ড. মইনুল ইসলাম
অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট ২০২৪ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধান সংস্কারের জন্য যে কমিশন গঠন করেছিল, তারা গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সরকারের প্রধান উপদেষ্টাঅধ্যাপক ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়েবসাইটে তাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন যখন নভেম্বর মাসে দেশের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিল, তখন আমাকেও ওই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
আমি সভায় সংবিধান সংস্কারে আমার প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেছিলাম, যেগুলো সবার প্রশংসা অর্জন করেছিল। পরে কমিশনের অনুরোধে আমি আমার প্রস্তাবগুলো লিখিতভাবে কমিশনে পেশ করেছিলাম। একই সঙ্গে প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে রচিত আমার একটি কলামও প্রথম আলোয় ২৫ নভেম্বর ২০২৪ প্রকাশিত হয়েছে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে আমার প্রস্তাবগুলোর প্রায় সবই কমিশনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। যেগুলো কমিশনের প্রস্তাবাবলির মধ্যে স্থান লাভ করেছে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে প্রদত্ত হলো:
নির্বাচনের প্রস্তাব;
কমিশনের ‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবটি অত্যন্ত ভালো প্রস্তাব। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে যেসব সাংবিধানিক কমিশন ও কমিটির চেয়ারপারসন ও সদস্য-সদস্যাদের নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে প্রধানমন্ত্রীর খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে এসব পদে নিয়োগের স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির অবসান হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বহুমাত্রিকতার সম্প্রসারণ ঘটবে। (এসব পদের জন্য তদবির সংস্কৃতিরও নিরসন ঘটবে)। একই সঙ্গে, সংসদের দুটি কক্ষেই ডেপুটি স্পিকারের আসনে একজন বিরোধী সদস্য-সদস্যার নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাবটিও অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচকদের সংখ্যার সম্প্রসারণও ভালো প্রস্তাব। আমি মনে করি, কলামে উল্লিখিত ১১টি মূল ক্ষেত্রে কমিশন যে প্রস্তাবাবলি পেশ করেছে, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করলে এ দেশের সংবিধান একটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হবে। আমি কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার প্রস্তাবগুলোকে তাদের সুপারিশমালার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমি ফোকাস করতে চাই কমিশনের কতগুলো অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর সুপারিশের দিকে।
১. প্রথমেই আমি উল্লেখ করব যে আমি সংবিধানের পুনর্লিখনের পক্ষপাতী নই, কারণ ১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের শাহাদাত এবং ২ লাখ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের আত্মত্যাগকে ধারণ করে রচিত হয়েছে। কীভাবে সংবিধানে বিভিন্ন একপেশে সংশোধনী সন্নিবেশিত হয়েছে, তা আমি ব্যাখ্যা করেছি। বর্তমান অবয়বে সংবিধানের মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, যেগুলো আমার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আমি ব্যাখ্যা করেছি। কমিশনও সেগুলো তাদের সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে তিনটিকে বদলে ফেলার যে সুপারিশ কমিশন প্রদান করেছে, সেগুলো একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর। কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ যে তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা রচনা করে বেতারে ভাষণ দিয়েছিলেন সেগুলো ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। চতুর্থ মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুসারে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরার পর। অতএব, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে ছুড়ে ফেলার অধিকার আমরা কাউকেই দিতে পারব না, তার কোনো প্রয়োজনও নেই।
২. কমিশনের সুপারিশকৃত ‘বহুত্ববাদ’ নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্নিহিত রয়েছে বলা হলেও সাধারণ জনগণের সেটা উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। তাই আমি এই সুপারিশটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছি, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া ঠিক হবে না।
৩. ঠিক একইভাবে আমি সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্রকে’ বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান জানাতে চাই। শ্রমজীবী জনগণের শোষণমুক্তি ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি। কেউ কেউ বলতে পারেন কমিশনের সুপারিশকৃত ‘সাম্য’ নীতির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকতেও পারে, কিন্তু সংবিধানে সমাজতন্ত্র গুরুত্বসহকারে মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলে জনগণের শোষণমুক্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে রাষ্ট্রের নীতিমালার মধ্যে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। অতএব, ‘সাম্য’ কথাটি দিয়ে সমাজতন্ত্রকে সংবিধান থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস আমার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির সর্বাত্মক সংগ্রামকে ধারণ করতে হলে সমাজতন্ত্রের কোনো ভালো বিকল্প ব্যবস্থা আজও আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও সমাজতন্ত্রের কোনো ‘একক গ্রহণযোগ্য মডেল’ বিশ্বের কোনো দেশে সফলভাবে আজও চালু করা যায়নি। (সংবিধানে ২০১০ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ফিরে আসা সত্ত্বেও দেশের শাসক মহলগুলো ১৫ বছর ধরে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ কট্টর পুঁজিবাদী ভার্সনটাই চালু রেখেছিল)। ‘সাম্য’ কথাটি দিয়ে সমাজতন্ত্রকে লুকিয়ে ফেলার প্রয়াস পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোকে খুশি করার প্রয়াস বলেই মনে হচ্ছে।
৪. ‘বহুত্ববাদ’ নীতির মধ্যে দেশের নানা জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মনে করা হয়, তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে যদি সংবিধানে ‘জাতিগত বহুত্ববাদ’ কথাটি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়, তাহলে আমি আপত্তি করব না।
৫. কমিশন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের’ পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামকরণের সুপারিশ দিয়েছে। ভারতের নাম ইংরেজিতে ‘রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া’ এবং বাংলায় ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্র’। ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধান চালু হওয়ার পর গত ৭৫ বছরে ব্যাপারটি নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। আমাদের কমিশন এই অপ্রয়োজনীয় নাম-পরিবর্তন কেন প্রয়োজনীয় মনে করল বুঝতে পারছি না। তবে, ‘জনগণতন্ত্রী’ কথাটি আপত্তিকর নয়। যেটা আপত্তিকর সেটা হলো একটি রাষ্ট্র ‘জনগণতন্ত্রী’ হলে সেখানে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে না থাকা। বিশ্বে যে কটি রাষ্ট্রের নাম জনগণতন্ত্রী, সেগুলোর সব কটিতে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
৬. কমিশন সংসদের নিম্নকক্ষে মোট সদস্যসংখ্যা ৪০০ জনে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে, যাঁদের মধ্যে ৩০০ জন বর্তমান পদ্ধতি অনুসারে নির্বাচিত হবেন এবং বাকি ১০০ জন নারী সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এই সুপারিশ নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করবে এই ১০০ নারী সদস্যর নির্বাচনী-এলাকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আমার প্রস্তাবে আমি বর্তমান ৩০০টি নির্বাচনী-এলাকার ১০০টিতে প্রতি নির্বাচনে শুধু নারী-সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা রোটেশন পদ্ধতিতে চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। (রোটেশন পদ্ধতিতে তিনটি নির্বাচনে দেশের সব এলাকায় নারী সদস্য নির্বাচিত হতেন)। আমি মনে করি, আমার প্রস্তাবটি কমিশনের প্রস্তাবের চেয়ে অনেক বেশি সহজে বাস্তবায়নযোগ্য হতো। কমিশনের সুপারিশকৃত ৪০০ আসনের নিম্নকক্ষ পুরুষ সদস্য এবং নারী সদস্যদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক অবশ্যম্ভাবী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি করবে ‘কমন নির্বাচনী এলাকাগুলোতে’। উপরন্তু, সংসদ কক্ষে অতিরিক্ত ৫০ জন নারী সদস্যের আসন-বিন্যাসেও স্থান-সংকুলানসংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টি করবে।
সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করার জন্য রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন কিংবা মূল নীতি পরিবর্তনের অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর প্রস্তাবগুলোর আবশ্যকতা নেই। এসব আপত্তিকর সুপারিশ কমিশনের সুপারিশমালাকে বিতর্কিত করছে। বর্তমান সংবিধানকে যেসব গোষ্ঠী ‘নালায় ছুড়ে ফেলতে’ উদগ্রীব, তারা প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-শিবিরের অনুসারী স্বাধীনতাবিরোধী মহল, যারা সুকৌশলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে ফেলেছে। জনগণের ৫ শতাংশও তাদের সমর্থন করে না। সংবিধান সংস্কারের অপরিহার্যতাকে স্বীকার করতে কারও দ্বিমত নেই, কারণ বর্তমান অবয়বে সংবিধান ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার দলিলে পরিণত হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালা এবং যে কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় সুপারিশ আমি পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিয়েছি, সেগুলোকে যথাযথভাবে পরিবর্তন করে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধানে সংশোধনীর প্রস্তাবাবলি নির্ধারিত হয় তাহলে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের পদক্ষেপ সফলভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে, আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতির বিষয়টিও সফলভাবে নিষ্পন্ন করা যাবে।
আরও খবর পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট ২০২৪ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধান সংস্কারের জন্য যে কমিশন গঠন করেছিল, তারা গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সরকারের প্রধান উপদেষ্টাঅধ্যাপক ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়েবসাইটে তাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন যখন নভেম্বর মাসে দেশের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিল, তখন আমাকেও ওই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
আমি সভায় সংবিধান সংস্কারে আমার প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেছিলাম, যেগুলো সবার প্রশংসা অর্জন করেছিল। পরে কমিশনের অনুরোধে আমি আমার প্রস্তাবগুলো লিখিতভাবে কমিশনে পেশ করেছিলাম। একই সঙ্গে প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে রচিত আমার একটি কলামও প্রথম আলোয় ২৫ নভেম্বর ২০২৪ প্রকাশিত হয়েছে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে আমার প্রস্তাবগুলোর প্রায় সবই কমিশনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। যেগুলো কমিশনের প্রস্তাবাবলির মধ্যে স্থান লাভ করেছে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে প্রদত্ত হলো:
নির্বাচনের প্রস্তাব;
কমিশনের ‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবটি অত্যন্ত ভালো প্রস্তাব। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে যেসব সাংবিধানিক কমিশন ও কমিটির চেয়ারপারসন ও সদস্য-সদস্যাদের নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে প্রধানমন্ত্রীর খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে এসব পদে নিয়োগের স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির অবসান হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বহুমাত্রিকতার সম্প্রসারণ ঘটবে। (এসব পদের জন্য তদবির সংস্কৃতিরও নিরসন ঘটবে)। একই সঙ্গে, সংসদের দুটি কক্ষেই ডেপুটি স্পিকারের আসনে একজন বিরোধী সদস্য-সদস্যার নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাবটিও অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচকদের সংখ্যার সম্প্রসারণও ভালো প্রস্তাব। আমি মনে করি, কলামে উল্লিখিত ১১টি মূল ক্ষেত্রে কমিশন যে প্রস্তাবাবলি পেশ করেছে, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করলে এ দেশের সংবিধান একটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হবে। আমি কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার প্রস্তাবগুলোকে তাদের সুপারিশমালার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমি ফোকাস করতে চাই কমিশনের কতগুলো অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর সুপারিশের দিকে।
১. প্রথমেই আমি উল্লেখ করব যে আমি সংবিধানের পুনর্লিখনের পক্ষপাতী নই, কারণ ১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের শাহাদাত এবং ২ লাখ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের আত্মত্যাগকে ধারণ করে রচিত হয়েছে। কীভাবে সংবিধানে বিভিন্ন একপেশে সংশোধনী সন্নিবেশিত হয়েছে, তা আমি ব্যাখ্যা করেছি। বর্তমান অবয়বে সংবিধানের মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, যেগুলো আমার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আমি ব্যাখ্যা করেছি। কমিশনও সেগুলো তাদের সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে তিনটিকে বদলে ফেলার যে সুপারিশ কমিশন প্রদান করেছে, সেগুলো একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর। কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ যে তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা রচনা করে বেতারে ভাষণ দিয়েছিলেন সেগুলো ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। চতুর্থ মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুসারে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরার পর। অতএব, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে ছুড়ে ফেলার অধিকার আমরা কাউকেই দিতে পারব না, তার কোনো প্রয়োজনও নেই।
২. কমিশনের সুপারিশকৃত ‘বহুত্ববাদ’ নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্নিহিত রয়েছে বলা হলেও সাধারণ জনগণের সেটা উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব বলা চলে। তাই আমি এই সুপারিশটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছি, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া ঠিক হবে না।
৩. ঠিক একইভাবে আমি সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্রকে’ বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান জানাতে চাই। শ্রমজীবী জনগণের শোষণমুক্তি ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি। কেউ কেউ বলতে পারেন কমিশনের সুপারিশকৃত ‘সাম্য’ নীতির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকতেও পারে, কিন্তু সংবিধানে সমাজতন্ত্র গুরুত্বসহকারে মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলে জনগণের শোষণমুক্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে রাষ্ট্রের নীতিমালার মধ্যে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। অতএব, ‘সাম্য’ কথাটি দিয়ে সমাজতন্ত্রকে সংবিধান থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস আমার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির সর্বাত্মক সংগ্রামকে ধারণ করতে হলে সমাজতন্ত্রের কোনো ভালো বিকল্প ব্যবস্থা আজও আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও সমাজতন্ত্রের কোনো ‘একক গ্রহণযোগ্য মডেল’ বিশ্বের কোনো দেশে সফলভাবে আজও চালু করা যায়নি। (সংবিধানে ২০১০ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ফিরে আসা সত্ত্বেও দেশের শাসক মহলগুলো ১৫ বছর ধরে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ কট্টর পুঁজিবাদী ভার্সনটাই চালু রেখেছিল)। ‘সাম্য’ কথাটি দিয়ে সমাজতন্ত্রকে লুকিয়ে ফেলার প্রয়াস পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোকে খুশি করার প্রয়াস বলেই মনে হচ্ছে।
