বাংলাদেশের আমলা শাসন

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী 
আপডেট : ১৯ মে ২০২২, ১৫: ৫১
Thumbnail image

আমরা আমলাতন্ত্রের নিন্দা করি। লেখালেখিও করি তার বিরুদ্ধে। কিন্তু আমলা ছাড়া দেশ চলে না। বিদেশিরা বলে, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র দুর্নীতিপরায়ণ ও অযোগ্য। অভিযোগটি অসত্য নয়। আমলারা যদি দুর্নীতিপরায়ণ হয়েও যোগ্য হন, তাহলে দেশ খারাপ চলে না। আমলারা জানেন, দুর্নীতি করতে হলেও কতটা করতে হয়। যেন দেশের সমূহ সর্বনাশ না হয়। নাহিদ সাহেব শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে একটা সত্য কথা বলে বিপদে পড়েছিলেন। তিনি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সবাই আমরা খাই, তবে আমার উপদেশ–একটু হিসাব করে খান, ভাই।’

এই উপদেশটি ব্রিটিশ আমলের আইসিএস অফিসাররা মেনে চলতেন, নাহিদ সাহেব বলার বহু আগে। ব্রিটিশ আমলের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ঝানু অফিসাররা সবাই ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন, তা নয়। কিন্তু দুর্নীতি কতটা হিসাব করে করতে হয়, তা তাঁরা জানতেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখন অফিসকক্ষে বসে চিৎকার করে ডাকতেন: ‘রবার্টসন’। তাঁর চিৎকার শুনে ইংরেজ চিফ সেক্রেটারি শশব্যস্ত হয়ে তাঁর রুমে এসে দাঁড়াতেন। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি না দিলে চেয়ারে বসতেন না। আর পাকিস্তান আমলে আতাউর রহমান খান যখন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, তখনকার পাঞ্জাবি চিফ সেক্রেটারি নিয়াজ মোহাম্মদ খান মুখ্যমন্ত্রীর রুমে ঢুকলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন।

এখানেই আসে যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের কথা। যোগ্যতা থাকলে চরিত্রে ব্যক্তিত্বের যোগ হয়। ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় আমলাদেরও এই যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব ছিল। তখন লেখাপড়ায় মেধাবী ছাত্র ছাড়া কেউ আইসিএস হতে যেতেন না। অরবিন্দ ঘোষ, সুহাস চন্দ্র বসুর মতো জাঁদরেল রাজনৈতিক দুই নেতা আইসিএস অফিসার হতে লন্ডনে গিয়েছিলেন। ভালোভাবে পাস করেও তাঁরা আইসিএস অফিসার হননি। রাজনীতিতে চলে এসেছিলেন। তখনকার দিনে দেশের মেধাবী ছাত্ররা কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে আইসিএস অফিসার হতেন। চাকরিজীবনে তাঁরা কেউ কেউ সৎ না হলেও দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বারবার মন্ত্রিসভা বদল হয়েছে। কখনো হক সাহেব, কখনো নাজিমুদ্দীন, কখনো শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার নেতা। সিভিল সার্ভিসের লোকজন সব মন্ত্রিসভাকেই আনুগত্য দেখিয়েছেন। এখনকার মতো রাজনৈতিক দলাদলিতে অংশ নেননি।

পাকিস্তান আমলেও সিএসপি তথা সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের বাঙালি অফিসাররা অযোগ্য ছিলেন না। পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসের ট্রেনিং তখন লন্ডনের বদলে লাহোরে হতো। আমি একবার লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে দুদিন আমার কয়েকজন বন্ধুর গেস্ট হয়ে ছিলাম। তাঁদের উচ্চমানের লেখাপড়া, ঘোড়ায় চড়াসহ নানা বিদ্যাশিক্ষা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা তখন লক্ষ করেছি।

আবুল এহসান, এ কে এম আহসান, রুহুল কুদ্দুস, ফজলুর রহমান, ফারুক আহমদ চৌধুরীর মতো আরও অনেক উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য অফিসার আমরা পেয়েছি। তাঁরাও বাংলাদেশি ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কী হলো? সিভিল সার্ভিসের শিক্ষা, যোগ্যতা সব যেন উবে গেছে। এখন বিসিএস অফিসার হওয়ার জন্য লন্ডনে বা লাহোরে দৌড়াতে হয় না। ঢাকাতেই তাঁরা তৈরি হন। কিন্তু মান আগের মতো নেই। তার ওপর দলীয় সংকীর্ণতা এবং দুর্নীতি যুক্ত হয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকেরাই বিসিএস হন, পুলিশ অফিসার হন। বিসিএস পরীক্ষা পাস না করেও অনেকে দুর্নীতির সাহায্যে পরীক্ষায় পাস করে যান। অভিযোগ পাওয়া যায় বিচার বিভাগ ও শিক্ষা বিভাগ সম্পর্কেও। 

দুর্নীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশাসনের দলীয়করণ। এটা শুরু হয় বিএনপি আমল থেকে। অমুকের বাবা বা চাচা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন, সেই অপরাধে তাঁদের ছেলে কিংবা ভাইপোকে যতই যোগ্যতা থাক, তাড়াও প্রশাসন থেকে। তাঁর বদলে দলের সমর্থক কোনো অযোগ্য, অপদার্থ ব্যক্তিকে বসাও এনে উচ্চপদে। শুধু প্রশাসনে নয়; বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগেও এই কদাচার চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাবেক পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের নিরপেক্ষতার জন্য রমেশ চন্দ্র মজুমদার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘকাল উপাচার্য ছিলেন। পাকিস্তান আমলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো জ্ঞানী পণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেননি। পাকিস্তান সরকার তাঁর জ্ঞান ও যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি।

বর্তমানে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক এমনকি উপাচার্য নিযুক্ত করার রেওয়াজ প্রবর্তিত হওয়ায় অবস্থা ক্ষেত্রবিশেষে এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই–এমন ব্যক্তিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হচ্ছেন। ফলে দেশে উচ্চশিক্ষার মান যে কোথায় নেমে গেছে, তার বিচার কে করে! বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের সর্বত্রই এখন চলছে এই অযোগ্যতার তাণ্ডব। বিএনপি আমলে এটা শুরু হয়, আওয়ামী লীগ আমলেও একই নীতি অনুসৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে সুশাসন দূরের কথা, শাসনব্যবস্থায় যে দুর্বিষহ অরাজকতা চলছে, তার মূল কারণ দুটি–অযোগ্যতা ও দুর্নীতি। দুটি-ই বাংলাদেশে ভয়াবহভাবে বাড়ছে।

এবার করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি একা দক্ষতা দেখালে কী হবে! তাঁর প্রশাসন তো অযোগ্য ও নড়বড়ে। ঈদ উপলক্ষে লকডাউন শিথিল করা এবং তা আবার কঠোর করার ব্যাপারে বর্তমান প্রশাসন যে চরম অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেখিয়েছে, তা ব্রিটেনে হলে একাধিক মন্ত্রী ও সচিবের চাকরি যেত। কিন্তু বাংলাদেশে অযোগ্যতাই চাকরি পাওয়া ও পদোন্নতির যোগ্যতা। সুতরাং এই অরাজকতার জন্য দায়ী মন্ত্রী ও সচিবেরা বহাল তবিয়তে আছেন। ভুগেছে সাধারণ মানুষ।  

সরকার একদিকে গণপরিবহনব্যবস্থা বন্ধ রেখেছে, অন্যদিকে কলকারখানার মালিকদের চাপে তাঁদের কলকারখানাগুলো খুলে দিয়েছে। আকস্মিকভাবে অফিস, কলকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় মানুষ কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকার দিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ছুটেছে। অথচ গণপরিবহন বন্ধ। আবদুল্লাহপুর থেকে এক নারীকে কোলে দুই বাচ্চা এবং মাথায় বিরাট বস্তা নিয়ে হেঁটে আসার মর্মান্তিক ছবি দেখেছি। লন্ডনে হিটলারের ভি-রকেট পড়ার সময় বিধ্বস্ত এলাকা থেকে লোক অপসারণেও এমন অব্যবস্থা দেখা যায়নি। অথচ ঢাকায় বোমা পড়েনি।

