নতুন বছর ও বিশ্বরাজনীতি

ড. মঞ্জুরে খোদা
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭: ৫৪
Thumbnail image

বিশ্বব্যাপী একধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার সর্বত্রই পরিবর্তন ঘটছে। ক্ষমতার পালাবদলের নানামাত্রিক পরিবর্তন ঘটছে, কোথাও নিয়মতান্ত্রিক, কোথাও বিপ্লব-বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে। এতে বিশ্বের কোথাও একধরনের স্থিতিশীলতা, অন্যদিকে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। ইউরোপের ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানিসহ অনেক দেশে পরিবর্তন ঘটেছে। এশিয়ার জাপান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, সিরিয়ায় পরিবর্তন ঘটেছে। ইসরায়েল-গাজাসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি অঞ্চলে যুদ্ধ চলমান। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। দুই দশকের অধিককাল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে। এই সময়ে চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে সামনে চলে আসে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার মাধ্যমে পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের পুনরায় জানান দেয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তারা তাদের ভূমিকা বাড়াতে থাকে এবং সফলতাও পায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তি কর্তৃক ইরাক ও লিবিয়ায় আক্রমণ এবং আরব বসন্তের পর বিশ্বরাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা তৈরি হয়। শাসকের পরিবর্তনের পর এইসব দেশে যে অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য, ধ্বংসযজ্ঞ ও গৃহযুদ্ধ হয়, তা ছিল ভয়াবহ। মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে দুই দশক লড়াই করে রণক্লান্ত হওয়ার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সকে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন নাইজার, মালি, বুরকিনা ফাসো, চাদ বিপ্লব, বিদ্রোহ ও সরকার পরিবর্তনের পর তাদের হাত গুটিয়ে আসতে হয়। আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলেও ফ্রান্সের পুতুল শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ-ক্ষোভ বাড়ছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের অনেক দিন হয়ে গেলেও তা থামার লক্ষণ নেই। ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার পর হয়তো রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে একটা সমঝোতা হবে, কিন্তু তাতে বিশ্ব পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে—বিষয়টি এমন নয়। বিশ্ব জনমত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে থাকলেও তারা গাজায় হামলা-আক্রমণ, হত্যা অব্যাহত রেখেছে। এই যুদ্ধ ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাশার আল আসাদের পতনের পর সিরিয়ার বিদ্রোহী ইসলামি গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করেছে, যাদের সঙ্গে ইসরায়েল ও তুরস্কের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। ইসরায়েলের সঙ্গে আবার গাজা নিয়ে তুরস্কের বিরোধ বিদ্যমান। ইরান হচ্ছে হামাসের প্রধান সহায়ক শক্তি, সিরিয়ার আসাদ ছিল তার পক্ষের লোক। আসাদের পতনে মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনীতিতে তৈরি করবে নতুন সমীকরণ, ইসরায়েলকে করবে আরও বেপরোয়া। ইসরায়েলের সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করতে ইরানের যে প্রচেষ্টা ছিল, সে ক্ষেত্রে তারা মিত্রহীন হলো। রুশ সমর্থিত পতিত বাশার আল আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ইসরায়েল প্রভাব আরও বাড়াবে।

মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি যেমন তাদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টায় বেপরোয়া, তেমনি চীন-রাশিয়াও সেই দৌড়ে পিছিয়ে নেই। তারাও তাদের প্রভাববলয় বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। ব্রিকস গঠন ও কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা ইতিমধ্যে পশ্চিমা শক্তিকে সেই বার্তা দিয়েছে। তারা ডলারের বিকল্প হিসেবে বহুমুখী মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে। তারা ইতিমধ্যে নিজ দেশের মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছে এবং তার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি তাদের বিরুদ্ধে যে নজিরবিহীন বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে রেখেছে, রাশিয়া তার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবসা করে পুষিয়ে নিয়েছে। রাশিয়াকে বিপদে ফেলা ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার যে পরিকল্পনা পশ্চিমা শক্তি করেছিল, তা কার্যকর হয়নি। শুধু রাশিয়ার ক্ষেত্রে নয়, কয়েক দশক ধরে কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ওপর যে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, তাকে অবজ্ঞা করেই তারা টিকে আছে ও এগিয়ে যাচ্ছে।

ইউরোপ-আমেরিকার শাসনকাঠামোতেও পরিবর্তনের হাওয়া বইছে ও অস্থিরতা চলছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিতেও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। ইউরোপের রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে ইউক্রেন যুদ্ধ, অভিবাসন, দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট, পরিবেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে আসার মাধ্যমে এই বলয়ে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের প্রভাব খর্ব হয়ে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানে চীনপন্থী সরকার ক্ষমতায়। বাংলাদেশ, পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা বাড়ছে। সেটি হয়েছেও সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে। পাকিস্তানে নানা কৌশল ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইমরান খানের দল পিটিআইকে নির্বাচনের অযোগ্য করে বাইরে রাখা হয়েছিল। ইমরানকে কারাবন্দী করা হলে তাঁর দল স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। পরিণতিতে পাকিস্তানে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান। বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এক অভূতপূর্ণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে বিতাড়িত হতে হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। মিয়ানমার গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ভয়ংকর সংকটে নিপতিত একটি দেশ। সেখানেও সামরিক সরকারের পতন আসন্নপ্রায়।

এরই মধ্যে ২০২৫ সাল শুরু হতে যাচ্ছে। বর্ষসংখ্যা হিসেবে ২০২৫ সাল চমৎকার। কিন্তু এই বছরটিও কি হবে গত বছরের ধারাবাহিকতা? ২০ জানুয়ারি দুনিয়ার পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁকে ঘিরেও বিশ্বরাজনীতিতে মিশ্র আলোচনা আছে। সে আলোচনার সূত্র তিনি নিজেই। ইতিমধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন কী করতে চান। বাণিজ্যে মিত্র ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, প্রতিবেশী কানাডার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। অভিবাসন প্রশ্নে তাঁর থাকবে কঠোর অবস্থান। বিশ্বে মার্কিন কর্তৃত্ব ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে উসকে দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে বিরোধ-বিতর্কের সৃষ্টি করবেন। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ভাষ্যে, ২০২৪ ছিল নির্বাচনের বছর, ২০২৫ হবে প্রশ্নের বছর। বছরের শুরুতে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে প্রধান যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে সেগুলো হচ্ছে: অর্থনৈতিক, সামাজিক, নিরাপত্তা, পরিবেশগত ও প্রযুক্তিগত বিষয়ের চ্যালেঞ্জ তারা কীভাবে মোকাবিলা করবে।

বিশ্বনেতারা বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যাগুলো সমাধান করা কঠিন হবে। নেতাদের শুধু নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রয়োজন হবে না, এখন যে বিশ্ব আগ্রাসন এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে, তার জায়গায় শান্তি ও সমৃদ্ধির একটি বৈশ্বিক কাঠামো তৈরির জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। সর্বোপরি বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার নীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটবে, নাকি অতীত ধারাবাহিকতারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে নতুন বছরে—সেই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সমালোচকদের ধুয়ে দিলেন রোহিত

আজহারীর মাহফিলে অসংখ্য মানুষের স্বর্ণালংকার-মোবাইল খোয়া, থানায় জিডির হিড়িক

মানিকগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়ি ভাঙচুর মামলায় গ্রেপ্তার আসামির ঢামেকে মৃত্যু

টিউলিপকে লন্ডনের ফ্ল্যাটদাতা কে এই মোতালিফ, কীভাবে তিনি হাসিনা-ঘনিষ্ঠ

টিউলিপ সিদ্দিককে বিনামূল্যে লন্ডনে ফ্ল্যাট দেন আ.লীগ সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত