সৌমিত জয়দ্বীপ
পদ্মা, প্রমত্তা পদ্মা! তার ওপরে সেতু। একটা বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও এ অর্জন মহীয়ান! জাতীয়তাবাদী যে মন জাদুটোনার মিথ ও ট্যাবুতে অভ্যস্ত, তার জন্য প্রকৃত ও বাস্তবিক জাতীয়তাবাদী হওয়ার এটাই উৎকৃষ্ট সময়!
কিন্তু জাতীয়তাবাদী হওয়ার প্রকৃত সংকট হলো বয়ানের অতিরঞ্জন। এবং সেই অসততারই জয় হয় জাতীয়তাবাদী চেতনার গা-জোরিতে। জাতীয়তাবাদের ক্ষমতা না হলেও চলে, সংখ্যা আর অনুভূতিই তার ক্ষমতা। উদাহরণ খুঁজে পাবেন ভূরিভূরি।
২.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আরও একবার হাতে নিন। দেখবেন লেখা আছে, দেশভাগের আগে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসেছিলেন মাত্র দু-একবার (পৃ.৮৩)। ১৯৪৭ সালের আগে তাঁর পুরোটা রাজনৈতিক অর্জনের কোলজুড়ে আছে কলকাতা।
অবিভক্ত বঙ্গ তথা ভারতের সবচেয়ে বড় বাঙালি জননায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঢাকায় এসেছিলেন পাঁচবার, ১৯২৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে। প্রতিবারই নানাভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৫ বছরে মাত্র পাঁচবার আসতে পেরেছিলেন বাংলার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরে, এ সংখ্যাটা কমই বৈকি!
সুভাষ ও মুজিব—উভয়েই দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। কলকাতা ছিল তাঁদের রাজনীতির প্রাণভ্রমর। ফলে, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের হাইনেটওয়ার্ক তখন খুব অত্যাবশ্যক ছিল না। সেই দাবিও সামনে হাজির ছিল না।
কলকাতার অবস্থানটাও ভৌগোলিকভাবে চমকপ্রদ। একদিকে সে গঙ্গার তীরে (হুগলি নদী) জন্মেছে। আরেক দিকে এই গঙ্গাই যখন পদ্মা হয়েছে পূর্ববঙ্গে ঢুকে, তখন দেখা যাচ্ছে কলকাতা আসলে দক্ষিণবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ‘রিভারলক’ হওয়ার কারণে। তখনকার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা থেকে শুরু করে বরিশাল-খুলনা-যশোর হয়ে কলকাতা ছিল দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ‘হরিহর’ মহানগর।
এই যে ফরিদপুরের মানুষ তখন এত কাছে থাকার পরও ঢাকামুখী না হয়ে কলকাতামুখী হয়েছিলেন, তার বড় কারণ ছিল প্রমত্তা পদ্মা। দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের প্রধান অন্তরায় ছিল এই পদ্মা, বহু বহু বছর। তার মানে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার কোনো সড়ক বা রেল যোগাযোগ ছিল না। এটা প্রণিধানযোগ্য বিষয়।
৩.
অন্যদিকে সমগ্র ভারতবর্ষের সাপেক্ষে কলকাতার দশাও ছিল ঢাকারই মতো। গঙ্গা কলকাতার বুকে নাম নিয়েছে হুগলি। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে কলকাতা, পশ্চিম তীরে কলকাতার টুইন সিস্টার হাওড়া। এই হাওড়ার সঙ্গে সমগ্র ভারতবর্ষের রেল-সংযোগ সেই ১৮৫৪ সাল থেকে। হাওড়া রেলওয়ে জংশন ভারতবর্ষের একটা ‘মিথিক্যাল সুপারপাওয়ার’-এর মতো। সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে ব্যস্ত ও সবচেয়ে বড়।
কলকাতার গোড়াপত্তন যেহেতু বহু আগেই হয়ে গিয়েছিল কুঠিসাহেব জব চার্নকের হাত ধরে, সেহেতু কলকাতাকে সড়কপথে সংযুক্ত করার নির্বিবাদ প্রয়োজন ছিল। হুগলির পশ্চিম তীরে হাওড়ার উত্থানের মূলে ছিল সমগ্র উত্তর ও পশ্চিম ভারতবর্ষকে মহানগর কলকাতার সন্নিকটে পৌঁছে দেওয়া। হাওড়া এ চাহিদা আজও মেটাচ্ছে। এই সড়ক-সংযোগের জরুরতের কারণে, বহু বিলম্বে হলেও, কলকাতাকে সড়কপথে ভারতবর্ষের সিংহভাগ ভূমির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ১৯৪২ সালে ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল আরেক আশ্চর্য স্থাপনা ‘হাওড়া ব্রিজ’ (রবীন্দ্র সেতু)।
৪.
যেকোনো সেতুর এই ভূমি-যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে সেই কাজটি করল। জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির কচকচানির বাইরে পদ্মা সেতুর এই ভূমিকাটিই তার প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতাশক্তিকে বাড়াবে।
কতটা বদলে দেবে মানুষের জীবনযাপন এ সেতু? নানা ধরনের গবেষণা ও গবেষণা-ফল বাজারে হাজির আছে। সেসব ডেটার সত্যাসত্য নিশ্চয়ই একদিন যাচাই হবে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, প্রমত্তা পদ্মার জলে ভেসে যে মানুষ নানা চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে গমনাগমন করেছে, তার কাছে এই পথ-সংযোগ একটা আবেগেরই আস্ফালন।
দক্ষিণবঙ্গের চেহারা বদলাবে কি না, বদলালে কতটা—সেটা অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু ঢাকা হয়ে প্রকারান্তরে সমগ্র দেশের সঙ্গে এই যোগাযোগ মানুষের যাতায়াতের সময়কে যে কমিয়ে আনবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে—তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট না হলেও চলে।
৫.
অন্যদিকে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে নৌপথের যে বিকাশ ও উন্নয়ন প্রয়োজন, সেদিকেও আরও মনোযোগ দেওয়ার যে দাবি এই মুহূর্তে উঠেছে, সেটাও অযৌক্তিক নয়। বরং বাস্তবসম্মত। খোদ ঢাকার চারপাশেই যে পরিমাণ জলপথ আছে, সেগুলোকে কার্যকর করা প্রয়োজন। কলকাতা-হাওড়ার বুকে চিরে চলা স্বচ্ছতোয়া হুগলি নদীর ওপর যে পরিমাণ লঞ্চ ও জাহাজ দেখেছি শুধু বাণিজ্যের খাতিরেই, মনে পড়ে না, অধিকতর প্রমত্তা হওয়ার পরও পদ্মা কিংবা ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপর তা দেখেছি। বরং, ঢাকার চারপাশের নদীনালা দেখি দখলদারদের হাতে খাবি খাচ্ছে। রাজনীতির প্রশ্রয় না থাকলে এসব করা সম্ভব? অথচ, আজও পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম জলপথ।
আবার, মেট্রোরেলের আগমন যে ঢাকার যানজট কমাতে পারবে না, সেটাও বিশেষজ্ঞরা বলে দিয়েছেন। সঙ্গে আরেকটি সত্য উপেক্ষা করার জো নেই, পদ্মা সেতুর কারণে এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে যানজটের নগর ঢাকা। পদ্মাযোগ এখন ঢাকার চাপ আরও বাড়াল। বিপুল পরিমাণ মানুষ ও যানবাহন ঢাকা শহরে ঢুকবে। সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সময়ের কাছে সেই দাবি তোলা থাকল।
যদিও নতুন বিভাগ হয়ে যাওয়ায় ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষকে প্রশাসনিক কাজে আগামীতে আর ঢাকায় আসতে হবে না, সেটা একটা বাস্তবতা। আসল কথা হলো, রাজধানী হিসেবে ঢাকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় ঢাকার ওপর অনন্ত যে চাপ, তা বেড়েই চলেছে। ঢাকার কোনো বিকল্প যে আমরা এত বছরেও গড়ে তুলতে পারিনি, এ সত্য কে এড়িয়ে যাবে? জনঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে প্রাদেশিক শাসন জরুরি ছিল, এ সত্যও কি এড়ানো যাবে?
তাই বলে পদ্মা সেতুর এই আগমন বুমেরাং হয়ে যেতে পারে না। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে আনন্দের ও উৎসবের বিষয়। এই আনন্দ-উৎসব যে শুধু একটা ২৫ জুনেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, তা নয়। এ এক চির-আনন্দের বিষয়। দক্ষিণবঙ্গের জন্য তো বটেই, সমগ্র বাংলাদেশের জন্যও।
এমনকি দেখতে পাচ্ছি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পদ্মা সেতু নিয়ে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা ব্যাপক। বলেছি, এক সময় ‘হাওড়া ব্রিজ’ নদীবেষ্টিত কলকাতাকে যুক্ত করেছিল সমগ্র ভারতের সঙ্গে। মাঝে পদ্মা থাকায় শুধু বাদ পড়ে গিয়েছিল জলমাতৃক পূর্ববঙ্গের প্রধানতম মধ্যাঞ্চল, ঢাকা যার হৃদয়। এমনকি আগে যমুনা নদীর বিশালত্বের পরেও, রাজশাহী ও দিনাজপুর হয়ে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল উত্তরবঙ্গের। ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি হয়েও সে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে কয়েক বছর হলো। এবার পদ্মা সেতু ঢাকার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশকে যুক্ত করল, যুক্ত করল পশ্চিমবঙ্গকেও। বাণিজ্যিক লাভালাভ তো আছেই। কিন্তু যে ঢাকা-কলকাতার এক সময়ের দূরত্ব ও যোগাযোগ কল্পনাতীত ছিল, বাংলার দুই প্রধান মহানগরের দূরত্ব মাত্র ৬.১৫ কিলোমিটারের একটি সেতু এক লহমায় ১৫০ কিলোমিটার কমিয়ে দিল। ‘ভিনদেশি’ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এ আনন্দবোধ ও ভালোবাসাকে সম্মান করতেই হবে।
৬.
আজ থেকে ২৪ বছর আগে, যমুনা সেতুর উদ্বোধনের দিন একই রকম আনন্দঘন উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছিল উত্তরবঙ্গের মানুষ। স্পষ্ট মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। আমাদের বাড়িও হয়ে উঠেছিল উৎসবের বাড়ি! পুরো এলাকাও। উত্তরবঙ্গ এমনিতেই পিছিয়ে থাকা জনপদ। যমুনা সেতু অনেকটাই যে এগিয়ে দিয়েছে, তা সন্দেহাতীত। কিন্তু আরও অনেক কিছু হতে পারত, আঞ্চলিক রাজনীতির ফাঁদে পড়ে তা হয়নি। উত্তরবঙ্গের রাস্তাঘাট কিছু অংশ বাদ দিলে চমৎকার। কিন্তু যে পরিমাণ যানবাহন বেড়েছে, তাতে রাস্তা ওয়ান-ওয়ে হওয়া উচিত ছিল। হয়নি। কত লেনের রাস্তা, সে আলাপ তো দূরস্ত! ফলে, রাস্তার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছেই। ওয়ান-ওয়ের কাজ কবে শেষ হবে, কত দিন ভোগান্তি থাকবে, তা আমরা জানি না।
আবার যমুনা সেতুর কারণে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গের সব জেলায় ব্রডগ্রেজ লাইনে ট্রেন চালু হয়েছে নানা দেনদরবারের পর, এই গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে। যমুনা সেতু হওয়ার ২০ বছর পরে। ভাবা যায়!
ফলে, উন্নয়ন মানেই যে উন্নয়নের ফল ভোগ করা—ব্যাপারটা এমন সোজাসাপ্টা না-ও হতে পারে। সময় বদলেছে। উন্নয়নের গতিও অন্যরকম। জটিল নির্মাণপ্রকল্পের সংকল্প হিসেবে পদ্মা সেতু আমাদের উন্নয়নের স্মারক, এ সত্যকে আমরা কখনোই শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে এড়িয়ে যেতে পারি না। যে মানুষটি বিরোধী মত দিচ্ছেন, দিতেই পারেন। কিন্তু তিনিও এ পথে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই এ সেতুর সুফল ভোগ করবেন। জন-আনন্দ ও জন-আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে তো রাজনীতি নয়। গণমানুষের আনন্দবোধকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা করাই এই মুহূর্তের কর্তব্য। একটি সেতু একটি জনপদের মনোভূমিকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছে, খোদ নিজেই হয়ে উঠেছে মানুষের মনোভূমির অংশ—এই দুঃখবেদনাহত দেশে, এমন উৎসবকে স্বাগত জানানোই স্বাভাবিক।
৭.
একটি রাষ্ট্র যেভাবেই চলুক, তার জন্য সরকার প্রয়োজন। সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন ও নানা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। পদ্মা সেতু কোনো ভিন্ন গল্প নয়। ফলে, যে সরকারই এ অসাধ্য সাধন করুক না কেন, তাদের ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন। ঘটনাচক্রে ২৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সেতু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উদ্বোধন করলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে ও তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানাই।
সবই আমাদের টাকায় নির্মিত উন্নয়নের গল্প। তাতে নতুন মহাপালকের নাম—পদ্মা সেতু।
অভিনন্দন, বাংলাদেশ!
লেখক: গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
পদ্মা, প্রমত্তা পদ্মা! তার ওপরে সেতু। একটা বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও এ অর্জন মহীয়ান! জাতীয়তাবাদী যে মন জাদুটোনার মিথ ও ট্যাবুতে অভ্যস্ত, তার জন্য প্রকৃত ও বাস্তবিক জাতীয়তাবাদী হওয়ার এটাই উৎকৃষ্ট সময়!
কিন্তু জাতীয়তাবাদী হওয়ার প্রকৃত সংকট হলো বয়ানের অতিরঞ্জন। এবং সেই অসততারই জয় হয় জাতীয়তাবাদী চেতনার গা-জোরিতে। জাতীয়তাবাদের ক্ষমতা না হলেও চলে, সংখ্যা আর অনুভূতিই তার ক্ষমতা। উদাহরণ খুঁজে পাবেন ভূরিভূরি।
২.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আরও একবার হাতে নিন। দেখবেন লেখা আছে, দেশভাগের আগে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসেছিলেন মাত্র দু-একবার (পৃ.৮৩)। ১৯৪৭ সালের আগে তাঁর পুরোটা রাজনৈতিক অর্জনের কোলজুড়ে আছে কলকাতা।
অবিভক্ত বঙ্গ তথা ভারতের সবচেয়ে বড় বাঙালি জননায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঢাকায় এসেছিলেন পাঁচবার, ১৯২৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে। প্রতিবারই নানাভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৫ বছরে মাত্র পাঁচবার আসতে পেরেছিলেন বাংলার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরে, এ সংখ্যাটা কমই বৈকি!
সুভাষ ও মুজিব—উভয়েই দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। কলকাতা ছিল তাঁদের রাজনীতির প্রাণভ্রমর। ফলে, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের হাইনেটওয়ার্ক তখন খুব অত্যাবশ্যক ছিল না। সেই দাবিও সামনে হাজির ছিল না।
কলকাতার অবস্থানটাও ভৌগোলিকভাবে চমকপ্রদ। একদিকে সে গঙ্গার তীরে (হুগলি নদী) জন্মেছে। আরেক দিকে এই গঙ্গাই যখন পদ্মা হয়েছে পূর্ববঙ্গে ঢুকে, তখন দেখা যাচ্ছে কলকাতা আসলে দক্ষিণবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ‘রিভারলক’ হওয়ার কারণে। তখনকার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা থেকে শুরু করে বরিশাল-খুলনা-যশোর হয়ে কলকাতা ছিল দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ‘হরিহর’ মহানগর।
এই যে ফরিদপুরের মানুষ তখন এত কাছে থাকার পরও ঢাকামুখী না হয়ে কলকাতামুখী হয়েছিলেন, তার বড় কারণ ছিল প্রমত্তা পদ্মা। দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের প্রধান অন্তরায় ছিল এই পদ্মা, বহু বহু বছর। তার মানে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার কোনো সড়ক বা রেল যোগাযোগ ছিল না। এটা প্রণিধানযোগ্য বিষয়।
৩.
অন্যদিকে সমগ্র ভারতবর্ষের সাপেক্ষে কলকাতার দশাও ছিল ঢাকারই মতো। গঙ্গা কলকাতার বুকে নাম নিয়েছে হুগলি। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে কলকাতা, পশ্চিম তীরে কলকাতার টুইন সিস্টার হাওড়া। এই হাওড়ার সঙ্গে সমগ্র ভারতবর্ষের রেল-সংযোগ সেই ১৮৫৪ সাল থেকে। হাওড়া রেলওয়ে জংশন ভারতবর্ষের একটা ‘মিথিক্যাল সুপারপাওয়ার’-এর মতো। সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে ব্যস্ত ও সবচেয়ে বড়।
কলকাতার গোড়াপত্তন যেহেতু বহু আগেই হয়ে গিয়েছিল কুঠিসাহেব জব চার্নকের হাত ধরে, সেহেতু কলকাতাকে সড়কপথে সংযুক্ত করার নির্বিবাদ প্রয়োজন ছিল। হুগলির পশ্চিম তীরে হাওড়ার উত্থানের মূলে ছিল সমগ্র উত্তর ও পশ্চিম ভারতবর্ষকে মহানগর কলকাতার সন্নিকটে পৌঁছে দেওয়া। হাওড়া এ চাহিদা আজও মেটাচ্ছে। এই সড়ক-সংযোগের জরুরতের কারণে, বহু বিলম্বে হলেও, কলকাতাকে সড়কপথে ভারতবর্ষের সিংহভাগ ভূমির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ১৯৪২ সালে ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল আরেক আশ্চর্য স্থাপনা ‘হাওড়া ব্রিজ’ (রবীন্দ্র সেতু)।
৪.
যেকোনো সেতুর এই ভূমি-যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে সেই কাজটি করল। জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির কচকচানির বাইরে পদ্মা সেতুর এই ভূমিকাটিই তার প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতাশক্তিকে বাড়াবে।
কতটা বদলে দেবে মানুষের জীবনযাপন এ সেতু? নানা ধরনের গবেষণা ও গবেষণা-ফল বাজারে হাজির আছে। সেসব ডেটার সত্যাসত্য নিশ্চয়ই একদিন যাচাই হবে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, প্রমত্তা পদ্মার জলে ভেসে যে মানুষ নানা চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে গমনাগমন করেছে, তার কাছে এই পথ-সংযোগ একটা আবেগেরই আস্ফালন।
দক্ষিণবঙ্গের চেহারা বদলাবে কি না, বদলালে কতটা—সেটা অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু ঢাকা হয়ে প্রকারান্তরে সমগ্র দেশের সঙ্গে এই যোগাযোগ মানুষের যাতায়াতের সময়কে যে কমিয়ে আনবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে—তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট না হলেও চলে।
৫.
অন্যদিকে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে নৌপথের যে বিকাশ ও উন্নয়ন প্রয়োজন, সেদিকেও আরও মনোযোগ দেওয়ার যে দাবি এই মুহূর্তে উঠেছে, সেটাও অযৌক্তিক নয়। বরং বাস্তবসম্মত। খোদ ঢাকার চারপাশেই যে পরিমাণ জলপথ আছে, সেগুলোকে কার্যকর করা প্রয়োজন। কলকাতা-হাওড়ার বুকে চিরে চলা স্বচ্ছতোয়া হুগলি নদীর ওপর যে পরিমাণ লঞ্চ ও জাহাজ দেখেছি শুধু বাণিজ্যের খাতিরেই, মনে পড়ে না, অধিকতর প্রমত্তা হওয়ার পরও পদ্মা কিংবা ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপর তা দেখেছি। বরং, ঢাকার চারপাশের নদীনালা দেখি দখলদারদের হাতে খাবি খাচ্ছে। রাজনীতির প্রশ্রয় না থাকলে এসব করা সম্ভব? অথচ, আজও পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম জলপথ।
আবার, মেট্রোরেলের আগমন যে ঢাকার যানজট কমাতে পারবে না, সেটাও বিশেষজ্ঞরা বলে দিয়েছেন। সঙ্গে আরেকটি সত্য উপেক্ষা করার জো নেই, পদ্মা সেতুর কারণে এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে যানজটের নগর ঢাকা। পদ্মাযোগ এখন ঢাকার চাপ আরও বাড়াল। বিপুল পরিমাণ মানুষ ও যানবাহন ঢাকা শহরে ঢুকবে। সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সময়ের কাছে সেই দাবি তোলা থাকল।
যদিও নতুন বিভাগ হয়ে যাওয়ায় ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষকে প্রশাসনিক কাজে আগামীতে আর ঢাকায় আসতে হবে না, সেটা একটা বাস্তবতা। আসল কথা হলো, রাজধানী হিসেবে ঢাকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় ঢাকার ওপর অনন্ত যে চাপ, তা বেড়েই চলেছে। ঢাকার কোনো বিকল্প যে আমরা এত বছরেও গড়ে তুলতে পারিনি, এ সত্য কে এড়িয়ে যাবে? জনঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে প্রাদেশিক শাসন জরুরি ছিল, এ সত্যও কি এড়ানো যাবে?
তাই বলে পদ্মা সেতুর এই আগমন বুমেরাং হয়ে যেতে পারে না। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে আনন্দের ও উৎসবের বিষয়। এই আনন্দ-উৎসব যে শুধু একটা ২৫ জুনেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, তা নয়। এ এক চির-আনন্দের বিষয়। দক্ষিণবঙ্গের জন্য তো বটেই, সমগ্র বাংলাদেশের জন্যও।
এমনকি দেখতে পাচ্ছি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পদ্মা সেতু নিয়ে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা ব্যাপক। বলেছি, এক সময় ‘হাওড়া ব্রিজ’ নদীবেষ্টিত কলকাতাকে যুক্ত করেছিল সমগ্র ভারতের সঙ্গে। মাঝে পদ্মা থাকায় শুধু বাদ পড়ে গিয়েছিল জলমাতৃক পূর্ববঙ্গের প্রধানতম মধ্যাঞ্চল, ঢাকা যার হৃদয়। এমনকি আগে যমুনা নদীর বিশালত্বের পরেও, রাজশাহী ও দিনাজপুর হয়ে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল উত্তরবঙ্গের। ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি হয়েও সে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে কয়েক বছর হলো। এবার পদ্মা সেতু ঢাকার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশকে যুক্ত করল, যুক্ত করল পশ্চিমবঙ্গকেও। বাণিজ্যিক লাভালাভ তো আছেই। কিন্তু যে ঢাকা-কলকাতার এক সময়ের দূরত্ব ও যোগাযোগ কল্পনাতীত ছিল, বাংলার দুই প্রধান মহানগরের দূরত্ব মাত্র ৬.১৫ কিলোমিটারের একটি সেতু এক লহমায় ১৫০ কিলোমিটার কমিয়ে দিল। ‘ভিনদেশি’ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এ আনন্দবোধ ও ভালোবাসাকে সম্মান করতেই হবে।
৬.
আজ থেকে ২৪ বছর আগে, যমুনা সেতুর উদ্বোধনের দিন একই রকম আনন্দঘন উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছিল উত্তরবঙ্গের মানুষ। স্পষ্ট মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। আমাদের বাড়িও হয়ে উঠেছিল উৎসবের বাড়ি! পুরো এলাকাও। উত্তরবঙ্গ এমনিতেই পিছিয়ে থাকা জনপদ। যমুনা সেতু অনেকটাই যে এগিয়ে দিয়েছে, তা সন্দেহাতীত। কিন্তু আরও অনেক কিছু হতে পারত, আঞ্চলিক রাজনীতির ফাঁদে পড়ে তা হয়নি। উত্তরবঙ্গের রাস্তাঘাট কিছু অংশ বাদ দিলে চমৎকার। কিন্তু যে পরিমাণ যানবাহন বেড়েছে, তাতে রাস্তা ওয়ান-ওয়ে হওয়া উচিত ছিল। হয়নি। কত লেনের রাস্তা, সে আলাপ তো দূরস্ত! ফলে, রাস্তার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছেই। ওয়ান-ওয়ের কাজ কবে শেষ হবে, কত দিন ভোগান্তি থাকবে, তা আমরা জানি না।
আবার যমুনা সেতুর কারণে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গের সব জেলায় ব্রডগ্রেজ লাইনে ট্রেন চালু হয়েছে নানা দেনদরবারের পর, এই গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে। যমুনা সেতু হওয়ার ২০ বছর পরে। ভাবা যায়!
ফলে, উন্নয়ন মানেই যে উন্নয়নের ফল ভোগ করা—ব্যাপারটা এমন সোজাসাপ্টা না-ও হতে পারে। সময় বদলেছে। উন্নয়নের গতিও অন্যরকম। জটিল নির্মাণপ্রকল্পের সংকল্প হিসেবে পদ্মা সেতু আমাদের উন্নয়নের স্মারক, এ সত্যকে আমরা কখনোই শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে এড়িয়ে যেতে পারি না। যে মানুষটি বিরোধী মত দিচ্ছেন, দিতেই পারেন। কিন্তু তিনিও এ পথে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই এ সেতুর সুফল ভোগ করবেন। জন-আনন্দ ও জন-আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে তো রাজনীতি নয়। গণমানুষের আনন্দবোধকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা করাই এই মুহূর্তের কর্তব্য। একটি সেতু একটি জনপদের মনোভূমিকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছে, খোদ নিজেই হয়ে উঠেছে মানুষের মনোভূমির অংশ—এই দুঃখবেদনাহত দেশে, এমন উৎসবকে স্বাগত জানানোই স্বাভাবিক।
৭.
একটি রাষ্ট্র যেভাবেই চলুক, তার জন্য সরকার প্রয়োজন। সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন ও নানা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। পদ্মা সেতু কোনো ভিন্ন গল্প নয়। ফলে, যে সরকারই এ অসাধ্য সাধন করুক না কেন, তাদের ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন। ঘটনাচক্রে ২৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সেতু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উদ্বোধন করলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে ও তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানাই।
সবই আমাদের টাকায় নির্মিত উন্নয়নের গল্প। তাতে নতুন মহাপালকের নাম—পদ্মা সেতু।
অভিনন্দন, বাংলাদেশ!
লেখক: গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নাম জুড়ে দিয়ে ওই তিন দলসহ মোট ১১টি দলকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি না দিতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চেয়ে রিট করার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। ১১টি দলের তালিকায় এলডিপির নামও
৭ ঘণ্টা আগেঅত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এই লেখাটা লিখছি। রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে অন্য একটি প্রবন্ধ লিখব বলে ভেবেছিলাম। গত রোববার থেকেই বুকের মধ্যে কেমন যেন পাথরচাপা একটা কষ্ট অনুভব করছি। প্রথমে টেলিভিশনে খবরে দেখলাম, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির তিন ছাত্র মারা গেছেন। যে তিন ছাত্র মারা গেছেন, তাঁদের সমবয়সী হবে
৭ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় বহুল পরিচিত একটি শব্দ হলো কালাজ্বর। শব্দটি কমবেশি আমরা সবাই শুনেছি। এমনকি কেউ কেউ কালাজ্বরে আক্রান্তও হয়েছি। কিন্তু এই জ্বরকে কালাজ্বর কেন বলা হয়? কালো রঙের সঙ্গে এর কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? জ্বরের প্রকারভেদে রঙের কি আদৌ কোনো ভূমিকা রয়েছে? যদি না থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন এ জ্বরকে কালাজ্ব
৭ ঘণ্টা আগেসাংবাদিকদের হয়রানি করা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থল ও বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ইমিগ্রেশনে যেভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তা কেবল পেশাগত বাধার উদাহরণ নয়, এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার ওপর একধরনের চাপ। এই ধরনের আচরণ রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনা ও মানব
৭ ঘণ্টা আগে