৪. ‘বহুত্ববাদ’ নীতির মধ্যে দেশের নানা জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মনে করা হয়, তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে যদি সংবিধানে ‘জাতিগত বহুত্ববাদ’ কথাটি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়, তাহলে আমি আপত্তি করব না।
৫. কমিশন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের’ পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামকরণের সুপারিশ দিয়েছে। ভারতের নাম ইংরেজিতে ‘রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া’ এবং বাংলায় ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্র’। ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধান চালু হওয়ার পর গত ৭৫ বছরে ব্যাপারটি নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। আমাদের কমিশন এই অপ্রয়োজনীয় নাম-পরিবর্তন কেন প্রয়োজনীয় মনে করল বুঝতে পারছি না। তবে, ‘জনগণতন্ত্রী’ কথাটি আপত্তিকর নয়। যেটা আপত্তিকর সেটা হলো একটি রাষ্ট্র ‘জনগণতন্ত্রী’ হলে সেখানে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে না থাকা। বিশ্বে যে কটি রাষ্ট্রের নাম জনগণতন্ত্রী, সেগুলোর সব কটিতে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
৬. কমিশন সংসদের নিম্নকক্ষে মোট সদস্যসংখ্যা ৪০০ জনে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে, যাঁদের মধ্যে ৩০০ জন বর্তমান পদ্ধতি অনুসারে নির্বাচিত হবেন এবং বাকি ১০০ জন নারী সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এই সুপারিশ নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করবে এই ১০০ নারী সদস্যর নির্বাচনী-এলাকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আমার প্রস্তাবে আমি বর্তমান ৩০০টি নির্বাচনী-এলাকার ১০০টিতে প্রতি নির্বাচনে শুধু নারী-সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা রোটেশন পদ্ধতিতে চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। (রোটেশন পদ্ধতিতে তিনটি নির্বাচনে দেশের সব এলাকায় নারী সদস্য নির্বাচিত হতেন)। আমি মনে করি, আমার প্রস্তাবটি কমিশনের প্রস্তাবের চেয়ে অনেক বেশি সহজে বাস্তবায়নযোগ্য হতো। কমিশনের সুপারিশকৃত ৪০০ আসনের নিম্নকক্ষ পুরুষ সদস্য এবং নারী সদস্যদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক অবশ্যম্ভাবী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি করবে ‘কমন নির্বাচনী এলাকাগুলোতে’। উপরন্তু, সংসদ কক্ষে অতিরিক্ত ৫০ জন নারী সদস্যের আসন-বিন্যাসেও স্থান-সংকুলানসংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টি করবে।
সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করার জন্য রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন কিংবা মূল নীতি পরিবর্তনের অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর প্রস্তাবগুলোর আবশ্যকতা নেই। এসব আপত্তিকর সুপারিশ কমিশনের সুপারিশমালাকে বিতর্কিত করছে। বর্তমান সংবিধানকে যেসব গোষ্ঠী ‘নালায় ছুড়ে ফেলতে’ উদগ্রীব, তারা প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-শিবিরের অনুসারী স্বাধীনতাবিরোধী মহল, যারা সুকৌশলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে ফেলেছে। জনগণের ৫ শতাংশও তাদের সমর্থন করে না। সংবিধান সংস্কারের অপরিহার্যতাকে স্বীকার করতে কারও দ্বিমত নেই, কারণ বর্তমান অবয়বে সংবিধান ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার দলিলে পরিণত হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালা এবং যে কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় সুপারিশ আমি পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিয়েছি, সেগুলোকে যথাযথভাবে পরিবর্তন করে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধানে সংশোধনীর প্রস্তাবাবলি নির্ধারিত হয় তাহলে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের পদক্ষেপ সফলভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে, আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতির বিষয়টিও সফলভাবে নিষ্পন্ন করা যাবে।
আরও খবর পড়ুন:
গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারানোর পর থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছিলেন কেবল সজীব ওয়াজেদ জয়। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের সেসব বক্তব্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন সীমাহীন দুর্নীতি, নির্বাচনের নামে বারবার তামাশা...
১৯ ঘণ্টা আগেধর্ষণ বন্ধ হবে কী করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধর্ষণকে ‘না’ বলে না। বহু অভিযোগ বিচারে না এনে উঠিয়ে নিতে বলা হয়। এখানে নারীদের ওপর নির্যাতন প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। তা নিয়ে উপহাস, ট্রল হয়।
১৯ ঘণ্টা আগেবাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় পানীয়জলে আর্সেনিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এখানকার ৪৯ দশমিক ১৪ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিকের মাত্রা অনুমোদিতসীমার চেয়ে অনেক বেশি।
১৯ ঘণ্টা আগেড. জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। জাপানের হিরোশিমা ইউনিভার্সিটি থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনসহ নানা বিষয় নিয়ে...
২ দিন আগে