এ কে এম শামসুদ্দিন
১২ আগস্ট সিলেটে এক মতবিনিময় সভা শেষে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আমরা তো বেহেশতে আছি’। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে মন্দার ভাব আসছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও মন্দা এসেছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ইনফ্লেশন রেট নিচে আছে। আমরা তো সুখে আছি। বেহেশতে আছি বলতে হবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য নেট দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন বেহেশতের কথা বলে তিনি ‘নিষ্ঠুর’ মনোভাব দেখিয়েছেন বলেও সমালোচনা হচ্ছে।
ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মন্ত্রী মহোদয়ের দেওয়া বক্তব্যের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘বেহেশতে আছে বাংলাদেশের মানুষ’। পাশাপাশি আরেকটি শিরোনাম হলো, ‘দুজনের সংসারই চলে না, সন্তান কীভাবে নেব’! পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন দুই বক্তব্যের অমিলের জায়গা কোথায়।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রান্তিক মানুষের নিত্যদিনের জীবন যাপনের কী হাল তা ভুক্তভোগীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সেদিন রিকশায় একটি কাজে বাইরে বেরিয়েছিলাম। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতেই রিকশাচালক বকশিশের জন্য হাত বাড়ালেন। কিছু টাকা হাতে দিতেই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘স্যার, কইতে পারেন, আমরা যামু কই? হাত না বাড়াইয়া করমু কি? না খাইয়া মরণের দশা অইছে। কাঁচা মরিচ যদি ১৮০ টাকা কেজি কইরা কিনতে অয়, তাইলে আমাগোর মতো গরিবেরা যাইব কই? আর ওদিকে মন্ত্রীরা কইয়া বেড়াইতাছে আমরা নাকি বেহেশতে আছি। স্যার, বেহেশতে যাওয়া কি এতই সহজ?’
রিকশাচালকের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। বিষয়টি আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করতেই তিনি বলে বসলেন, ‘কেন? বেগুনের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা মিষ্টিকুমড়ো দিয়ে বেগুনি বানিয়ে খাইনি? দাম যখন বেড়েছেই, কাঁচা মরিচ না খেলেই তো চলে!’
বন্ধুর কথারও কোনো উত্তর দিইনি। মনে মনে ভেবেছি তিনি হয়তো কথার কথা বলেছেন। মানুষ এখন এমন একটি সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যে সংসারে নতুন সন্তান নিতেও সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে সর্বব্যাপী যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীরা উপলব্ধি করলেও সরকারের কিছু মন্ত্রী তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমে জনগণের সামনে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র যে চেষ্টা করছেন, তা সত্যিই হাস্যকর। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন দরিদ্র মানুষেরা যখন বেঁচে থাকার লড়াই করছে, তখন মন্ত্রীদের এসব অযৌক্তিক কথাবার্তা সত্যিই দুঃখজনক।
১০ আগস্ট সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘যারা আমাদের পছন্দ করে না, তারা বলছে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মারা
যাবে। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে সত্য, তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনো কেউ মারা যায়নি।’
একই তারিখে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশে কেউ না খেয়ে নেই। গায়ে জামা-কাপড় আছে।’ এর আগে ‘মানুষ চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে’ বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের আশার বাণী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ‘ভবিষ্যতে দারিদ্র্য দেখতে মিউজিয়ামে যেতে হবে’ মন্তব্যও সাধারণ মানুষের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এই দুর্মূল্যের বাজারে কতিপয় মন্ত্রীর এসব অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য যেন মানুষের কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা দেওয়ার মতো। মন্ত্রীদের এসব বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও বিরক্ত। তাঁরা বলেছেন, যাঁরা অরাজনৈতিক, তাঁদের মুখেই এসব শোভা পায়। প্রকৃত রাজনৈতিক নেতারা এসব কথা বলতে পারেন না। তাঁরা আরও বলেছেন, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন, তাঁদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মন্ত্রী হয়তো নিজের কথা বলেছেন। তবে সবাই কি সেটা মনে করেন? দলীয় নেতা-কর্মী, এমপি-মন্ত্রী সবাইকে আরও সতর্ক হয়ে কথা বলা উচিত।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মন্ত্রীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘জনমনের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলা উচিত নয়।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, প্রত্যেককে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে দায়িত্বশীল হতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো কথা বলা সমীচীন নয়। তিনি আরও বলেছেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশ আজকে একই সমস্যায় জর্জরিত। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও ভারতে মূল্য বাড়ছে; কেউ তো আরামে নেই। আর এটাকে কেন্দ্র করে সেই সব দেশের বিরোধী দলগুলো সরকার উৎখাতে নামেনি। আমরা আমাদের বিরোধী দলগুলোর সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কই, তারা তো কেউ এগিয়ে আসেনি; বরং উল্টো সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে।’ মন্ত্রী মহোদয়ের এ বক্তব্যের প্রশংসা করে আমার এক সহকর্মী বলেছেন, ‘ওবায়দুল কাদের অনেক বিষয়েই মূল্যবান কথা বলে থাকেন। বর্তমান সংকটকালে দলের কিছু এলিট মন্ত্রীর অযাচিত বক্তব্য দলের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি করছে, তা উপলব্ধি করে তিনি যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, এ পর্যন্ত ভালো ছিল। এ সময় বিরোধী দল প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন তা যদি মেনে নিতেও হয়, তাতেও হয়তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা ও প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন; একই সঙ্গে সেই সব দেশের সরকার ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া, তাদের শাসনব্যবস্থা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়ের তুলনামূলক ধারণা যদি দিতেন, তাহলে মনে হয় তাঁর বক্তব্যটি পরিপূর্ণ হতো। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা অনেক সময় দেখি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও মন্ত্রীরা কথায় কথায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ টেনে আনেন। তাঁদের এসব কথা শুনতে ভালো লাগত, যদি তাঁরা সেই সব দেশের গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে আমাদের দেশের গণতন্ত্রচর্চার পার্থক্যের কথা তুলে ধরলে তা জনগণের কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্য হতো। যখন যে বিষয়ের উদাহরণ দিলে তাঁদের এবং দলের স্বার্থ রক্ষা হবে, সেসব উদাহরণই সাধারণত দিতে দেখা যায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মাঝেমধ্যে এমন সব বেফাঁস কথা বলে বসেন, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মীই তাতে বিব্রত বোধ করেন। এর আগে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য দেশটিকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করার কথা সাংবাদিকদের জানিয়ে সমালোচিত হন তিনি। তারও আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর পর, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করতে গিয়ে বোমা ফাটানোর মতো কথা বলেছিলেন। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উভয় দেশের সম্পর্ক খুব ভালো, অনেকটা ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো’! তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে তখন তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে জার্মানি যাওয়ার সময় ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতার দৈনিক আজকাল পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। আজকালের ওই সাংবাদিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিস্তার পানি বা আসামের “জাতীয় নাগরিক পঞ্জি” পরিস্থিতি নিয়ে মোটেই চিন্তায় নেই বাংলাদেশ। উভয় দেশের সম্পর্ক আরও ভালো করতেই তিনি মন্ত্রী হয়ে প্রথমেই উড়ে গিয়েছিলেন দিল্লিতে।’
এই লেখাটি যখন শেষ করে এনেছি, তখন কানে এল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আপাতত সর্বশেষ বচনামৃত। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার দরকার, সেটি করতে ভারত সরকারকে তিনি অনুরোধ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই বক্তব্যেরও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কি ভারতের? পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে এমন বক্তব্যের পরও তিনি কীভাবে মন্ত্রিসভায় আছেন, তা-ও এক বড় বিস্ময়!
বাংলাদেশের জনগণ আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি রাজনৈতিক সচেতন। একটি কথা মনে রাখা ভালো, কিছু কিছু রাজনৈতিক ইস্যু আছে, যেসব ইস্যুতে সাধারণ জনগণের ভেতর যার যার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভাজন তৈরি হতে পারে। যে যার দলের পক্ষে কথা বলতে বা পক্ষ অবলম্বন করতে পারে। সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষের পেটে যখন আঘাত করা হয়, তখন সেটা আর বিভাজিত রাজনৈতিক ইস্যু থাকে না। সেটা তখন আপামর জনগণের কমন ইস্যু হয়ে যায়। সেখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। তখন তা দলমত-নির্বিশেষে সবার সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এদেশে এমন ঘটনা আগেও দেখেছি। আমরা কি সেই গ্রাম্য প্রবাদ বাক্যটির কথা ভুলে গেছি, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’! এখন যে পরিস্থিতি চলছে, ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, বলা যাচ্ছে না। কাজেই চলাফেরায়, কথাবার্তায় সতর্ক না হলে, কাজে-কর্মে এতটুকুও ভুল হলে, তার মাশুল যে কী দিয়ে দিতে হবে, তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। অতএব, ‘সাধু সাবধান’।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
১২ আগস্ট সিলেটে এক মতবিনিময় সভা শেষে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আমরা তো বেহেশতে আছি’। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে মন্দার ভাব আসছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও মন্দা এসেছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ইনফ্লেশন রেট নিচে আছে। আমরা তো সুখে আছি। বেহেশতে আছি বলতে হবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য নেট দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন বেহেশতের কথা বলে তিনি ‘নিষ্ঠুর’ মনোভাব দেখিয়েছেন বলেও সমালোচনা হচ্ছে।
ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মন্ত্রী মহোদয়ের দেওয়া বক্তব্যের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘বেহেশতে আছে বাংলাদেশের মানুষ’। পাশাপাশি আরেকটি শিরোনাম হলো, ‘দুজনের সংসারই চলে না, সন্তান কীভাবে নেব’! পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন দুই বক্তব্যের অমিলের জায়গা কোথায়।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রান্তিক মানুষের নিত্যদিনের জীবন যাপনের কী হাল তা ভুক্তভোগীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সেদিন রিকশায় একটি কাজে বাইরে বেরিয়েছিলাম। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতেই রিকশাচালক বকশিশের জন্য হাত বাড়ালেন। কিছু টাকা হাতে দিতেই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘স্যার, কইতে পারেন, আমরা যামু কই? হাত না বাড়াইয়া করমু কি? না খাইয়া মরণের দশা অইছে। কাঁচা মরিচ যদি ১৮০ টাকা কেজি কইরা কিনতে অয়, তাইলে আমাগোর মতো গরিবেরা যাইব কই? আর ওদিকে মন্ত্রীরা কইয়া বেড়াইতাছে আমরা নাকি বেহেশতে আছি। স্যার, বেহেশতে যাওয়া কি এতই সহজ?’
রিকশাচালকের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। বিষয়টি আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করতেই তিনি বলে বসলেন, ‘কেন? বেগুনের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা মিষ্টিকুমড়ো দিয়ে বেগুনি বানিয়ে খাইনি? দাম যখন বেড়েছেই, কাঁচা মরিচ না খেলেই তো চলে!’
বন্ধুর কথারও কোনো উত্তর দিইনি। মনে মনে ভেবেছি তিনি হয়তো কথার কথা বলেছেন। মানুষ এখন এমন একটি সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যে সংসারে নতুন সন্তান নিতেও সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে সর্বব্যাপী যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীরা উপলব্ধি করলেও সরকারের কিছু মন্ত্রী তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমে জনগণের সামনে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র যে চেষ্টা করছেন, তা সত্যিই হাস্যকর। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন দরিদ্র মানুষেরা যখন বেঁচে থাকার লড়াই করছে, তখন মন্ত্রীদের এসব অযৌক্তিক কথাবার্তা সত্যিই দুঃখজনক।
১০ আগস্ট সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘যারা আমাদের পছন্দ করে না, তারা বলছে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষ মারা
যাবে। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে সত্য, তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনো কেউ মারা যায়নি।’
একই তারিখে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশে কেউ না খেয়ে নেই। গায়ে জামা-কাপড় আছে।’ এর আগে ‘মানুষ চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে’ বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের আশার বাণী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ‘ভবিষ্যতে দারিদ্র্য দেখতে মিউজিয়ামে যেতে হবে’ মন্তব্যও সাধারণ মানুষের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এই দুর্মূল্যের বাজারে কতিপয় মন্ত্রীর এসব অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য যেন মানুষের কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা দেওয়ার মতো। মন্ত্রীদের এসব বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও বিরক্ত। তাঁরা বলেছেন, যাঁরা অরাজনৈতিক, তাঁদের মুখেই এসব শোভা পায়। প্রকৃত রাজনৈতিক নেতারা এসব কথা বলতে পারেন না। তাঁরা আরও বলেছেন, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন, তাঁদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মন্ত্রী হয়তো নিজের কথা বলেছেন। তবে সবাই কি সেটা মনে করেন? দলীয় নেতা-কর্মী, এমপি-মন্ত্রী সবাইকে আরও সতর্ক হয়ে কথা বলা উচিত।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মন্ত্রীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘জনমনের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলা উচিত নয়।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, প্রত্যেককে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে দায়িত্বশীল হতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো কথা বলা সমীচীন নয়। তিনি আরও বলেছেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশ আজকে একই সমস্যায় জর্জরিত। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও ভারতে মূল্য বাড়ছে; কেউ তো আরামে নেই। আর এটাকে কেন্দ্র করে সেই সব দেশের বিরোধী দলগুলো সরকার উৎখাতে নামেনি। আমরা আমাদের বিরোধী দলগুলোর সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কই, তারা তো কেউ এগিয়ে আসেনি; বরং উল্টো সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে।’ মন্ত্রী মহোদয়ের এ বক্তব্যের প্রশংসা করে আমার এক সহকর্মী বলেছেন, ‘ওবায়দুল কাদের অনেক বিষয়েই মূল্যবান কথা বলে থাকেন। বর্তমান সংকটকালে দলের কিছু এলিট মন্ত্রীর অযাচিত বক্তব্য দলের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি করছে, তা উপলব্ধি করে তিনি যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, এ পর্যন্ত ভালো ছিল। এ সময় বিরোধী দল প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন তা যদি মেনে নিতেও হয়, তাতেও হয়তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা ও প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন; একই সঙ্গে সেই সব দেশের সরকার ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া, তাদের শাসনব্যবস্থা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়ের তুলনামূলক ধারণা যদি দিতেন, তাহলে মনে হয় তাঁর বক্তব্যটি পরিপূর্ণ হতো। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা অনেক সময় দেখি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও মন্ত্রীরা কথায় কথায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ টেনে আনেন। তাঁদের এসব কথা শুনতে ভালো লাগত, যদি তাঁরা সেই সব দেশের গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে আমাদের দেশের গণতন্ত্রচর্চার পার্থক্যের কথা তুলে ধরলে তা জনগণের কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্য হতো। যখন যে বিষয়ের উদাহরণ দিলে তাঁদের এবং দলের স্বার্থ রক্ষা হবে, সেসব উদাহরণই সাধারণত দিতে দেখা যায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মাঝেমধ্যে এমন সব বেফাঁস কথা বলে বসেন, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মীই তাতে বিব্রত বোধ করেন। এর আগে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য দেশটিকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করার কথা সাংবাদিকদের জানিয়ে সমালোচিত হন তিনি। তারও আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর পর, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করতে গিয়ে বোমা ফাটানোর মতো কথা বলেছিলেন। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উভয় দেশের সম্পর্ক খুব ভালো, অনেকটা ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো’! তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে তখন তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে জার্মানি যাওয়ার সময় ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতার দৈনিক আজকাল পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। আজকালের ওই সাংবাদিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিস্তার পানি বা আসামের “জাতীয় নাগরিক পঞ্জি” পরিস্থিতি নিয়ে মোটেই চিন্তায় নেই বাংলাদেশ। উভয় দেশের সম্পর্ক আরও ভালো করতেই তিনি মন্ত্রী হয়ে প্রথমেই উড়ে গিয়েছিলেন দিল্লিতে।’
এই লেখাটি যখন শেষ করে এনেছি, তখন কানে এল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আপাতত সর্বশেষ বচনামৃত। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার দরকার, সেটি করতে ভারত সরকারকে তিনি অনুরোধ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই বক্তব্যেরও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কি ভারতের? পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে এমন বক্তব্যের পরও তিনি কীভাবে মন্ত্রিসভায় আছেন, তা-ও এক বড় বিস্ময়!
বাংলাদেশের জনগণ আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি রাজনৈতিক সচেতন। একটি কথা মনে রাখা ভালো, কিছু কিছু রাজনৈতিক ইস্যু আছে, যেসব ইস্যুতে সাধারণ জনগণের ভেতর যার যার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভাজন তৈরি হতে পারে। যে যার দলের পক্ষে কথা বলতে বা পক্ষ অবলম্বন করতে পারে। সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষের পেটে যখন আঘাত করা হয়, তখন সেটা আর বিভাজিত রাজনৈতিক ইস্যু থাকে না। সেটা তখন আপামর জনগণের কমন ইস্যু হয়ে যায়। সেখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। তখন তা দলমত-নির্বিশেষে সবার সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এদেশে এমন ঘটনা আগেও দেখেছি। আমরা কি সেই গ্রাম্য প্রবাদ বাক্যটির কথা ভুলে গেছি, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’! এখন যে পরিস্থিতি চলছে, ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, বলা যাচ্ছে না। কাজেই চলাফেরায়, কথাবার্তায় সতর্ক না হলে, কাজে-কর্মে এতটুকুও ভুল হলে, তার মাশুল যে কী দিয়ে দিতে হবে, তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। অতএব, ‘সাধু সাবধান’।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
২১ ঘণ্টা আগেসদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে নানা মাত্রিক আলোচনার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
২১ ঘণ্টা আগেতিন মাস পার হলো, আমরা একটি অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলের অধীনে আছি। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের অবসান ঘটেছে। অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছিল—সামাজিক সব বৈষম্যের অবসান ঘটবে, আমাদের সামগ্রিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে, প্রকৃত স্বাধীনতা..
২১ ঘণ্টা আগেচট্টগ্রামের আকবরশাহ থানার নাছিয়াঘোনা এলাকায় যাওয়া-আসা করতে গেলে বোঝা যায় সেটি দুর্গম এলাকা। এ কারণেই সেখানে বসানো হয়েছিল ফাঁড়ি। কিন্তু ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পুলিশের থানা ও ফাঁড়িগুলোয় যখন আক্রমণ করা হচ্ছিল, তখন নুরু আলম নুরু নামের এক সন্ত্রাসীও সে সুযোগ নেন। তিনি পুলিশের ফাঁড়ি দখল করে...
১ দিন আগে