হাসান মামুন
একটা নজিরবিহীন নতুন পরিস্থিতিতে দেশে এবার বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ দেশ থেকে লাপাত্তা বলা যায়। তার সমর্থকগোষ্ঠী অবশ্য রয়েছে। কিন্তু তারা সোচ্চার কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অবিশ্বাস্য ধরনের পতন ঘটেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। তার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকাল বর্ণিত হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী শাসনামল হিসেবে, যেখানে স্বেচ্ছাচারিতায় খোদ রাষ্ট্রকে ভেঙে দেওয়ার পাঁয়তারা চলেছিল। এ অবস্থায় ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ আওয়াজ উঠেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনও দেশে হতে হবে। তার আগে সম্ভব না হলেও পরে হতে হবে সংস্কার—এটাই সিংহভাগ রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের দাবি। বলাই বাহুল্য, এ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কোনো অংশগ্রহণ নেই। দলটির শীর্ষ নেতা ভারতে অবস্থান করে অচিরেই ফিরে এসে প্রতিশোধ গ্রহণের আওয়াজ দিচ্ছেন কেবল। তাঁর অনুসারীদের মধ্যেও অনুশোচনা কিংবা এ ধরনের কোনো উপলব্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন যারা ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যকার উপলব্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথাগত রাজনৈতিক দল বা পরিচিত কোনো ধরনের নেতৃত্বে পরিবর্তনটি আসেনি বলে এর প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। সত্যি বলতে, এটা হয়ে থাকবে গবেষণার বিষয়। দীর্ঘ ও গতানুগতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পর বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রায় খালি হাতে নেমে এসেছিল যেন আত্মাহুতি দিতে। এমন নজির থাকলেও খুব কম আছে। এমন একটা পরিস্থিতির দিকে যারা দেশকে ঠেলে দিয়েছিল, তারা আবার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা বলেই জায়েজ করতে চাইত তাদের সব কর্মকাণ্ড। নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকেও তারা ওই স্লোগানে মুড়ে গায়েব করে দিতে চেয়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বিজয় দিবসেও ওই দুটি শব্দ উচ্চারণ করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা! কী আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেটা এখন নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েই হাজির করছেন নতুন বক্তব্য। সেটা যে মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ গ্রহণ করছে, তা অবশ্য নয়। তাদের মধ্যেও বিতর্ক চলমান।
হাসিনা সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোও। এর কোনো কোনোটি ছিল নিষিদ্ধ কিংবা প্রায় নিষিদ্ধ। অব্যাহত দমন-পীড়নেও এরা কাবু হয়নি; বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও এদের প্রভাব বেড়ে উঠেছিল। তার একটা প্রকাশ ঘটে গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের কোনো কোনো অংশের অতি-উৎসাহ আতঙ্ক জাগায় ‘উদারনৈতিক বাংলাদেশে’ বিশ্বাসী মানুষের মনে। তাদের একটা বিরাট অংশ তখন প্রশ্ন তোলে হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু মনে হয় না, বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর লক্ষ্য পূরণে সহায়তার জন্য ওই সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে সরকার নিজেই। তবে সংকটটা ওখানে যে, তার পতনের মধ্য দিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির পতন’ ঘটেছে বলে দেশে-বিদেশে দানা বেঁধে উঠেছে প্রচারণা। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের কিছু ভূমিকাও এতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে বললে ভুল হবে না। এই মুহূর্তে মাঠে থাকা সর্ববৃহৎ দল বিএনপিও এ বিষয়ে বিরক্ত বলে মনে হয়। তারা চাইছে না, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো গুরুতর নীতিগত প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিক কিংবা কোনো দিকে হেলে পড়ুক। যেমন—বাহাত্তরে অর্জিত (এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংশোধনের মধ্য দিয়ে এই মুহূর্তে হাতে থাকা) সংবিধানের সংস্কার বর্তমান সরকারের মাধ্যমে হোক, এটা তাদের কাম্য নয়। গণহত্যার অভিযোগ থাকলেও এবং সংশ্লিষ্টদের বিচারের ব্যাপারে আপসহীন হলেও বিএনপি চাইছে না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক। ‘যত দ্রুত সম্ভব’ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা বরং এসব বিষয়ের নিষ্পত্তিতে এগোতে চাইছে।