বাংলার মানুষ বড় দুঃখসহা জাতি। তাই মনুষ্যসৃষ্ট সব অরাজকতাই মুখ বুজে সহ্য করে। প্যারিসে বা বার্লিনে সাধারণ বাস ও লরি ধর্মঘটে রাজপথে অরাজকতা সৃষ্টি হলে মানুষ বিদ্রোহী হয়। সেই বিদ্রোহ দমনে সরকার নাকানিচুবানি খায়। বাংলাদেশে করোনা মহামারির শুরুতে শেখ হাসিনাকে দেখা গেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। তারপর কী হলো? তিনি দুনিয়ার সব জায়গা থেকে টিকা আনছেন। সেই টিকা দেওয়ার কাজেও চলছে বহু স্থানে অব্যবস্থা। টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, দেশের মানুষ যেন লকডাউন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তার ব্যবস্থা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। তাতে লাভ কী! যে মন্ত্রী নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বিলাতে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যাঁরা জনমত গঠনে দিনরাত কাজ করেছেন, তাঁদের একটা তালিকা তৈরি করে যথোচিতভাবে সম্মানিত করতে পারেননি, সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবেরা পারবেন দেশের মানুষকে লকডাউন মানতে উদ্বুদ্ধ করার কাজে যোগ্যতা দেখাতে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে পার্মানেন্ট ব্যুরোক্রেট নেই। প্রেসিডেন্ট বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও বদল হয়ে যান। ওয়েস্টমিনস্টার ডেমোক্রেসিতে একটি শিক্ষিত ও স্থায়ী ব্যুরোক্রেসি রাখার উদ্দেশ্য, জনপ্রতিনিধিদের দেশ শাসনের নীতি ও উদ্দেশ্য এই ব্যুরোক্রেসি যোগ্যতার সঙ্গে কার্যকর করবে। এটা সব সময় ঘটে না। পাকিস্তান আমলে অযোগ্য মন্ত্রীর ভুলত্রুটি তাঁর যোগ্য সচিব শুধরে দিয়েছেন বহু সময়। বর্তমানে সমস্যা দেখা দিয়েছে, মন্ত্রীরা অধিকাংশই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ারও যোগ্য নন। অন্যদিকে তাঁদের অধিকাংশ সচিব লেখাপড়া ও যোগ্যতার দৌড়ে মন্ত্রীদের সমান। তাহলে দেশ চালাবে কে? দেশ চলবে কীভাবে?

কথায় কথায় অনেকে বলেন, সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। মন্ত্রীরা কী করবেন? তাঁদের ডিঙিয়ে সচিবেরা নাকি সব আদেশ-নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নেন। এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে হবে মন্ত্রীদেরও কোনো সমস্যায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা নেই। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করেন। তাঁদের সচিবেরাও তা-ই।

ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ অফিসাররা দেশের সাধারণ রাজনীতিকদের চেয়ে অধিক শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ছিলেন। এই অফিসাররা তাঁদের চেয়ে কম শিক্ষিত মন্ত্রীদের নির্দেশ মানবেন না–এই আশঙ্কায় গান্ধী নেহরুকে তাঁদের কাছে পরিচয় করিয়েছিলেন ‘হ্যারো বয়’ নামে।

নেহরু বিলাতের অভিজাত হ্যালো স্কুলের ছাত্র ছিলেন। অর্থাৎ নেহরু লেখাপড়া ও যোগ্যতায় আইসিএস অফিসারদের চেয়ে কম নন। মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় শের-ই-বাংলার আত্মীয় বিধায় সৈয়দ আফজাল নামে এক মোক্তারকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। তিনি ফাইলে সিগারেট বানান সি-এর বদলে এস দিয়ে লেখায় তাঁর মন্ত্রকের পাঞ্জাবের সেক্রেটারি সেই ফাইল মন্ত্রীর নাকের ওপরে ছুড়ে মেরেছিলেন।

আমলাতন্ত্র যদি শিক্ষিত, যোগ্য ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে দেশের জন্য ভালো। আমলা এবং তাঁদের মাথার ওপরে যাঁরা মন্ত্রী হয়ে বসেন, তাঁদের অধিকাংশ অদক্ষ, অযোগ্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ হলে দেশ চালাবে কে? এখন যে শেখ হাসিনা দেশ চালাচ্ছেন, তা নিজের যোগ্যতা, সাহস ও অভিজ্ঞতার বলে। মন্ত্রীদের সহযোগিতায় নয়। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 
 
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত