সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক বিভাজন। আমাদের দেশের রাজনীতি আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি অনেক সময় বিভাজন ও মতবিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিজয়ের মাসে আমরা কি শপথ নিতে পারি না যে আমরা আর কোনোভাবেই বিভাজনের হাতিয়ার হব না! ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি হবে আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি।
বিভুরঞ্জন সরকার
ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ বাঙালির ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণা করে। এই দিনটি শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার নয়, একটি জাতির আত্মমর্যাদা, সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক।
স্বাধীনতা কখনোই কারও দানের বিষয় ছিল না; এটি বাঙালির সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও রক্ত দিয়ে কেনা। একাত্তর একটি জাতিকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা ও সাম্প্রদায়িকতা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর শিকড় গেড়ে বসেছে। ফলে নতুন কোনো পরিবর্তন বা আন্দোলনের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলা কি একাত্তরকে খাটো করে না?
একাত্তর শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি সংবিধানের ভিত্তি হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই আদর্শগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ক্রমেই ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজও আর্থিক বৈষম্যের শিকার। শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার মানে পার্থক্য বেড়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতান্ত্রিকতা আমাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।
আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দেখেছি, দেখেছি একটি স্বাধীন জাতির জন্মের আনন্দ, অমিত সম্ভাবনা এবং একই সঙ্গে তার জটিল পথচলার পরবর্তী অধ্যায়গুলোও আমার অদেখা নয়। বিজয়ের মধুর স্বাদ শুধু অতীতেই সীমাবদ্ধ নয়, পরবর্তী বছরগুলোতেও নানা উত্থান-পতনের মাঝে আমরা সংগ্রাম করেছি নতুন বিজয় অর্জনের জন্য। একই সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদও আমাদের ছুঁয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি ও ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের চিত্র আমাদের অদেখা নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বিজয় হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাগুলো তো চোখের সামনেই দেখা।
গণতন্ত্রহীনতা ও বৈষম্যের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থানও আমাদের স্বাধীনতার অর্জনকে মলিন করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার যে প্রতিশ্রুতি সংবিধান দিয়েছিল, তা বারবার ভঙ্গ হয়েছে। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা হয়েছে, যা কেবল সংখ্যালঘুদের অধিকার নয়, গোটা সমাজের ঐক্য ও সহাবস্থানের ওপর আঘাত হেনেছে।
বিজয়ের এই মাসে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, এই বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান কীভাবে ঘটবে। প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা দলের কাছে কেন্দ্রীভূত না রেখে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে স্বচ্ছ নির্বাচন, কার্যকর সংসদ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, আর্থিক বৈষম্য দূর করতে কল্যাণমূলক অর্থনীতি অনুসরণের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা ছাড়া সমাজের বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে মুক্ত হতে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিজয়ের মাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দেয় যে কোনো পরিবর্তনই সহজে আসে না। আত্মত্যাগ, সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে একটি জাতি তার লক্ষ্যে পৌঁছায়। আজ আমাদের আবারও সেই বিশ্বাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। একাত্তর ছিল আমাদের প্রথম স্বাধীনতা, যা আমাদের পরিচিতি দিয়েছে। এখন প্রয়োজন সেই স্বাধীনতার প্রকৃত মানে বাস্তবায়ন করে একটি সাম্য, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন করা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে আত্মত্যাগ, সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তবে বিজয়ের ৫৩ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সমাজে একেকজনের কাছে ইতিহাসের একেক রকম ব্যাখ্যা রয়েছে, যা জাতিকে বিভক্ত করছে। নতুন প্রজন্মের এই বিভ্রান্তি দূর করার উপায় নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
সঠিক ইতিহাস সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রথমত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় বৃত্ত ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক ধারার বাইরে আনতে হবে। ইতিহাস কোনো দল বা ব্যক্তির একক সম্পত্তি নয়; এটি জাতির সম্পদ। ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার পটভূমি এক দিনে তৈরি হয়নি। কোনো একজনের হাত ধরেও ইতিহাস এগিয়ে যায়নি। আবার এটাও ঠিক যে অনেক চরিত্র থাকলেও সব কাহিনিতেই একজন প্রধান চরিত্র বা নায়ক অবশ্যই থাকে। অনেক মানুষের ছোট-বড় অনেক অবদান থাকলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ‘নায়কোচিত’।
সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি, নায়ক ও ত্যাগের সত্যতা নির্মোহভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী একাডেমিক উদ্যোগ, যেখানে গবেষণালব্ধ প্রমাণ ও তথ্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করা। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে এমন একটি ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভক্তি নয়, বরং একতাবোধ তৈরি করবে।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু সৃজনশীল কাজ হয়েছে, তবে সেগুলোর মাধ্যমে কখনো কখনো দলীয় প্রচারণা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এই ক্ষেত্রে শিল্পী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা নিশ্চিত করা। সৃজনশীল কাজ কেবল বিনোদন নয়; এটি সমাজে সচেতনতা সৃষ্টিরও একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
তবে সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক বিভাজন। আমাদের দেশের রাজনীতি আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি অনেক সময় বিভাজন ও মতবিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিজয়ের মাসে আমরা কি শপথ নিতে পারি না যে আমরা আর কোনোভাবেই বিভাজনের হাতিয়ার হব না! ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি হবে আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। দলমত-নির্বিশেষে সব পক্ষকে একত্রে কাজ করতে হবে, যেন জাতি এই ইতিহাসকে গর্বের সঙ্গে বহন করতে পারে।
এই প্রশ্নও আমাদের সামনে আনতে হবে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্বাধীনতার প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা কি সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি? দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজব্যবস্থায় আইনের শাসনের অভাব একটি বড় ঘাটতি। বিজয়ের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে এসব অসামঞ্জস্য দূর করতে হবে।
নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া আজ সময়ের দাবি। আজকের তরুণদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত নয়। তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক করতে হবে। শুধু বই পড়িয়ে নয়, প্রযুক্তি ও আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে ধরতে হবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, গেম, ডকুমেন্টারি এবং ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা যেতে পারে, যাতে তারা এই ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
বিজয়ের মাস আমাদের শুধু উদ্যাপনের সুযোগ নয়, এটি আত্মবিশ্লেষণেরও সময়। জাতি হিসেবে আমাদের কোথায় উন্নতি হয়েছে এবং কোথায় পিছিয়ে আছি, তা বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের শপথ নিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলার। বিজয়ের ৫৩ বছর পর আমরা যে অর্জনগুলো করেছি, তা যেমন উদ্যাপন করব, তেমনি যা করতে ব্যর্থ হয়েছি, তার দায় স্বীকার করতেও পিছপা হব না। মুক্তিযুদ্ধ তখনই প্রকৃত অর্থে সফল হবে, যখন আমরা আমাদের দেশকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পারব, যেখানে সব নাগরিক সমান মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগ উপভোগ করবে। বিজয়ের চেতনা আমাদের জন্য শুধু অতীতের গর্ব নয়, এটি ভবিষ্যতের পথচলারও প্রেরণা।
বিজয় ও পরাজয় বারবার আমাদের পথচলায় এসেছে। তবে আমাদের জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রতিবার নতুনভাবে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। আমি আশাবাদী, আমাদের আগামী দিনগুলো হবে সত্যিকারের বিজয়ের, যেখানে একটি ন্যায্য, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হবে।
লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার
জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ বাঙালির ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণা করে। এই দিনটি শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার নয়, একটি জাতির আত্মমর্যাদা, সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক।
স্বাধীনতা কখনোই কারও দানের বিষয় ছিল না; এটি বাঙালির সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও রক্ত দিয়ে কেনা। একাত্তর একটি জাতিকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা ও সাম্প্রদায়িকতা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর শিকড় গেড়ে বসেছে। ফলে নতুন কোনো পরিবর্তন বা আন্দোলনের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলা কি একাত্তরকে খাটো করে না?
একাত্তর শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি সংবিধানের ভিত্তি হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই আদর্শগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ক্রমেই ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজও আর্থিক বৈষম্যের শিকার। শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার মানে পার্থক্য বেড়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতান্ত্রিকতা আমাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।
আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দেখেছি, দেখেছি একটি স্বাধীন জাতির জন্মের আনন্দ, অমিত সম্ভাবনা এবং একই সঙ্গে তার জটিল পথচলার পরবর্তী অধ্যায়গুলোও আমার অদেখা নয়। বিজয়ের মধুর স্বাদ শুধু অতীতেই সীমাবদ্ধ নয়, পরবর্তী বছরগুলোতেও নানা উত্থান-পতনের মাঝে আমরা সংগ্রাম করেছি নতুন বিজয় অর্জনের জন্য। একই সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদও আমাদের ছুঁয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি ও ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের চিত্র আমাদের অদেখা নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বিজয় হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাগুলো তো চোখের সামনেই দেখা।
গণতন্ত্রহীনতা ও বৈষম্যের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থানও আমাদের স্বাধীনতার অর্জনকে মলিন করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার যে প্রতিশ্রুতি সংবিধান দিয়েছিল, তা বারবার ভঙ্গ হয়েছে। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা হয়েছে, যা কেবল সংখ্যালঘুদের অধিকার নয়, গোটা সমাজের ঐক্য ও সহাবস্থানের ওপর আঘাত হেনেছে।
বিজয়ের এই মাসে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, এই বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান কীভাবে ঘটবে। প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা দলের কাছে কেন্দ্রীভূত না রেখে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে স্বচ্ছ নির্বাচন, কার্যকর সংসদ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, আর্থিক বৈষম্য দূর করতে কল্যাণমূলক অর্থনীতি অনুসরণের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা ছাড়া সমাজের বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে মুক্ত হতে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিজয়ের মাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দেয় যে কোনো পরিবর্তনই সহজে আসে না। আত্মত্যাগ, সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে একটি জাতি তার লক্ষ্যে পৌঁছায়। আজ আমাদের আবারও সেই বিশ্বাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। একাত্তর ছিল আমাদের প্রথম স্বাধীনতা, যা আমাদের পরিচিতি দিয়েছে। এখন প্রয়োজন সেই স্বাধীনতার প্রকৃত মানে বাস্তবায়ন করে একটি সাম্য, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন করা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে আত্মত্যাগ, সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তবে বিজয়ের ৫৩ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সমাজে একেকজনের কাছে ইতিহাসের একেক রকম ব্যাখ্যা রয়েছে, যা জাতিকে বিভক্ত করছে। নতুন প্রজন্মের এই বিভ্রান্তি দূর করার উপায় নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
সঠিক ইতিহাস সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রথমত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় বৃত্ত ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক ধারার বাইরে আনতে হবে। ইতিহাস কোনো দল বা ব্যক্তির একক সম্পত্তি নয়; এটি জাতির সম্পদ। ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার পটভূমি এক দিনে তৈরি হয়নি। কোনো একজনের হাত ধরেও ইতিহাস এগিয়ে যায়নি। আবার এটাও ঠিক যে অনেক চরিত্র থাকলেও সব কাহিনিতেই একজন প্রধান চরিত্র বা নায়ক অবশ্যই থাকে। অনেক মানুষের ছোট-বড় অনেক অবদান থাকলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ‘নায়কোচিত’।
সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি, নায়ক ও ত্যাগের সত্যতা নির্মোহভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী একাডেমিক উদ্যোগ, যেখানে গবেষণালব্ধ প্রমাণ ও তথ্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করা। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে এমন একটি ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভক্তি নয়, বরং একতাবোধ তৈরি করবে।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু সৃজনশীল কাজ হয়েছে, তবে সেগুলোর মাধ্যমে কখনো কখনো দলীয় প্রচারণা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এই ক্ষেত্রে শিল্পী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা নিশ্চিত করা। সৃজনশীল কাজ কেবল বিনোদন নয়; এটি সমাজে সচেতনতা সৃষ্টিরও একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
তবে সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক বিভাজন। আমাদের দেশের রাজনীতি আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি অনেক সময় বিভাজন ও মতবিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিজয়ের মাসে আমরা কি শপথ নিতে পারি না যে আমরা আর কোনোভাবেই বিভাজনের হাতিয়ার হব না! ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি হবে আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। দলমত-নির্বিশেষে সব পক্ষকে একত্রে কাজ করতে হবে, যেন জাতি এই ইতিহাসকে গর্বের সঙ্গে বহন করতে পারে।
এই প্রশ্নও আমাদের সামনে আনতে হবে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্বাধীনতার প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা কি সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি? দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজব্যবস্থায় আইনের শাসনের অভাব একটি বড় ঘাটতি। বিজয়ের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে এসব অসামঞ্জস্য দূর করতে হবে।
নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া আজ সময়ের দাবি। আজকের তরুণদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত নয়। তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক করতে হবে। শুধু বই পড়িয়ে নয়, প্রযুক্তি ও আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে ধরতে হবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, গেম, ডকুমেন্টারি এবং ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা যেতে পারে, যাতে তারা এই ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
বিজয়ের মাস আমাদের শুধু উদ্যাপনের সুযোগ নয়, এটি আত্মবিশ্লেষণেরও সময়। জাতি হিসেবে আমাদের কোথায় উন্নতি হয়েছে এবং কোথায় পিছিয়ে আছি, তা বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের শপথ নিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলার। বিজয়ের ৫৩ বছর পর আমরা যে অর্জনগুলো করেছি, তা যেমন উদ্যাপন করব, তেমনি যা করতে ব্যর্থ হয়েছি, তার দায় স্বীকার করতেও পিছপা হব না। মুক্তিযুদ্ধ তখনই প্রকৃত অর্থে সফল হবে, যখন আমরা আমাদের দেশকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পারব, যেখানে সব নাগরিক সমান মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগ উপভোগ করবে। বিজয়ের চেতনা আমাদের জন্য শুধু অতীতের গর্ব নয়, এটি ভবিষ্যতের পথচলারও প্রেরণা।
বিজয় ও পরাজয় বারবার আমাদের পথচলায় এসেছে। তবে আমাদের জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রতিবার নতুনভাবে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। আমি আশাবাদী, আমাদের আগামী দিনগুলো হবে সত্যিকারের বিজয়ের, যেখানে একটি ন্যায্য, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হবে।
লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার
জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থকদের ‘ডু অর ডাই’ (করব অথবা মরব) শীর্ষক বিক্ষোভ সমাবেশের আগের কথা। গত ২২ নভেম্বর একটি বিরল ভিডিও বার্তা দিলেন পিটিআই-প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি।
১ দিন আগেঅন্ধ অনুসরণে ব্যস্ত ভেতো বাঙালির বুঝতে বুঝতে আজও বড্ড সময় লেগে যায়। মজ্জাগত এই স্বভাব যে আমাদের ভীষণ প্রবল, ‘তোরা পথের ধারে ব্যথা নিয়ে করিস ঘাঁটাঘাঁটি— কেবল করিস ঘাঁটাঘাঁটি।।’
১ দিন আগেক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বালু লুটের হাতবদল হয়েছে মাত্র। আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জেলার প্রভাবশালী নেতারা ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী থেকে বালু তুলতেন। এখন তাঁদের আত্মগোপনের সুযোগে বিএনপির স্থানীয় একটি অংশের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে একইভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায়
১ দিন আগেরাষ্ট্র সংস্কারের কথা প্রথম জোরেশোরে উঠেছিল ওয়ান-ইলেভেনে। তবে অনেক কসরত করেও তখনকার সরকার কোনো অর্থবহ সংস্কার করতে পারেনি। একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়েই তাদের বিদায় নিতে হয় প্রায় দুই বছর পর। অতঃপর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ চালিয়ে গত আগস্টে বিদায় নিয়েছে নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত
২ দিন আগে