হাসান মামুন
২০২৪ সালটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের জন্য। সেনা অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সরকারের পতন তো আরও কয়েকবার হয়েছে। মাঝে নব্বইয়ের ‘গণ-আন্দোলনে’ অবসান ঘটে সেনাশাসনের। তারপর আর সেনাশাসন না এলেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। তাদের হাতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা হাসিনা সরকার একটি নজিরবিহীন স্বৈরশাসন কায়েম করবে, এটা কিন্তু কেউ চিন্তা করতে পারেনি। সরকারি চাকরিতে কোটার প্রশ্ন ঘিরে সৃষ্ট আন্দোলন শেষে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে দ্রুতই এই সরকারের পতন ঘটাবে, এটাও ভেবে উঠতে পারেনি কেউ। সেটাই ঘটেছে চব্বিশের ৫ আগস্ট।
এর মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসা গোটা সরকার ও তার সহযোগীদের পালিয়ে যাওয়ার নজির কমই পাওয়া যাবে। পুলিশও গিয়েছিল লাপাত্তা হয়ে। চাকরিতে ফিরে তারা এখনো প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করতে পারছে না। নতুন ডিএমপি কমিশনার হালে বলেছেন, সরকার পতনের ৭২ ঘণ্টা আগেও ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ নিতে পারলে বেশ কিছু প্রাণহানি এড়ানো যেত। আন্দোলন চলাকালে এবং তা জয়যুক্ত হওয়ার পর পুলিশ হত্যার ঘটনাও কম ঘটেনি। থানা ও কারাগার আক্রান্ত হওয়ার সময় আগ্নেয়াস্ত্রও কম লুট হয়নি। ভালো যে, শেষ দিকে হলেও সেনাবাহিনী অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতার পক্ষে। হাসিনা সরকারের সঙ্গে তার দল ও জোটের একান্ত অনুগতরা এবং বিশেষ করে পুলিশ শেষ পর্যন্ত ছিল পরিবর্তনকামী জনতার বিরুদ্ধে। এদের হাতে হাসিনার ভারতে চলে যাওয়ার দিনও বহু আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটে। ‘আত্মরক্ষার্থেও’ তারা গুলি চালায়। ডিএমপি কমিশনার ঠিকই বলেছেন, শেষ সময়েও সেনাবাহিনীর মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হলে তা এড়ানো যেত। তবে সেটা বোধ হয় অসম্ভব ছিল ‘হাসিনা রেজিম’ পুলিশের চরিত্র আমূল বদলে ফেলায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনেও আমরা তাই র্যাবের হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হতে দেখলাম। এমন বেপরোয়া আচরণ তারা কোত্থেকে শিখেছিল, সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়। শেষতক অবশ্য তাদের যেতেই হয়েছে জবরদখল করা ক্ষমতা ছেড়ে। আর সে খবর প্রাপ্তির মুহূর্তটি ছিল অসাধারণ। বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আন্দোলনকারীদের দেখা গেল পিচঢালা রাজপথ চুম্বন করতে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে গেল মোনাজাতে। লাখ লাখ মানুষ গণভবন আর সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ার ঘটনাও ছিল জনতার সুতীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বিশ্বে এর চেয়ে বড় কোনো পরিবর্তন দেখতে পায়নি ২০২৪-এ। বাংলাদেশে বহুল প্রতীক্ষিত ‘রেজিম চেইঞ্জের’ মাধ্যমে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা তারা খুঁজে পানি। হাসিনা-পরবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটে চলেছে, তাতে প্রত্যাশিতভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না; দেশটি সঠিক পথে ধাবমান কি না—এসব প্রশ্নে পত্রিকাটির মূল্যায়নের সঙ্গে অবশ্য সবাই একমত হবেন না। তবে মানতে হবে, দেশে একটা ‘পাটাতন পরিবর্তন’ হয়েছে। প্রতিপক্ষ সবাইকে দমন-পীড়ন এবং বারবার তামাশার নির্বাচন করে যারা দেশটা দখলে নিয়েছিল, তারা আর নেই দৃশ্যপটে। স্তরে স্তরে সাজানো তাদের তল্পিবাহকেরাও উধাও। দেশের ‘বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের’ সিংহভাগটাও মাথা বিকিয়ে দিয়ে বসেছিল। পরিবর্তনের ধাক্কায় তারাও লাপাত্তা। মিডিয়ার পরিবর্তনও সবার চোখে পড়ছে। এ নিয়ে আবার ঘটে চলেছে নানা বিতর্কিত ঘটনা। তবে বলা যাবে না, এর সবই ‘অপ্রত্যাশিত’। এমন ধারার পরিবর্তনের পর এসব ঘটে থাকে বৈকি। এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও হিমশিম খান ‘ঘটনার ঘনঘটা’ রোধে। শৃঙ্খলা ফেরানো ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কাজ এ ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে থাকে।
হাসিনা সরকার রাজনীতিতে এত দৃশ্যমান অনাচার করেছিল এবং শেষ দিকে আন্দোলন দমনে এমন খুনখারাবিতে নেমেছিল যে, অর্থনীতির কতটা সর্বনাশ তারা করে গেছে, সেটা খুব আলোচনায় আসছে না। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনীতির ওপর হালে যে ‘শ্বেতপত্র’ পেশ হয়েছে, তার কিছু বিবরণ লুণ্ঠনের পুরোনো গল্পগুলোকেও হার মানায়। বিস্ময় জাগায় এমনকি তাঁদের মনে, যাঁরা আর্থিক অপরাধ বিষয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করে থাকেন। একই দিনে কোম্পানি খুলে সেদিনই প্রস্তাব পাঠিয়ে এবং তার পরদিনই বোর্ডে অনুমোদন করিয়ে বিপুল ব্যাংকঋণ হাতিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, যার নেপথ্যে ছিলেন রাজধানীর একজন আলোচিত এমপি। ব্যাংক খাতে জনগণের আমানত লুণ্ঠনের এমন নজির অনেক। অথচ এসব ব্যাংক থেকে ৫-১০ লাখ টাকা ঋণ নিতে গিয়েও ‘নিয়মবিধি’ মানতে মানতে পেরেশান হতে হয়েছে খুদে উদ্যোক্তাদের। খোদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে এমন যা যা হয়েছে, সেগুলো বন্ধ করে এর বিপরীত সংস্কৃতি চালু করা তো মুখের কথা নয়। দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠান; বেকার হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে নতুন করে কাজ পাওয়া যখন কঠিন, তখন আবার বাড়াতে হচ্ছে বেকারত্ব! ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক রক্ষায় নতুন গভর্নরকে বদলাতে হচ্ছে বিঘোষিত নীতি। সেটা নিয়ে হচ্ছে আবার সমালোচনা। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানোর হীন তৎপরতাও ছিল হাসিনা শাসনামলে। আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেটা দ্রুত কমিয়ে আনার সুযোগও নেই। এ কারণে বিশেষত নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্য থেকে সমালোচনা কম জুটছে না নতুন সরকারের কপালে। পরিবর্তনের নায়ক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ওপর গালমন্দও বর্ষিত হচ্ছে অতিরিক্ত হতাশ লোকজনের মধ্য থেকে। আকাশচুম্বী প্রত্যাশার চাপে এমন পরিস্থিতির উদ্ভবও অস্বাভাবিক নয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতিও ঘটছে না। সেটা কেবল পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ নয়; মাঠে থাকা সেনাবাহিনীর সংযত ভূমিকার কারণেও এবং ইউনূস সরকার যথাসম্ভব কম শক্তি প্রয়োগে দেশ চালাতে চাইছে বলে। জনপ্রশাসনে দ্রুত আর ব্যাপক পরিবর্তন তারা আনেননি বলে সেখান থেকেও অসহযোগিতা এবং হালে বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ ধরনের প্রশাসন দিয়ে সরকারি কাজে গতি আনাটাই যখন কঠিন, তখন আশা করা যায় না—এরা বেসরকারি খাতকে উচিত সহায়তা জোগাবে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি স্বভাবতই কমে যাবে অনেক। তাতে মানুষের রুজি-রোজগার বাড়বে না; অনটনও কাটবে না তেমন। এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত ও তার মিত্রদের দিক থেকে কমছে না প্রত্যাঘাত। এদের ভেতরে নেই কোনো উপলব্ধির উন্মেষ। মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে আবার সংস্কারের জন্য নেওয়া সরকারের উদ্যোগ বড় মাপে অবাস্তবায়িত থেকে যাওয়ার শঙ্কাই বেশি। গণ-অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা শিক্ষার্থীদের যাঁরা এখনো রাজনীতিতে জড়িয়ে, তাঁদের মধ্যে আছে বিপুল পরিবর্তনের জন্য অস্থিরতা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটা আন্দোলন ও পাটাতন পরিবর্তন থেকে কতখানি প্রাপ্তি সম্ভব, সে বিষয়ে তারা এখন সঠিক মূল্যায়নে পৌঁছাতে পারলেই ভালো। নইলে তাদের তৎপরতায়ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটে কি না, সেই শঙ্কা যুক্ত হয়েছে এরই মধ্যে।
নজিরবিহীন অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এর কিছুই অবশ্য ‘অপ্রত্যাশিত’ নয়। দেশে দেশে, কালে কালে এসব ঘটতে ঘটতে ভিন্নধারার সংকটও এসে উপস্থিত হতে দেখা যায়। কিন্তু তাতে স্বৈরশাসক এবং স্তরে স্তরে বিন্যস্ত তার সহযোগীদের ‘সোনালি অতীত’ ফিরে আসে না। তাদের সংশোধিত হতেও দেখা যায় কমই। ভালো হতো এদের নিরপরাধ অংশটি পুরোনো নেতৃত্ব বিসর্জন দিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়ায় এসে যোগদান করলে। ক্ষমতায় ফিরতে না পারলেও তাদের রাজনীতিতে ফেরাটা গুরুত্বহীন নয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের গৌরব ছিল যে দলটির, গণতন্ত্র হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অধঃপতিত হয়ে রাজনীতি থেকে তার এমন প্রস্থান তো স্বাভাবিক নয়। তার পরও নিজ অপরাধকর্ম না দেখে যদি সে কেবলই দেখতে থাকে ‘চক্রান্ত’, তবে তাকে পথ দেখাবে কে?
তা-ও ভালো, দেশে একটি মধ্যপন্থী বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে—নির্বাচনে যাদের জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা বিপুল। ‘জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারে’ ফিরে যাওয়ার তো কোনো বিকল্প নেই, যে প্রক্রিয়াটি ধ্বংস করে দিয়েছিল হাসিনা সরকার। বিপুল আত্মত্যাগে তার উৎখাত ঘটানোর কোনো বিকল্পও বোধ হয় ছিল না। পইপই করে তাকে পরিস্থিতিটা বোঝাতে চেয়েছেন এমনকি পশ্চিমারা, চব্বিশের নির্বাচনটির আগেও। কিন্তু তিনি বোঝেননি; বরং ‘আঞ্চলিক মুরব্বিকে’ ধরেছেন আরও শক্তভাবে। সেই মুরব্বির অপচ্ছায়াও কিন্তু অপসারিত হয়েছে এই গণ-অভ্যুত্থানে। ‘বিপ্লব’ না হলেও ঘটনাটি তাই বিপ্লবাত্মক। আর এতে অবদান রেখেছে অতীতের সব ব্যর্থ আন্দোলন, মানুষের ক্রন্দন ও আর্তনাদ। গণ-অভ্যুত্থান পুরোপুরি বদলে দেয়নি দেশটি; তবে এর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সেটি গ্রহণে অপারগতা কিংবা ব্যর্থতা আমাদের ঠেলে দিতে পারে বিপথে। সেই আশঙ্কা মাথায় রাখা ভালো। তাতে মাথা ঠান্ডা রাখার কাজটিও হয়তো সহজতর হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
২০২৪ সালটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের জন্য। সেনা অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সরকারের পতন তো আরও কয়েকবার হয়েছে। মাঝে নব্বইয়ের ‘গণ-আন্দোলনে’ অবসান ঘটে সেনাশাসনের। তারপর আর সেনাশাসন না এলেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। তাদের হাতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা হাসিনা সরকার একটি নজিরবিহীন স্বৈরশাসন কায়েম করবে, এটা কিন্তু কেউ চিন্তা করতে পারেনি। সরকারি চাকরিতে কোটার প্রশ্ন ঘিরে সৃষ্ট আন্দোলন শেষে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে দ্রুতই এই সরকারের পতন ঘটাবে, এটাও ভেবে উঠতে পারেনি কেউ। সেটাই ঘটেছে চব্বিশের ৫ আগস্ট।
এর মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসা গোটা সরকার ও তার সহযোগীদের পালিয়ে যাওয়ার নজির কমই পাওয়া যাবে। পুলিশও গিয়েছিল লাপাত্তা হয়ে। চাকরিতে ফিরে তারা এখনো প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করতে পারছে না। নতুন ডিএমপি কমিশনার হালে বলেছেন, সরকার পতনের ৭২ ঘণ্টা আগেও ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ নিতে পারলে বেশ কিছু প্রাণহানি এড়ানো যেত। আন্দোলন চলাকালে এবং তা জয়যুক্ত হওয়ার পর পুলিশ হত্যার ঘটনাও কম ঘটেনি। থানা ও কারাগার আক্রান্ত হওয়ার সময় আগ্নেয়াস্ত্রও কম লুট হয়নি। ভালো যে, শেষ দিকে হলেও সেনাবাহিনী অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতার পক্ষে। হাসিনা সরকারের সঙ্গে তার দল ও জোটের একান্ত অনুগতরা এবং বিশেষ করে পুলিশ শেষ পর্যন্ত ছিল পরিবর্তনকামী জনতার বিরুদ্ধে। এদের হাতে হাসিনার ভারতে চলে যাওয়ার দিনও বহু আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটে। ‘আত্মরক্ষার্থেও’ তারা গুলি চালায়। ডিএমপি কমিশনার ঠিকই বলেছেন, শেষ সময়েও সেনাবাহিনীর মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হলে তা এড়ানো যেত। তবে সেটা বোধ হয় অসম্ভব ছিল ‘হাসিনা রেজিম’ পুলিশের চরিত্র আমূল বদলে ফেলায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনেও আমরা তাই র্যাবের হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হতে দেখলাম। এমন বেপরোয়া আচরণ তারা কোত্থেকে শিখেছিল, সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়। শেষতক অবশ্য তাদের যেতেই হয়েছে জবরদখল করা ক্ষমতা ছেড়ে। আর সে খবর প্রাপ্তির মুহূর্তটি ছিল অসাধারণ। বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আন্দোলনকারীদের দেখা গেল পিচঢালা রাজপথ চুম্বন করতে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে গেল মোনাজাতে। লাখ লাখ মানুষ গণভবন আর সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ার ঘটনাও ছিল জনতার সুতীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বিশ্বে এর চেয়ে বড় কোনো পরিবর্তন দেখতে পায়নি ২০২৪-এ। বাংলাদেশে বহুল প্রতীক্ষিত ‘রেজিম চেইঞ্জের’ মাধ্যমে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা তারা খুঁজে পানি। হাসিনা-পরবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটে চলেছে, তাতে প্রত্যাশিতভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না; দেশটি সঠিক পথে ধাবমান কি না—এসব প্রশ্নে পত্রিকাটির মূল্যায়নের সঙ্গে অবশ্য সবাই একমত হবেন না। তবে মানতে হবে, দেশে একটা ‘পাটাতন পরিবর্তন’ হয়েছে। প্রতিপক্ষ সবাইকে দমন-পীড়ন এবং বারবার তামাশার নির্বাচন করে যারা দেশটা দখলে নিয়েছিল, তারা আর নেই দৃশ্যপটে। স্তরে স্তরে সাজানো তাদের তল্পিবাহকেরাও উধাও। দেশের ‘বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের’ সিংহভাগটাও মাথা বিকিয়ে দিয়ে বসেছিল। পরিবর্তনের ধাক্কায় তারাও লাপাত্তা। মিডিয়ার পরিবর্তনও সবার চোখে পড়ছে। এ নিয়ে আবার ঘটে চলেছে নানা বিতর্কিত ঘটনা। তবে বলা যাবে না, এর সবই ‘অপ্রত্যাশিত’। এমন ধারার পরিবর্তনের পর এসব ঘটে থাকে বৈকি। এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও হিমশিম খান ‘ঘটনার ঘনঘটা’ রোধে। শৃঙ্খলা ফেরানো ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কাজ এ ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে থাকে।
হাসিনা সরকার রাজনীতিতে এত দৃশ্যমান অনাচার করেছিল এবং শেষ দিকে আন্দোলন দমনে এমন খুনখারাবিতে নেমেছিল যে, অর্থনীতির কতটা সর্বনাশ তারা করে গেছে, সেটা খুব আলোচনায় আসছে না। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনীতির ওপর হালে যে ‘শ্বেতপত্র’ পেশ হয়েছে, তার কিছু বিবরণ লুণ্ঠনের পুরোনো গল্পগুলোকেও হার মানায়। বিস্ময় জাগায় এমনকি তাঁদের মনে, যাঁরা আর্থিক অপরাধ বিষয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করে থাকেন। একই দিনে কোম্পানি খুলে সেদিনই প্রস্তাব পাঠিয়ে এবং তার পরদিনই বোর্ডে অনুমোদন করিয়ে বিপুল ব্যাংকঋণ হাতিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, যার নেপথ্যে ছিলেন রাজধানীর একজন আলোচিত এমপি। ব্যাংক খাতে জনগণের আমানত লুণ্ঠনের এমন নজির অনেক। অথচ এসব ব্যাংক থেকে ৫-১০ লাখ টাকা ঋণ নিতে গিয়েও ‘নিয়মবিধি’ মানতে মানতে পেরেশান হতে হয়েছে খুদে উদ্যোক্তাদের। খোদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে এমন যা যা হয়েছে, সেগুলো বন্ধ করে এর বিপরীত সংস্কৃতি চালু করা তো মুখের কথা নয়। দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠান; বেকার হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে নতুন করে কাজ পাওয়া যখন কঠিন, তখন আবার বাড়াতে হচ্ছে বেকারত্ব! ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক রক্ষায় নতুন গভর্নরকে বদলাতে হচ্ছে বিঘোষিত নীতি। সেটা নিয়ে হচ্ছে আবার সমালোচনা। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানোর হীন তৎপরতাও ছিল হাসিনা শাসনামলে। আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেটা দ্রুত কমিয়ে আনার সুযোগও নেই। এ কারণে বিশেষত নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্য থেকে সমালোচনা কম জুটছে না নতুন সরকারের কপালে। পরিবর্তনের নায়ক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ওপর গালমন্দও বর্ষিত হচ্ছে অতিরিক্ত হতাশ লোকজনের মধ্য থেকে। আকাশচুম্বী প্রত্যাশার চাপে এমন পরিস্থিতির উদ্ভবও অস্বাভাবিক নয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতিও ঘটছে না। সেটা কেবল পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ নয়; মাঠে থাকা সেনাবাহিনীর সংযত ভূমিকার কারণেও এবং ইউনূস সরকার যথাসম্ভব কম শক্তি প্রয়োগে দেশ চালাতে চাইছে বলে। জনপ্রশাসনে দ্রুত আর ব্যাপক পরিবর্তন তারা আনেননি বলে সেখান থেকেও অসহযোগিতা এবং হালে বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ ধরনের প্রশাসন দিয়ে সরকারি কাজে গতি আনাটাই যখন কঠিন, তখন আশা করা যায় না—এরা বেসরকারি খাতকে উচিত সহায়তা জোগাবে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি স্বভাবতই কমে যাবে অনেক। তাতে মানুষের রুজি-রোজগার বাড়বে না; অনটনও কাটবে না তেমন। এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত ও তার মিত্রদের দিক থেকে কমছে না প্রত্যাঘাত। এদের ভেতরে নেই কোনো উপলব্ধির উন্মেষ। মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে আবার সংস্কারের জন্য নেওয়া সরকারের উদ্যোগ বড় মাপে অবাস্তবায়িত থেকে যাওয়ার শঙ্কাই বেশি। গণ-অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা শিক্ষার্থীদের যাঁরা এখনো রাজনীতিতে জড়িয়ে, তাঁদের মধ্যে আছে বিপুল পরিবর্তনের জন্য অস্থিরতা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটা আন্দোলন ও পাটাতন পরিবর্তন থেকে কতখানি প্রাপ্তি সম্ভব, সে বিষয়ে তারা এখন সঠিক মূল্যায়নে পৌঁছাতে পারলেই ভালো। নইলে তাদের তৎপরতায়ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটে কি না, সেই শঙ্কা যুক্ত হয়েছে এরই মধ্যে।
নজিরবিহীন অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এর কিছুই অবশ্য ‘অপ্রত্যাশিত’ নয়। দেশে দেশে, কালে কালে এসব ঘটতে ঘটতে ভিন্নধারার সংকটও এসে উপস্থিত হতে দেখা যায়। কিন্তু তাতে স্বৈরশাসক এবং স্তরে স্তরে বিন্যস্ত তার সহযোগীদের ‘সোনালি অতীত’ ফিরে আসে না। তাদের সংশোধিত হতেও দেখা যায় কমই। ভালো হতো এদের নিরপরাধ অংশটি পুরোনো নেতৃত্ব বিসর্জন দিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়ায় এসে যোগদান করলে। ক্ষমতায় ফিরতে না পারলেও তাদের রাজনীতিতে ফেরাটা গুরুত্বহীন নয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের গৌরব ছিল যে দলটির, গণতন্ত্র হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অধঃপতিত হয়ে রাজনীতি থেকে তার এমন প্রস্থান তো স্বাভাবিক নয়। তার পরও নিজ অপরাধকর্ম না দেখে যদি সে কেবলই দেখতে থাকে ‘চক্রান্ত’, তবে তাকে পথ দেখাবে কে?
তা-ও ভালো, দেশে একটি মধ্যপন্থী বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে—নির্বাচনে যাদের জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা বিপুল। ‘জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারে’ ফিরে যাওয়ার তো কোনো বিকল্প নেই, যে প্রক্রিয়াটি ধ্বংস করে দিয়েছিল হাসিনা সরকার। বিপুল আত্মত্যাগে তার উৎখাত ঘটানোর কোনো বিকল্পও বোধ হয় ছিল না। পইপই করে তাকে পরিস্থিতিটা বোঝাতে চেয়েছেন এমনকি পশ্চিমারা, চব্বিশের নির্বাচনটির আগেও। কিন্তু তিনি বোঝেননি; বরং ‘আঞ্চলিক মুরব্বিকে’ ধরেছেন আরও শক্তভাবে। সেই মুরব্বির অপচ্ছায়াও কিন্তু অপসারিত হয়েছে এই গণ-অভ্যুত্থানে। ‘বিপ্লব’ না হলেও ঘটনাটি তাই বিপ্লবাত্মক। আর এতে অবদান রেখেছে অতীতের সব ব্যর্থ আন্দোলন, মানুষের ক্রন্দন ও আর্তনাদ। গণ-অভ্যুত্থান পুরোপুরি বদলে দেয়নি দেশটি; তবে এর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সেটি গ্রহণে অপারগতা কিংবা ব্যর্থতা আমাদের ঠেলে দিতে পারে বিপথে। সেই আশঙ্কা মাথায় রাখা ভালো। তাতে মাথা ঠান্ডা রাখার কাজটিও হয়তো সহজতর হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
স্বভাবতই মানুষ নিঃসঙ্গ। অনুষ্ঠান, উৎসব, আড্ডা, মিলনসভার যেকোনো সুযোগই তাকে উৎফুল্ল করে তোলে, একটা প্রেরণার সৃষ্টি হয়, নতুন করে জীবনের একটা ছবি এসে ধরা দেয়। আমাদের দেশে সে জন্যই বারো মাসে তেরো পার্বণ। প্রাচ্য দেশজুড়েই।
১২ ঘণ্টা আগে‘৪৩তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমবার গেজেটভুক্ত হই। ওই গেজেট বাতিল করে পুনরায় যখন গেজেট হলো, দেখি আমার নামটা নেই। কখনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত ছিলাম না। বরং আরেকটা সরকারি চাকরি করছি। কেন আমাকে গেজেট থেকে বাদ দেওয়া হলো জবাব কে দেবে?’
১২ ঘণ্টা আগেফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ (এফবিএস) আয়োজিত ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী জাতীয় সংলাপ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ ডিসেম্বর ছিল এ সংলাপের শেষ দিন। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেপ্রতিটি নতুন বছরের আগমনে প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাস্তবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ আর হয় না, অধরাই থেকে যায়। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে নিক্ষিপ্ত হয়। এবারও যে তার ব্যতিক্রম ঘটবে না, সেটাও সার্বিক বিবেচনায় অনায়াসে বলা যায়। দেশের সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে তা স্বীকার করতেই হবে।
২ দিন আগে