আজাদুর রহমান চন্দন
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নাম জুড়ে দিয়ে ওই তিন দলসহ মোট ১১টি দলকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি না দিতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চেয়ে রিট করার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। ১১টি দলের তালিকায় এলডিপির নামও ছিল। রিটের বিষয়টি সমালোচনার পাশাপাশি ব্যাপক হাস্যরসেরও জন্ম দিয়েছিল। গত ২৮ অক্টোবর হাইকোর্টে একই সঙ্গে দুটি রিট আবেদন করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা। রিট আবেদনকারীদের পক্ষ থেকে সেদিন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভিন্ন তথ্যও দেওয়া হয়েছিল। একজন আবেদনকারী সেদিন বলেছিলেন, রিটের বিষয় ‘কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) করে কাল-পরশুর মধ্যে’ তারা বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আসবেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, রিটের বিষয়টি তখনো সম্পূর্ণ হয়নি। যদিও ২৮ অক্টোবরই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চের ২৯ অক্টোবরের কার্যতালিকায় রিট দুটি ছিল। ২৮ অক্টোবর বিকেলে এবি পার্টির কার্যালয়ে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ওই রিট আবেদনকারী বলেন, ‘ওই রিটের এডিট থেকে শুরু করে যা কিছু রয়েছে, তা কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) করে হয়তো আগামীকাল বা সর্বোচ্চ হলে পরশু দিনের মধ্যে আমরা বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আসব।’ অথচ সেদিন বিকেলেই রিট দুটির বিষয়ে ‘আউট’ লেখা দেখা যায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, রিট দুটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পরদিনই বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সেখানে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেন, রিট আবেদনে ১১টি দলের তালিকায় অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং সিপিবি ও বাসদের নাম দেখে তাঁরা ‘বিব্রত’ হয়েছেন। বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘যাঁরা রিটটা করেছেন, তাঁদের কনসেনট্রেশনের (মনোযোগ) ঘাটতি ছিল। তাই আমরা তাদের রিটটা বাতিল করতে বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, এখানে আইনজীবী বা যাঁরা রিট করেছেন, তাঁদের কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে। রিট-সংক্রান্ত ওই ‘ভুলের’ জন্য মতবিনিময় সভায় দুঃখ প্রকাশ করায় বিষয়টির সেখানেই সমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু এর দুই সপ্তাহের মাথায় সমন্বয়ক পরিচয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সিপিবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের পথসভায় বাধা দিয়ে চেয়ার ভাঙচুর করা হয়। ‘শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতন্ত্র জাগরণ যাত্রা’ নামের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর তেঁতুলিয়া শহরে পথসভায় ওই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, দুপুরের দিকে তেঁতুলতলা এলাকায় সিপিবির পূর্বনির্ধারিত পথসভা শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পর হযরত আলী নামে এক যুবক নিজেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে আরও কয়েকজন যুবককে নিয়ে পথসভার ব্যানার ছিনিয়ে নেন। রুহিন হোসেন প্রিন্সের হাত থেকে মাইক্রোফোনও তাঁরা কেড়ে নেন। ওই সময় তাঁরা সিপিবি নেতাদের ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে চেয়ার ভাঙচুর করেন। তেঁতুলিয়া মডেল থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশ সেখানে উপস্থিত থাকলেও তাদের কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স ঘটনাস্থল থেকেই বিষয়টি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহকে। তখন প্রিন্সকে জানানো হয় যে তেঁতুলিয়ায় তাঁদের কোনো কমিটি নেই। তাই যদি হয়, তবে কোন শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে সিপিবির সভায় হামলা চালানোর ধৃষ্টতা দেখাতে সমর্থ হলো?
এটা ঠিক যে স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির একধরনের মৈত্রী ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই দল দুটির সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন চালালেও সিপিবি তাতে শামিল হয়নি। ২০০৫ সালে গণফোরামসহ তখনকার ১১ দলীয় জোটের কোনো কোনো দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করলে সিপিবি, বাসদের দুই অংশ এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায়। তখন ১১ দলীয় জোটের অন্য সাতটি দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জাসদ (ইনু) ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) মিলে গঠিত হয়েছিল ১৪ দলীয় জোট। পরে অবশ্য গণফোরামও জোট ত্যাগ করে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সিপিবি-বাসদসহ বামপন্থীরা আগাগোড়াই সোচ্চার ছিল। গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনেও বামপন্থী ছাত্র-তরুণেরা রাজপথে ছিলেন নিজেদের পুরো শক্তি নিয়ে। ৫ আগস্টের পর হঠাৎ ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে সিপিবিকে আক্রমণ করার মাজেজাটা কী?
তেঁতুলিয়ায় সিপিবির পথসভায় বাধা ও ভাঙচুরের দুই দিনের মাথায় জামালপুরে ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশের সম্মেলনে হামলা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের এই অংশ সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশের সমর্থনপুষ্ট। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে পোগলদিঘা ডিগ্রি কলেজ মিলনায়তনে গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় সংগঠনটির সরিষাবাড়ী উপজেলা শাখার সম্মেলনে ওই হামলা চালানো হয়। পরদিনই শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া বাজারে হামলা করা হয় বাম গণতান্ত্রিক জোটের মিছিলে। সিপিবি ঘোষিত ‘শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতন্ত্র জাগরণ যাত্রা’র কর্মসূচি গোসাইরহাটে জোটগতভাবে পালন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জোটের ওই কর্মী সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিলে বিএনপির কর্মীরা হামলা চালান বলে অভিযোগ করেন বাম জোটের নেতারা।
উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন যে এমনটিই তো হওয়ার কথা ছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া আন্দোলন শেখ হাসিনার সরকার শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে চাইলে তা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন বলা হচ্ছিল, জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গিরা আন্দোলনে মিশে নাশকতা চালাচ্ছে। বামপন্থীরা এদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নিজেদের জন্যও বিপর্যয় ডেকে আনছে বলেও তখন ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ইরানে রেজা শাহ পাহলভির পতনের পর কমিউনিস্টদের কী পরিণতি হয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিতেও তারা পিছপা হয়নি। কিন্তু বিভেদ সৃষ্টির কোনো কৌশলই তখন আর কাজে আসেনি। কোটা সংস্কারের আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সশস্ত্র বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। স্বৈরশাসন উৎখাত করার ন্যায়সংগত আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। কোনো অশুভ শক্তি তাতে ভিড়ে গেলেও সেই মুহূর্তে তাদের শনাক্ত করে সরিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এখন প্রশ্ন হলো, বামপন্থীরা যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাল, তাদেরই কোনো কোনো অংশের আক্রমণের লক্ষ্য কেন হচ্ছে? এর জবাব খুব কঠিন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ও ৪ নভেম্বর (জাতীয় সংবিধান দিবস) বাতিল করা, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাবের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নানা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সিপিবি, বাসদ, উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বামপন্থী দল ও সংগঠন। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা উঠতেই উদীচী সারা দেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করার মধ্য দিয়েই তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক অপকর্ম মনঃপূত না হওয়া সত্ত্বেও দেশের যে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর নিরুপায় হয়ে দলটিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কোনো কোনো মহলের নগ্ন হুংকারে সেই জনগোষ্ঠী আরও অসহায় ও অনিরাপদ বোধ করছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এই জনগোষ্ঠীর একাংশের বা বড় অংশের সমর্থন সিপিবির দিকে চলে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা কারও কারও মনে দেখা দেওয়াটা অমূলক নয়। কারণ, সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষের এক পরীক্ষিত শক্তি। উদ্ভূত পরিস্থিতিটা ছোট দল হিসেবে সিপিবির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সম্ভাবনাময়। এখন সিপিবি ভয় পেয়ে দমে যাবে, নাকি সাহসী হয়ে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে তৎপর হবে, সেটিই দেখার বিষয়।
লেখক: আজাদুর রহমান চন্দন
সাংবাদিক ও গবেষক
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নাম জুড়ে দিয়ে ওই তিন দলসহ মোট ১১টি দলকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি না দিতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চেয়ে রিট করার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। ১১টি দলের তালিকায় এলডিপির নামও ছিল। রিটের বিষয়টি সমালোচনার পাশাপাশি ব্যাপক হাস্যরসেরও জন্ম দিয়েছিল। গত ২৮ অক্টোবর হাইকোর্টে একই সঙ্গে দুটি রিট আবেদন করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা। রিট আবেদনকারীদের পক্ষ থেকে সেদিন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভিন্ন তথ্যও দেওয়া হয়েছিল। একজন আবেদনকারী সেদিন বলেছিলেন, রিটের বিষয় ‘কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) করে কাল-পরশুর মধ্যে’ তারা বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আসবেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, রিটের বিষয়টি তখনো সম্পূর্ণ হয়নি। যদিও ২৮ অক্টোবরই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চের ২৯ অক্টোবরের কার্যতালিকায় রিট দুটি ছিল। ২৮ অক্টোবর বিকেলে এবি পার্টির কার্যালয়ে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ওই রিট আবেদনকারী বলেন, ‘ওই রিটের এডিট থেকে শুরু করে যা কিছু রয়েছে, তা কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) করে হয়তো আগামীকাল বা সর্বোচ্চ হলে পরশু দিনের মধ্যে আমরা বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আসব।’ অথচ সেদিন বিকেলেই রিট দুটির বিষয়ে ‘আউট’ লেখা দেখা যায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, রিট দুটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পরদিনই বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সেখানে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেন, রিট আবেদনে ১১টি দলের তালিকায় অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং সিপিবি ও বাসদের নাম দেখে তাঁরা ‘বিব্রত’ হয়েছেন। বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘যাঁরা রিটটা করেছেন, তাঁদের কনসেনট্রেশনের (মনোযোগ) ঘাটতি ছিল। তাই আমরা তাদের রিটটা বাতিল করতে বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, এখানে আইনজীবী বা যাঁরা রিট করেছেন, তাঁদের কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে। রিট-সংক্রান্ত ওই ‘ভুলের’ জন্য মতবিনিময় সভায় দুঃখ প্রকাশ করায় বিষয়টির সেখানেই সমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু এর দুই সপ্তাহের মাথায় সমন্বয়ক পরিচয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সিপিবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের পথসভায় বাধা দিয়ে চেয়ার ভাঙচুর করা হয়। ‘শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতন্ত্র জাগরণ যাত্রা’ নামের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর তেঁতুলিয়া শহরে পথসভায় ওই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, দুপুরের দিকে তেঁতুলতলা এলাকায় সিপিবির পূর্বনির্ধারিত পথসভা শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পর হযরত আলী নামে এক যুবক নিজেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে আরও কয়েকজন যুবককে নিয়ে পথসভার ব্যানার ছিনিয়ে নেন। রুহিন হোসেন প্রিন্সের হাত থেকে মাইক্রোফোনও তাঁরা কেড়ে নেন। ওই সময় তাঁরা সিপিবি নেতাদের ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে চেয়ার ভাঙচুর করেন। তেঁতুলিয়া মডেল থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশ সেখানে উপস্থিত থাকলেও তাদের কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স ঘটনাস্থল থেকেই বিষয়টি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহকে। তখন প্রিন্সকে জানানো হয় যে তেঁতুলিয়ায় তাঁদের কোনো কমিটি নেই। তাই যদি হয়, তবে কোন শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে সিপিবির সভায় হামলা চালানোর ধৃষ্টতা দেখাতে সমর্থ হলো?
এটা ঠিক যে স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির একধরনের মৈত্রী ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই দল দুটির সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন চালালেও সিপিবি তাতে শামিল হয়নি। ২০০৫ সালে গণফোরামসহ তখনকার ১১ দলীয় জোটের কোনো কোনো দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করলে সিপিবি, বাসদের দুই অংশ এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায়। তখন ১১ দলীয় জোটের অন্য সাতটি দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জাসদ (ইনু) ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) মিলে গঠিত হয়েছিল ১৪ দলীয় জোট। পরে অবশ্য গণফোরামও জোট ত্যাগ করে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সিপিবি-বাসদসহ বামপন্থীরা আগাগোড়াই সোচ্চার ছিল। গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনেও বামপন্থী ছাত্র-তরুণেরা রাজপথে ছিলেন নিজেদের পুরো শক্তি নিয়ে। ৫ আগস্টের পর হঠাৎ ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে সিপিবিকে আক্রমণ করার মাজেজাটা কী?
তেঁতুলিয়ায় সিপিবির পথসভায় বাধা ও ভাঙচুরের দুই দিনের মাথায় জামালপুরে ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশের সম্মেলনে হামলা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের এই অংশ সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশের সমর্থনপুষ্ট। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে পোগলদিঘা ডিগ্রি কলেজ মিলনায়তনে গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় সংগঠনটির সরিষাবাড়ী উপজেলা শাখার সম্মেলনে ওই হামলা চালানো হয়। পরদিনই শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া বাজারে হামলা করা হয় বাম গণতান্ত্রিক জোটের মিছিলে। সিপিবি ঘোষিত ‘শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতন্ত্র জাগরণ যাত্রা’র কর্মসূচি গোসাইরহাটে জোটগতভাবে পালন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জোটের ওই কর্মী সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিলে বিএনপির কর্মীরা হামলা চালান বলে অভিযোগ করেন বাম জোটের নেতারা।
উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন যে এমনটিই তো হওয়ার কথা ছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া আন্দোলন শেখ হাসিনার সরকার শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে চাইলে তা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন বলা হচ্ছিল, জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গিরা আন্দোলনে মিশে নাশকতা চালাচ্ছে। বামপন্থীরা এদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নিজেদের জন্যও বিপর্যয় ডেকে আনছে বলেও তখন ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ইরানে রেজা শাহ পাহলভির পতনের পর কমিউনিস্টদের কী পরিণতি হয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিতেও তারা পিছপা হয়নি। কিন্তু বিভেদ সৃষ্টির কোনো কৌশলই তখন আর কাজে আসেনি। কোটা সংস্কারের আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সশস্ত্র বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। স্বৈরশাসন উৎখাত করার ন্যায়সংগত আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। কোনো অশুভ শক্তি তাতে ভিড়ে গেলেও সেই মুহূর্তে তাদের শনাক্ত করে সরিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
এখন প্রশ্ন হলো, বামপন্থীরা যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাল, তাদেরই কোনো কোনো অংশের আক্রমণের লক্ষ্য কেন হচ্ছে? এর জবাব খুব কঠিন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ও ৪ নভেম্বর (জাতীয় সংবিধান দিবস) বাতিল করা, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাবের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নানা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সিপিবি, বাসদ, উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বামপন্থী দল ও সংগঠন। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা উঠতেই উদীচী সারা দেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করার মধ্য দিয়েই তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক অপকর্ম মনঃপূত না হওয়া সত্ত্বেও দেশের যে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর নিরুপায় হয়ে দলটিকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কোনো কোনো মহলের নগ্ন হুংকারে সেই জনগোষ্ঠী আরও অসহায় ও অনিরাপদ বোধ করছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এই জনগোষ্ঠীর একাংশের বা বড় অংশের সমর্থন সিপিবির দিকে চলে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা কারও কারও মনে দেখা দেওয়াটা অমূলক নয়। কারণ, সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষের এক পরীক্ষিত শক্তি। উদ্ভূত পরিস্থিতিটা ছোট দল হিসেবে সিপিবির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সম্ভাবনাময়। এখন সিপিবি ভয় পেয়ে দমে যাবে, নাকি সাহসী হয়ে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে তৎপর হবে, সেটিই দেখার বিষয়।
লেখক: আজাদুর রহমান চন্দন
সাংবাদিক ও গবেষক
অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এই লেখাটা লিখছি। রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে অন্য একটি প্রবন্ধ লিখব বলে ভেবেছিলাম। গত রোববার থেকেই বুকের মধ্যে কেমন যেন পাথরচাপা একটা কষ্ট অনুভব করছি। প্রথমে টেলিভিশনে খবরে দেখলাম, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির তিন ছাত্র মারা গেছেন। যে তিন ছাত্র মারা গেছেন, তাঁদের সমবয়সী হবে
৩ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় বহুল পরিচিত একটি শব্দ হলো কালাজ্বর। শব্দটি কমবেশি আমরা সবাই শুনেছি। এমনকি কেউ কেউ কালাজ্বরে আক্রান্তও হয়েছি। কিন্তু এই জ্বরকে কালাজ্বর কেন বলা হয়? কালো রঙের সঙ্গে এর কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? জ্বরের প্রকারভেদে রঙের কি আদৌ কোনো ভূমিকা রয়েছে? যদি না থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন এ জ্বরকে কালাজ্ব
৩ ঘণ্টা আগেসাংবাদিকদের হয়রানি করা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থল ও বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ইমিগ্রেশনে যেভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তা কেবল পেশাগত বাধার উদাহরণ নয়, এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার ওপর একধরনের চাপ। এই ধরনের আচরণ রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনা ও মানব
৩ ঘণ্টা আগেবর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নীতিনির্ধারণী একটি বিষয় অগ্রাধিকার বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ আছে, আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করা, নাকি যথাশিগগির নির্বাচন আয়োজন করা? অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
১ দিন আগে