা ও বাঙালি বোধে যাপিত জীবনগুলো মেনে নিতে পারে না, পারেনি। কোনোভাবেই মানতে পারে না। অতীতে দেখা গেছে, পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনস্থল রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটেছে এবং সেটা ছিল এই উৎসব ও চেতনাকে নির্মূলের এক অপচেষ্টা। তার পরেও কিন্তু পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন থেকে বাঙালি জাতিকে বিরত রাখা যায়নি, সম্ভব হয়নি। আর যারা এমন নৃশংস ও ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটিয়ে বাংলা ও বাঙালির কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণের অপচেষ্টা চালিয়েছে, তারা সেই অর্থে সফল না হলেও তাদের বাংলা ও বাঙালিবিরোধী কর্মকাণ্ড কিন্তু থেমে থাকেনি। বরং কৌশল বদলেছে। এটা না বললেই নয় যে, তখন তাদের কৌশলের কারণেই পয়লা বৈশাখ আয়োজনের সময়সীমা আইন করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সময়কে বেঁধে দিয়েছে, বলে দিয়েছে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। বিধি আরোপের ফলে এই উৎসব সংকীর্ণ হয়েছে, বাঙালির প্রাণোচ্ছ্বাসের গতি কমে গেছে।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্যবিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন পান্তা-ইলিশ দিয়ে বৈশাখ উদ্‌যাপন না করতে। তিনি আরও বলেছেন, পান্তা-ইলিশ একটা আরোপিত সংস্কৃতি। ইলিশ-সংকটের কারণে তিনি ইলিশ মাছ না ধরার পরামর্শ দিতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে পান্তা-ইলিশকে আরোপিত সংস্কৃতি বলে বিবৃতি দেওয়াটা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ধারাকে বাধা দেয় কি না, সেটা তার ভাবা দরকার ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। কেউ যদি এই দিনে ইলিশ খেতে চায়, তাহলে কার ক্ষতি? না খেলেই বা কার ক্ষতি? বরং ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া থাকে কেন, কারা সিন্ডিকেট করে মাছের দাম বাড়ায়, সেদিকে দৃকপাত করতে পারতেন তিনি। আর জাটকা ধরে খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এখনো বাজারে গেলে দেড় কেজি, দুই কেজির ইলিশ দেখা যাচ্ছে। এগুলো কোথা থেকে আসছে? অনেকে তার কথায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অন্তত যাঁরা তাঁকে একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে চিনে এসেছেন দীর্ঘদিন ধরে। আরেকজন উপদেষ্টাকে বলতে শোনা গেল মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে ফেলার বিষয়ে। সম্ভবত মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আনন্দ শোভাযাত্রা হিসেবে চিন্তার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আপত্তির মুখে মঙ্গল শোভাযাত্রাই রয়ে গেছে যত দূর জানি।

পরিশেষে বলব, আমরা আসলে কোন সংস্কৃতির অভিমুখে যাত্রা করেছি বা করার কথা ভাবছি, সে বিষয়ে জনগণের একটা সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ জনগণই পারে ব্যক্তিচিন্তার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে তার দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ঐতিহ্য রক্ষা করতে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত