হুসাইন আহমদ
১৮১৮ সালের ৫ মে জার্মানির দক্ষিণের শহর ট্রিয়ারে কার্ল মার্ক্স জন্মগ্রহণ করেন। মোসেল উপত্যকার নয়নাভিরাম অঞ্চলটি ওয়াইন উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। এই শহরে তখন ছিল মাত্র ১২ হাজার মানুষের বাস। ‘যেখানে সবাই সবাইকে চেনে না, কিন্তু অনেকে অনেকের সম্পর্কে বহু কিছু জানে’—এভাবেই মার্ক্সের জন্মস্থানের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর জীবনীকার জার্গেন নেফে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রান্তিক শহরে মার্ক্সের সীমাহীন বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা বিস্ময় জাগায়। শুধু তা-ই নয়, তখনকার ইউরোপের প্রথাবিরোধী প্রধান চিন্তাবিদ প্রায় সবার সঙ্গে কার্ল মার্ক্স দেখা করেন এবং তাত্ত্বিক সম্পর্ক গড়েন। সমসাময়িক জার্মান চিন্তাবিদ উইলহেম ওয়েটলিং ও ব্রুনো বাউয়ার উল্লেখযোগ্য। ‘বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক’ হিসেবে অভিহিত ফরাসি দার্শনিক পিয়েরে-জোসেফ প্রুধোঁ ও রুশ নৈরাজ্যবাদী মিখাইল বাকুনিনও আছেন এই তালিকায়।
মার্ক্সের বাবা চেয়েছিলেন, নিজের মতোই আইনজীবী হবে ছেলে। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি, নিজের ক্যারিয়ার নিজেই খুঁজে নিয়েছেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জি ডব্লিউ এফ হেগেলের অনুমানমূলক দর্শনে ডুব দেন তিনি। কেউ বলতে পারেন, এখান থেকেই পতন শুরু। কারণ, হেগেল যুক্তিবাদী উদার রাষ্ট্র দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু তখনকার অতিরক্ষণশীল প্রুশিয়া সরকার এমন বৈপ্লবিক চিন্তার প্রতি মোটেই দয়াপরবশ ছিলেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হিসেবে মার্ক্স যে পেশা বেছে নিতে চেয়েছিলেন, পরের দশকেই তার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
দর্শন যে বিপজ্জনক, তা মার্ক্সের হেগেল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। হেগেলের দর্শনের ‘অদ্ভুত করুণ সুর’ তাঁকে শুরুতে টানেনি। কিন্তু এই সুরের প্রভাবে শিগগির তিনি বার্লিনের রাস্তায় উন্মত্ত নৃত্যে মেতে ওঠেন। ১৮৩৭ সালের নভেম্বরে বাবার কাছে লেখা চিঠিতে মার্ক্স লিখেছেন, ‘রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেক মানুষকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলাম আমি।’
মার্ক্সের ২০৬তম জন্মবার্ষিকীতে এসে তাঁর বিপজ্জনক দার্শনিক পরম্পরা থেকে কী শিক্ষা মিলল? খুব সুনির্দিষ্ট করে বললে, দীর্ঘজীবী কী অবদান রেখে গেছেন মার্ক্স?
মার্ক্সের পরম্পরা আজও ভালোভাবেই জীবিত। এই শতকে গবেষণাকর্ম থেকে শুরু করে জনপ্রিয় জীবনীমূলক অগণিত বই প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্ক্সের মতবাদ এবং নব্য উদারবাদী যুগের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
মার্ক্সকে ‘মধ্যবিত্তের দার্শনিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ফরাসি দার্শনিক আলাঁ বাদিউ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আজকের দিনে শিক্ষিত উদারবাদীরা মোটাদাগে মার্ক্সের মূল অভিসন্দর্ভের সঙ্গে একমত। আর তা হলো, পুঁজিবাদ টিকে আছে শ্রেণিবৈষম্যের মাধ্যমে, যেখানে সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণি মুনাফার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণির উদ্বৃত্ত শ্রমকে আত্মসাৎ করে, যা শতভাগ ঠিক। পুঁজিবাদে নিজেকে ধ্বংস করার প্রবণতা অন্তর্নিহিত—মার্ক্সের এই সিদ্ধান্ত যে এখনো কার্যকর, তা নরিয়েল রৌবিনির মতো উদারবাদী দার্শনিকেরাও সমর্থন করেন।
কিন্তু এই সমর্থন বেশি দূর এগোয় না। কারণ, পুঁজিবাদের রোগনির্ণয়ে মার্ক্সের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও রোগ সারানোর উপায় নিয়ে সবাই একমত নন। এখানেই দার্শনিক হিসেবে মার্ক্সের মৌলিকত্ব ও গভীরতা বিদ্যমান। পুঁজিবাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য মার্ক্স কোনো জাদুর কাঠি রেখে যাননি। কিন্তু বস্তুবাদী চিন্তার এমন হাতিয়ার দিয়ে গেছেন, যা দিয়ে পুঁজিবাদ সর্বোত্তম আদর্শ—এই দাবিকে সহজে খণ্ডন করা যায়।
মার্ক্স ও ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে লিখেছেন, ‘মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এত দিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনজীবী, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী—সবাইকে এরা মজুরিভোগী শ্রমজীবীতে পরিণত করেছে।’
পুঁজিবাদ যে নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে, সে বিষয়ে মার্ক্স নিশ্চিত ছিলেন। মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছিল, প্রযুক্তির কারণে ‘শ্রম বিভাজন’ ব্যাপক হারে বাড়বে অর্থাৎ ভিন্ন পেশার মানুষ কাজ হারাবেন। চিকিৎসায় রোগনির্ণয় ও অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আগ্রাসী ব্যবহারে মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন স্পষ্ট।
মার্ক্স কীভাবে পূর্বাপর যেকোনো দার্শনিকের চেয়ে বেশি প্রভাব অর্জন করলেন, তার উত্তর মিলবে হেগেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মধ্যে। হেগেলের দর্শন তরুণ মার্ক্সকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল। বাবার কাছে লেখা চিঠিতে তার ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু পরিণত মার্ক্স হেগেলের চিন্তাপদ্ধতি গ্রহণ করেননি।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ও জোহান গটলিয়েব ফিশটের আদর্শবাদে প্রভাবিত হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর দর্শন শুধু চিন্তার ওপর জোর দিয়েছিল। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমেই বাস্তবতা ধরা দেয়। হেগেলীয় চিন্তায় বিপরীতে তিনি বলেন, বস্তুজগৎই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
হেগেল আধুনিক রাষ্ট্রকে ঈশ্বরের ইচ্ছারূপে দেখেছেন। পৃথিবীতে স্পিরিট বা ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের পরম বাস্তবায়ন হিসেবে রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা করেন হেগেল। হেগেল যুক্তিবাদী উদাররাষ্ট্রের ধারণা দেন। মার্ক্স একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘ঈশ্বর আগে ধরিত্রীর ওপর বসবাস করে থাকলে এখন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যেহেতু ঈশ্বর আর স্বর্গীয় নয়, সেহেতু রাষ্ট্রের আর দরকার নেই।’
মার্ক্স ও এঙ্গেলস—উভয়ের সাম্যবাদী ধারণার মধ্যে শ্রেণিহীন ও রাষ্ট্রহীন সমাজের সংজ্ঞা পাওয়া যায় এবং অবশ্যই বিংশ শতাব্দীর সাম্যবাদী ‘রাষ্ট্রের’ ঝঞ্ঝাটময় ইতিহাসের মধ্যেও তার বাস্তব রূপ প্রসঙ্গে ধারণা পাওয়া যায়। সেই রাষ্ট্রগুলোর বিপর্যয় থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তবে সেগুলোর দার্শনিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সংশয় আছে।
আজকের সমাজে মার্ক্সের বুদ্ধিবৃত্তিক পরম্পরার প্রধান দিক ‘দর্শন’ নয় বরং ‘ক্রিটিক’ বা পর্যালোচনা, যেটাকে তিনি ‘অস্তিত্বশীল যেকোনো কিছুর নির্মম সমালোচনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘নির্মম দুই অর্থেই হতে পারে—সমালোচনার ফলাফল যা-ই হোক, তাতে ভয় না পাওয়া অথবা ক্ষমতার সঙ্গে কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে ভয় না পাওয়া’। ১৮৪৫ সালে তিনি লেখেন, ‘দার্শনিকেরা নানাভাবে কেবল বিশ্বকে ব্যাখ্যাই করেছেন, আসল বিষয় হলো বিশ্বকে পরিবর্তন করা।’
সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শ্রেণিশোষণের অবসানের লড়াই জরুরি। আর সেই লড়াইয়ে বর্ণবাদ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই শতকের আন্দোলন মার্ক্সের কাছে ঋণী। মার্ক্সের মতোই এসব আন্দোলন জোর গলায় বলছে, সমাজ প্রভাবশালী সব ধারণাই শাসকশ্রেণির তৈরি। প্রকৃত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মৌলিক শর্ত হচ্ছে সেই সব ধারণার মূলোৎপাটন করা।
‘সমাজ পরিবর্তনের আগে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে’—হরহামেশা এই মন্ত্রে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু আলোকিত হওয়া বা যৌক্তিক চিন্তাই যথেষ্ট নয়। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী স্তরায়িত সমাজে এই চিন্তার চর্চা দিগ্ভ্রান্ত। এমনকি যে ভাষা আমরা ব্যবহার করি, তার ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। কাজেই চিন্তার চর্চা পরিবর্তনের জন্য সমাজের মূল ভিত্তির পরিবর্তন জরুরি।
মার্ক্স যথার্থই বলেছেন, ‘পর্যাপ্ত উৎপাদন শক্তির বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সামাজিক কাঠামো কখনোই ধ্বংস হবে না এবং পুরোনো সমাজের রূপরেখার মধ্যে পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের চূড়ান্ত বিকাশের বস্তুগত পরিবেশ তৈরি না হলে নতুন উন্নততর উৎপাদন সম্পর্ক তার জায়গা দখল করতে পারবে না।’
পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ পুঁজির সম্পর্কে তথা মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে আবদ্ধ। সেই সমাজ মানুষের সম্পর্কে রূপান্তর না হলে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিন্তু রূপান্তরের জন্য সাধারণ কোনো সমাধান দিয়ে যাননি কার্ল মার্ক্স। তবে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাসিড টেস্টের ফর্মুলা দিয়েছেন তিনি। যে ধরনের সমাজের জন্য তিনি লড়াই করেছেন এবং যে ধরনের সমাজের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ বাড়ছে, তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে থাকবে। শুধু তা-ই নয়, কার্ল মার্ক্সের ধারণা ও তত্ত্ব নিয়েও তত দিন পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকবে।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৮১৮ সালের ৫ মে জার্মানির দক্ষিণের শহর ট্রিয়ারে কার্ল মার্ক্স জন্মগ্রহণ করেন। মোসেল উপত্যকার নয়নাভিরাম অঞ্চলটি ওয়াইন উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। এই শহরে তখন ছিল মাত্র ১২ হাজার মানুষের বাস। ‘যেখানে সবাই সবাইকে চেনে না, কিন্তু অনেকে অনেকের সম্পর্কে বহু কিছু জানে’—এভাবেই মার্ক্সের জন্মস্থানের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর জীবনীকার জার্গেন নেফে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রান্তিক শহরে মার্ক্সের সীমাহীন বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা বিস্ময় জাগায়। শুধু তা-ই নয়, তখনকার ইউরোপের প্রথাবিরোধী প্রধান চিন্তাবিদ প্রায় সবার সঙ্গে কার্ল মার্ক্স দেখা করেন এবং তাত্ত্বিক সম্পর্ক গড়েন। সমসাময়িক জার্মান চিন্তাবিদ উইলহেম ওয়েটলিং ও ব্রুনো বাউয়ার উল্লেখযোগ্য। ‘বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক’ হিসেবে অভিহিত ফরাসি দার্শনিক পিয়েরে-জোসেফ প্রুধোঁ ও রুশ নৈরাজ্যবাদী মিখাইল বাকুনিনও আছেন এই তালিকায়।
মার্ক্সের বাবা চেয়েছিলেন, নিজের মতোই আইনজীবী হবে ছেলে। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি, নিজের ক্যারিয়ার নিজেই খুঁজে নিয়েছেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জি ডব্লিউ এফ হেগেলের অনুমানমূলক দর্শনে ডুব দেন তিনি। কেউ বলতে পারেন, এখান থেকেই পতন শুরু। কারণ, হেগেল যুক্তিবাদী উদার রাষ্ট্র দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু তখনকার অতিরক্ষণশীল প্রুশিয়া সরকার এমন বৈপ্লবিক চিন্তার প্রতি মোটেই দয়াপরবশ ছিলেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হিসেবে মার্ক্স যে পেশা বেছে নিতে চেয়েছিলেন, পরের দশকেই তার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
দর্শন যে বিপজ্জনক, তা মার্ক্সের হেগেল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। হেগেলের দর্শনের ‘অদ্ভুত করুণ সুর’ তাঁকে শুরুতে টানেনি। কিন্তু এই সুরের প্রভাবে শিগগির তিনি বার্লিনের রাস্তায় উন্মত্ত নৃত্যে মেতে ওঠেন। ১৮৩৭ সালের নভেম্বরে বাবার কাছে লেখা চিঠিতে মার্ক্স লিখেছেন, ‘রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেক মানুষকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলাম আমি।’
মার্ক্সের ২০৬তম জন্মবার্ষিকীতে এসে তাঁর বিপজ্জনক দার্শনিক পরম্পরা থেকে কী শিক্ষা মিলল? খুব সুনির্দিষ্ট করে বললে, দীর্ঘজীবী কী অবদান রেখে গেছেন মার্ক্স?
মার্ক্সের পরম্পরা আজও ভালোভাবেই জীবিত। এই শতকে গবেষণাকর্ম থেকে শুরু করে জনপ্রিয় জীবনীমূলক অগণিত বই প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্ক্সের মতবাদ এবং নব্য উদারবাদী যুগের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
মার্ক্সকে ‘মধ্যবিত্তের দার্শনিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ফরাসি দার্শনিক আলাঁ বাদিউ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আজকের দিনে শিক্ষিত উদারবাদীরা মোটাদাগে মার্ক্সের মূল অভিসন্দর্ভের সঙ্গে একমত। আর তা হলো, পুঁজিবাদ টিকে আছে শ্রেণিবৈষম্যের মাধ্যমে, যেখানে সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণি মুনাফার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণির উদ্বৃত্ত শ্রমকে আত্মসাৎ করে, যা শতভাগ ঠিক। পুঁজিবাদে নিজেকে ধ্বংস করার প্রবণতা অন্তর্নিহিত—মার্ক্সের এই সিদ্ধান্ত যে এখনো কার্যকর, তা নরিয়েল রৌবিনির মতো উদারবাদী দার্শনিকেরাও সমর্থন করেন।
কিন্তু এই সমর্থন বেশি দূর এগোয় না। কারণ, পুঁজিবাদের রোগনির্ণয়ে মার্ক্সের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও রোগ সারানোর উপায় নিয়ে সবাই একমত নন। এখানেই দার্শনিক হিসেবে মার্ক্সের মৌলিকত্ব ও গভীরতা বিদ্যমান। পুঁজিবাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য মার্ক্স কোনো জাদুর কাঠি রেখে যাননি। কিন্তু বস্তুবাদী চিন্তার এমন হাতিয়ার দিয়ে গেছেন, যা দিয়ে পুঁজিবাদ সর্বোত্তম আদর্শ—এই দাবিকে সহজে খণ্ডন করা যায়।
মার্ক্স ও ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে লিখেছেন, ‘মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এত দিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনজীবী, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী—সবাইকে এরা মজুরিভোগী শ্রমজীবীতে পরিণত করেছে।’
পুঁজিবাদ যে নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে, সে বিষয়ে মার্ক্স নিশ্চিত ছিলেন। মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছিল, প্রযুক্তির কারণে ‘শ্রম বিভাজন’ ব্যাপক হারে বাড়বে অর্থাৎ ভিন্ন পেশার মানুষ কাজ হারাবেন। চিকিৎসায় রোগনির্ণয় ও অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আগ্রাসী ব্যবহারে মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন স্পষ্ট।
মার্ক্স কীভাবে পূর্বাপর যেকোনো দার্শনিকের চেয়ে বেশি প্রভাব অর্জন করলেন, তার উত্তর মিলবে হেগেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মধ্যে। হেগেলের দর্শন তরুণ মার্ক্সকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল। বাবার কাছে লেখা চিঠিতে তার ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু পরিণত মার্ক্স হেগেলের চিন্তাপদ্ধতি গ্রহণ করেননি।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ও জোহান গটলিয়েব ফিশটের আদর্শবাদে প্রভাবিত হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর দর্শন শুধু চিন্তার ওপর জোর দিয়েছিল। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমেই বাস্তবতা ধরা দেয়। হেগেলীয় চিন্তায় বিপরীতে তিনি বলেন, বস্তুজগৎই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
হেগেল আধুনিক রাষ্ট্রকে ঈশ্বরের ইচ্ছারূপে দেখেছেন। পৃথিবীতে স্পিরিট বা ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের পরম বাস্তবায়ন হিসেবে রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা করেন হেগেল। হেগেল যুক্তিবাদী উদাররাষ্ট্রের ধারণা দেন। মার্ক্স একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘ঈশ্বর আগে ধরিত্রীর ওপর বসবাস করে থাকলে এখন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যেহেতু ঈশ্বর আর স্বর্গীয় নয়, সেহেতু রাষ্ট্রের আর দরকার নেই।’
মার্ক্স ও এঙ্গেলস—উভয়ের সাম্যবাদী ধারণার মধ্যে শ্রেণিহীন ও রাষ্ট্রহীন সমাজের সংজ্ঞা পাওয়া যায় এবং অবশ্যই বিংশ শতাব্দীর সাম্যবাদী ‘রাষ্ট্রের’ ঝঞ্ঝাটময় ইতিহাসের মধ্যেও তার বাস্তব রূপ প্রসঙ্গে ধারণা পাওয়া যায়। সেই রাষ্ট্রগুলোর বিপর্যয় থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তবে সেগুলোর দার্শনিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সংশয় আছে।
আজকের সমাজে মার্ক্সের বুদ্ধিবৃত্তিক পরম্পরার প্রধান দিক ‘দর্শন’ নয় বরং ‘ক্রিটিক’ বা পর্যালোচনা, যেটাকে তিনি ‘অস্তিত্বশীল যেকোনো কিছুর নির্মম সমালোচনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘নির্মম দুই অর্থেই হতে পারে—সমালোচনার ফলাফল যা-ই হোক, তাতে ভয় না পাওয়া অথবা ক্ষমতার সঙ্গে কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে ভয় না পাওয়া’। ১৮৪৫ সালে তিনি লেখেন, ‘দার্শনিকেরা নানাভাবে কেবল বিশ্বকে ব্যাখ্যাই করেছেন, আসল বিষয় হলো বিশ্বকে পরিবর্তন করা।’
সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শ্রেণিশোষণের অবসানের লড়াই জরুরি। আর সেই লড়াইয়ে বর্ণবাদ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই শতকের আন্দোলন মার্ক্সের কাছে ঋণী। মার্ক্সের মতোই এসব আন্দোলন জোর গলায় বলছে, সমাজ প্রভাবশালী সব ধারণাই শাসকশ্রেণির তৈরি। প্রকৃত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মৌলিক শর্ত হচ্ছে সেই সব ধারণার মূলোৎপাটন করা।
‘সমাজ পরিবর্তনের আগে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে’—হরহামেশা এই মন্ত্রে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু আলোকিত হওয়া বা যৌক্তিক চিন্তাই যথেষ্ট নয়। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী স্তরায়িত সমাজে এই চিন্তার চর্চা দিগ্ভ্রান্ত। এমনকি যে ভাষা আমরা ব্যবহার করি, তার ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। কাজেই চিন্তার চর্চা পরিবর্তনের জন্য সমাজের মূল ভিত্তির পরিবর্তন জরুরি।
মার্ক্স যথার্থই বলেছেন, ‘পর্যাপ্ত উৎপাদন শক্তির বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সামাজিক কাঠামো কখনোই ধ্বংস হবে না এবং পুরোনো সমাজের রূপরেখার মধ্যে পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের চূড়ান্ত বিকাশের বস্তুগত পরিবেশ তৈরি না হলে নতুন উন্নততর উৎপাদন সম্পর্ক তার জায়গা দখল করতে পারবে না।’
পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ পুঁজির সম্পর্কে তথা মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে আবদ্ধ। সেই সমাজ মানুষের সম্পর্কে রূপান্তর না হলে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিন্তু রূপান্তরের জন্য সাধারণ কোনো সমাধান দিয়ে যাননি কার্ল মার্ক্স। তবে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাসিড টেস্টের ফর্মুলা দিয়েছেন তিনি। যে ধরনের সমাজের জন্য তিনি লড়াই করেছেন এবং যে ধরনের সমাজের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ বাড়ছে, তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে থাকবে। শুধু তা-ই নয়, কার্ল মার্ক্সের ধারণা ও তত্ত্ব নিয়েও তত দিন পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকবে।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমার যখন জন্ম হয়, সেই বছরই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেছেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ক্ষুব্ধ স্বদেশ তখন আন্দোলনে ফেটে পড়েছিল। তৃণমূল থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল।
২০ ঘণ্টা আগে১৬ নভেম্বর কতগুলো ভারতীয় মিডিয়া একযোগে খবর ছেপেছে, ‘ইন্ডিয়ান আমেরিকানস টু আর্জ ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফর স্যাংশন অ্যাগেইনস্ট বাংলাদেশ’। অর্থাৎ ভারতীয় আমেরিকানরা ট্রাম্প প্রশাসনকে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানাবেন।
২০ ঘণ্টা আগেসরকার পরিবর্তনের ঘটনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কিছু প্রতারক চক্র দুস্থ, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
২০ ঘণ্টা আগেযেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
২ দিন আগে