রাজনীতিতে এখন কয়েকটি পক্ষ এবং এসব পক্ষেও ছোট-বড় বিভাজন রয়েছে। ‘ছাত্র সমন্বয়ক’ বলে পরিচিতরাও অবিভাজ্য সত্তা নয়। তারা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, এমনকি ছাত্রলীগ থেকেও উঠে এসে একটা প্ল্যাটফর্মে জড়ো হয়েছিলেন। সরকার পতনের পর এদের একাংশ আবার ঘোষণা দিয়ে মাঠ ত্যাগ করেছে। মতবিরোধও বিভিন্ন ঘটনায় দৃশ্যমান। তাদের পক্ষ থেকে দল গঠনের প্রক্রিয়াও চলছে। দল গঠিত হলে এই অংশের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হবে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ কী করবে, সেটা এক গুরুতর প্রশ্ন। রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইলে তাদের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে হচ্ছে। ১৫ আগস্টের চেয়েও বড় বিপর্যয়ের মুখে তারা পড়েছে—এই উপলব্ধি যত দ্রুত আসে ততই মঙ্গল। নইলে আগামী নির্বাচনে মাঠে থাকা প্রধান দল বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর জোট গঠিত হলে বিএনপি চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সুশাসন দিতে ব্যর্থ হলে এর পরবর্তী নির্বাচনে কী ঘটবে? অপশাসন, গণতন্ত্র হরণ ও গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ (প্রকৃতপক্ষে ‘হাসিনা লীগ’) কি তখন ফিরে আসতে পারবে ক্ষমতায়? নাকি ঘটবে ইসলামপন্থীদের উত্থান—যারা কখনো ক্ষমতায় আসেনি বলে সমাজে এর প্রতি একপ্রকার আকর্ষণও রয়েছে। এসব প্রশ্নের মুখে বিএনপিকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে একধরনের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি’র প্রয়াস পেতে। এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য ব্যাপক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। গণ-অভ্যুত্থানের ওপর ভর করে দেশকে আমূল বদলে ফেলার স্লোগানের বদলে এই সময়ে বিএনপির মধ্যে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংস্কারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। ‘বিপ্লবের’ বদলে তাদের বিবর্তনে বিশ্বাসী বলেই মনে হচ্ছে।
বিপ্লবের সংজ্ঞা নিয়েও আছে মতপার্থক্য। একশ্রেণির কাছ থেকে আরেক শ্রেণির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর যদি বিপ্লব হয়ে থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধও বিপ্লব কি না—এ প্রশ্ন উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে দেশ পেয়েছিলাম, তাতেও কোনো বিপ্লব করতে পারেনি কোনো পক্ষ। বিপ্লবের নামে অবশ্য অনেক কিছু হয়েছে, যাতে সমাজের সিংহভাগ মানুষের কল্যাণ হয়নি। তাদের কমবেশি অংশগ্রহণ অবশ্য ছিল সব পরিবর্তনেই। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছে সাধারণ মানুষ। ‘অসাধারণ’ পরিবারের তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণও ছিল বিরাট। এ দুই পক্ষের প্রত্যাশা নিশ্চয়ই চাকতিতে চাকতিতে মিলে যাবে না। তার পরও কিছু মিলবে। আর এখানটায় এসে অবস্থান নেবে যারা, সম্ভবত তারাই এগিয়ে নিতে পারবে আজকের বাংলাদেশকে। এখানে বিশেষ কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সব পক্ষই তো দাবি করে, জনগণ তাদের সঙ্গে রয়েছে। কিংবা বলে, তাদের প্রত্যাশা হলো এ-ই কিংবা ও-ই! অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের প্রত্যাশাও কিন্তু বদলে যায়। বদলায় পক্ষপাত। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা আর পারফরম্যান্সেও মানুষের প্রত্যাশা ও পক্ষপাতে কিছু বদল এরই মধ্যে ঘটেছে বলে ধারণা। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের ডাকে আবারও মানুষ একইভাবে রাস্তায় নামবে বলে মনে করারও কারণ নেই। তাদের ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আগামী নির্বাচনে জনগণ বেছে নেবে তার পছন্দের নেতৃত্ব। এ দেশের মানুষ সব সময় চেয়েছে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন’ এবং শাসকের জবাবদিহি। সে জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটা অবশ্যই অর্জন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে মানুষ তো এটাই চেয়েছিল। তখনো প্রত্যাশায় ভিন্নতা ছিল দলে দলে। কিন্তু ওটা ছিল ন্যূনতম প্রত্যাশা। আফসোস—মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি তাতে কুঠারাঘাত করেছে সবচেয়ে নির্দয়ভাবে। শেষ দিকে অবশ্য আওয়ামী লীগ বলে কিছু ছিল কি না, প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, এর নামে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল একটা লুটেরা গোষ্ঠী। এদের কারণে অর্থনীতিও চলে যায় সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে। পুঁজিতন্ত্রও নয়; দেশে গড়ে ওঠে ‘চোরতন্ত্র’!
এর বিপরীতটাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তার সঙ্গে চব্বিশের পরিবর্তনের পেছনে সক্রিয় প্রত্যাশার বিরোধ আছে বলে তো মনে হয় না। এ ধারায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার শপথই এখন গ্রহণ করতে হবে।
একটা নজিরবিহীন নতুন পরিস্থিতিতে দেশে এবার বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ দেশ থেকে লাপাত্তা বলা যায়। তার সমর্থকগোষ্ঠী অবশ্য রয়েছে। কিন্তু তারা সোচ্চার কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অবিশ্বাস্য ধরনের পতন ঘটেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। তার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকাল বর্ণিত হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী শাসনামল হিসেবে, যেখানে স্বেচ্ছাচারিতায় খোদ রাষ্ট্রকে ভেঙে দেওয়ার পাঁয়তারা চলেছিল। এ অবস্থায় ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ আওয়াজ উঠেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনও দেশে হতে হবে। তার আগে সম্ভব না হলেও পরে হতে হবে সংস্কার—এটাই সিংহভাগ রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের দাবি। বলাই বাহুল্য, এ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কোনো অংশগ্রহণ নেই। দলটির শীর্ষ নেতা ভারতে অবস্থান করে অচিরেই ফিরে এসে প্রতিশোধ গ্রহণের আওয়াজ দিচ্ছেন কেবল। তাঁর অনুসারীদের মধ্যেও অনুশোচনা কিংবা এ ধরনের কোনো উপলব্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন যারা ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যকার উপলব্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথাগত রাজনৈতিক দল বা পরিচিত কোনো ধরনের নেতৃত্বে পরিবর্তনটি আসেনি বলে এর প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। সত্যি বলতে, এটা হয়ে থাকবে গবেষণার বিষয়। দীর্ঘ ও গতানুগতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পর বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রায় খালি হাতে নেমে এসেছিল যেন আত্মাহুতি দিতে। এমন নজির থাকলেও খুব কম আছে। এমন একটা পরিস্থিতির দিকে যারা দেশকে ঠেলে দিয়েছিল, তারা আবার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা বলেই জায়েজ করতে চাইত তাদের সব কর্মকাণ্ড। নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকেও তারা ওই স্লোগানে মুড়ে গায়েব করে দিতে চেয়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বিজয় দিবসেও ওই দুটি শব্দ উচ্চারণ করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা! কী আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেটা এখন নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েই হাজির করছেন নতুন বক্তব্য। সেটা যে মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ গ্রহণ করছে, তা অবশ্য নয়। তাদের মধ্যেও বিতর্ক চলমান।
হাসিনা সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোও। এর কোনো কোনোটি ছিল নিষিদ্ধ কিংবা প্রায় নিষিদ্ধ। অব্যাহত দমন-পীড়নেও এরা কাবু হয়নি; বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও এদের প্রভাব বেড়ে উঠেছিল। তার একটা প্রকাশ ঘটে গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের কোনো কোনো অংশের অতি-উৎসাহ আতঙ্ক জাগায় ‘উদারনৈতিক বাংলাদেশে’ বিশ্বাসী মানুষের মনে। তাদের একটা বিরাট অংশ তখন প্রশ্ন তোলে হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু মনে হয় না, বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর লক্ষ্য পূরণে সহায়তার জন্য ওই সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে সরকার নিজেই। তবে সংকটটা ওখানে যে, তার পতনের মধ্য দিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির পতন’ ঘটেছে বলে দেশে-বিদেশে দানা বেঁধে উঠেছে প্রচারণা। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের কিছু ভূমিকাও এতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে বললে ভুল হবে না। এই মুহূর্তে মাঠে থাকা সর্ববৃহৎ দল বিএনপিও এ বিষয়ে বিরক্ত বলে মনে হয়। তারা চাইছে না, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো গুরুতর নীতিগত প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিক কিংবা কোনো দিকে হেলে পড়ুক। যেমন—বাহাত্তরে অর্জিত (এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংশোধনের মধ্য দিয়ে এই মুহূর্তে হাতে থাকা) সংবিধানের সংস্কার বর্তমান সরকারের মাধ্যমে হোক, এটা তাদের কাম্য নয়। গণহত্যার অভিযোগ থাকলেও এবং সংশ্লিষ্টদের বিচারের ব্যাপারে আপসহীন হলেও বিএনপি চাইছে না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক। ‘যত দ্রুত সম্ভব’ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা বরং এসব বিষয়ের নিষ্পত্তিতে এগোতে চাইছে।
রাজনীতিতে এখন কয়েকটি পক্ষ এবং এসব পক্ষেও ছোট-বড় বিভাজন রয়েছে। ‘ছাত্র সমন্বয়ক’ বলে পরিচিতরাও অবিভাজ্য সত্তা নয়। তারা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, এমনকি ছাত্রলীগ থেকেও উঠে এসে একটা প্ল্যাটফর্মে জড়ো হয়েছিলেন। সরকার পতনের পর এদের একাংশ আবার ঘোষণা দিয়ে মাঠ ত্যাগ করেছে। মতবিরোধও বিভিন্ন ঘটনায় দৃশ্যমান। তাদের পক্ষ থেকে দল গঠনের প্রক্রিয়াও চলছে। দল গঠিত হলে এই অংশের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হবে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ কী করবে, সেটা এক গুরুতর প্রশ্ন। রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইলে তাদের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে হচ্ছে। ১৫ আগস্টের চেয়েও বড় বিপর্যয়ের মুখে তারা পড়েছে—এই উপলব্ধি যত দ্রুত আসে ততই মঙ্গল। নইলে আগামী নির্বাচনে মাঠে থাকা প্রধান দল বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর জোট গঠিত হলে বিএনপি চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সুশাসন দিতে ব্যর্থ হলে এর পরবর্তী নির্বাচনে কী ঘটবে? অপশাসন, গণতন্ত্র হরণ ও গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ (প্রকৃতপক্ষে ‘হাসিনা লীগ’) কি তখন ফিরে আসতে পারবে ক্ষমতায়? নাকি ঘটবে ইসলামপন্থীদের উত্থান—যারা কখনো ক্ষমতায় আসেনি বলে সমাজে এর প্রতি একপ্রকার আকর্ষণও রয়েছে। এসব প্রশ্নের মুখে বিএনপিকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে একধরনের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি’র প্রয়াস পেতে। এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য ব্যাপক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। গণ-অভ্যুত্থানের ওপর ভর করে দেশকে আমূল বদলে ফেলার স্লোগানের বদলে এই সময়ে বিএনপির মধ্যে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংস্কারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। ‘বিপ্লবের’ বদলে তাদের বিবর্তনে বিশ্বাসী বলেই মনে হচ্ছে।
বিপ্লবের সংজ্ঞা নিয়েও আছে মতপার্থক্য। একশ্রেণির কাছ থেকে আরেক শ্রেণির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর যদি বিপ্লব হয়ে থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধও বিপ্লব কি না—এ প্রশ্ন উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে দেশ পেয়েছিলাম, তাতেও কোনো বিপ্লব করতে পারেনি কোনো পক্ষ। বিপ্লবের নামে অবশ্য অনেক কিছু হয়েছে, যাতে সমাজের সিংহভাগ মানুষের কল্যাণ হয়নি। তাদের কমবেশি অংশগ্রহণ অবশ্য ছিল সব পরিবর্তনেই। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছে সাধারণ মানুষ। ‘অসাধারণ’ পরিবারের তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণও ছিল বিরাট। এ দুই পক্ষের প্রত্যাশা নিশ্চয়ই চাকতিতে চাকতিতে মিলে যাবে না। তার পরও কিছু মিলবে। আর এখানটায় এসে অবস্থান নেবে যারা, সম্ভবত তারাই এগিয়ে নিতে পারবে আজকের বাংলাদেশকে। এখানে বিশেষ কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সব পক্ষই তো দাবি করে, জনগণ তাদের সঙ্গে রয়েছে। কিংবা বলে, তাদের প্রত্যাশা হলো এ-ই কিংবা ও-ই! অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের প্রত্যাশাও কিন্তু বদলে যায়। বদলায় পক্ষপাত। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা আর পারফরম্যান্সেও মানুষের প্রত্যাশা ও পক্ষপাতে কিছু বদল এরই মধ্যে ঘটেছে বলে ধারণা। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের ডাকে আবারও মানুষ একইভাবে রাস্তায় নামবে বলে মনে করারও কারণ নেই। তাদের ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আগামী নির্বাচনে জনগণ বেছে নেবে তার পছন্দের নেতৃত্ব। এ দেশের মানুষ সব সময় চেয়েছে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন’ এবং শাসকের জবাবদিহি। সে জন্য যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটা অবশ্যই অর্জন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে মানুষ তো এটাই চেয়েছিল। তখনো প্রত্যাশায় ভিন্নতা ছিল দলে দলে। কিন্তু ওটা ছিল ন্যূনতম প্রত্যাশা। আফসোস—মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি তাতে কুঠারাঘাত করেছে সবচেয়ে নির্দয়ভাবে। শেষ দিকে অবশ্য আওয়ামী লীগ বলে কিছু ছিল কি না, প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, এর নামে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল একটা লুটেরা গোষ্ঠী। এদের কারণে অর্থনীতিও চলে যায় সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে। পুঁজিতন্ত্রও নয়; দেশে গড়ে ওঠে ‘চোরতন্ত্র’!
এর বিপরীতটাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তার সঙ্গে চব্বিশের পরিবর্তনের পেছনে সক্রিয় প্রত্যাশার বিরোধ আছে বলে তো মনে হয় না। এ ধারায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার শপথই এখন গ্রহণ করতে হবে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া একটি পোস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি
১৩ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ নিয়ে দলের বক্তব্য স্পষ্ট ক
১৩ ঘণ্টা আগেডিসেম্বর মাসে এসে বোঝা যাচ্ছিল, পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া সেন্সরশিপ সেভাবে কাজ করছে না। বহু খবরই তখন প্রকাশিত হচ্ছিল অবরুদ্ধ নগরীর সংবাদপত্রে। ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন কিংবা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবৃতি একই দিনে প্রকাশিত হলো। সেদিন ইত্তেফাক ‘পিটুনি কর’ বিষয়ক রিপোর্টটির যে শিরোনাম করেছিল,
১৩ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে গণহত্যা কিংবা জেনোসাইড কম হয়নি। যত যুদ্ধের যত গণকবর রয়েছে, সেগুলো বর্বরতার সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে নিহত মানুষের গণকবর যেমন সাক্ষ্য দেয়, রুয়ান্ডার নিয়াবারোঙ্গো নদীও সাক্ষ্য দেয়, তার বুক দিয়ে ভেসে গেছে রক্তস্নাত মানুষের লাশ। তবে বর্বরতার চরম মাত্রা মনে
১৪ ঘণ্টা আগে