এ কে এম শামসুদ্দিন
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া একটি পোস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। এই দিনটি তাই বাংলাদেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। এমন একটি গৌরবোজ্জ্বল দিনকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদি তাঁর বার্তায় লিখেছেন, ‘আজ বিজয় দিবসে আমরা সেই সাহসী সৈনিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই, যাঁরা ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের নিঃস্বার্থ, নিষ্ঠা ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে সুরক্ষিত করেছে এবং আমাদের গৌরবে ভরিয়ে দিয়েছে। এই দিনটি তাঁদের অসামান্য বীরত্ব ও অবিচল মানসিকতাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন। তাঁদের আত্মত্যাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে চিরদিনের জন্য গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’ তাঁর এই বার্তায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ সাফল্যের বর্ণনা থাকলেও এই বিজয় দিবসের সঙ্গে যে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক আছে; তা বোঝাই যায় না। মোদির এই বার্তা দেখে বিস্ময় জাগালেও অপ্রত্যাশিত নয়। ভারতীয়দের এই অহংবোধ আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ভারত, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের কৃতিত্বকে যে ছোট করার চেষ্টা করে আসছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ভারতের এই হীনম্মন্যতা অনেক আগেই প্রকাশ পেয়েছে। ভারত বরাবরই মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘পাক-ভারত’ যুদ্ধ বলার চেষ্টা করে আসছে।
২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওই কর্মকর্তার লেখা ‘১২ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করা হয়। ভারতীয় ওই সেনা কর্মকর্তার বইয়ের নাম ও বক্তব্য নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা মন খারাপ করলেও মুখ ফুটে বলতে পারেননি। তাতে ভারত নাখোশ হলে সরকারপ্রধানও নাখোশ হবেন ভেবে তেমন জোরালো প্রতিবাদ করার সাহস করলেন না তাঁরা। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় বিজয় দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা আগের দিন ঢাকায় ঘটে যাওয়া বিতর্কিত বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দায়সারাভাবে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নিয়েছিল।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ ও বাঙালি ইপিআর সদস্য, নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ যুদ্ধের রসদ যখন প্রায় নিঃশেষ, এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সহযোগী ফোর্স হিসেবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা এবং এ দেশের সাধারণ মানুষের সহায়তা ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর পাকিস্তানিদের পরাজিত করা এত সহজ হতো না। এই কথা মুক্তিযুদ্ধের সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা নিজে স্বীকার করেছেন।
১৯৯৮ সালে জেনারেল অরোরা ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ যদি সহায়তা না করত, তাহলে আমরা কোনো দিনই বাংলাদেশে ঢুকতে পারতাম না।’ জেনারেল অরোরা পাঁচ দিনের সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনের সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় সম্ভব ছিল। এতে সময় হয়তো দু-তিন বছর বেশি লাগত। কারণ, বাংলাদেশের যুদ্ধটি ছিল একটি জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধ। কোনো যুদ্ধ যদি স্বাধীনতার জন্য হয়, তবে সে যুদ্ধকে কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।’ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও জনগণের ভূমিকার প্রশংসা করে সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘তাঁরা একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য প্রাণপণ অবদান রেখেছেন।’
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর দেশব্যাপী সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর সম্মুখ সমরে নেতৃত্বদানকারী ভারতীয় কমান্ডারের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অভিযানে নিয়োজিত ভারতীয় ২০ মাউন্টেইন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল লচমন সিং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের এক অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তাঁরই লেখা ‘ইন্ডিয়ান সর্ড স্ট্রাইকস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ের ১২৫ ও ১২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মুক্তিবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল বলেই আমরা সহজে শত্রুকে পরাস্ত করতে পেরেছি। যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিবাহিনী বেশ দক্ষতার সঙ্গে আমাদের গাইড করেছে, এ জন্য গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি ব্রিগেড ডিফেন্স পজিশন বাইপাস করে পেছন থেকে আমরা সম্মিলিত আক্রমণ করে পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছি। পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানকে বাইপাস করতে আমাদের একটা নদী অতিক্রম করতে হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো পথ অনুসরণ করেই সেদিন ভারী যুদ্ধসরঞ্জামসহ ভারতীয় সেনাদল নদীটি নির্বিঘ্নে অতিক্রম করতে পেরেছিল।
নদী পার হতে শত্রু মোকাবিলা করতে হয়নি এবং পথে কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি।’
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ঊহ্য রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বার্তাই দিন না কেন, ইতিহাসের অনিবার্য সত্যকে তুলে ধরে আমাদের সঠিক জবাব দিতেই হবে। প্রয়োজনে বারবার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্র সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। কিছুদিন আগেও হয়তো ভারতের এমন আচরণের প্রতিবাদ করা যেত না। তখন অবশ্য সে পরিবেশও ছিল না। নরেন্দ্র মোদি এবারই প্রথম বিজয় দিবসে এমন বিতর্কিত বিবৃতি দেননি। ২০১৮ সালেও তিনি অনুরূপ বিবৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞার উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। তখন শুধু মোদি নয়, ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী, এমনকি এয়ারফোর্সের বার্তায়ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভারতীয় তারকা, খেলোয়াড়, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদেরা একাত্তরে বাংলাদেশের বিজয়কে তাঁদের বিজয় বলে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ বার্তায় ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনকে ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।
ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারাম ওই সময় এক টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, ‘ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি, সাহস আর সংকল্পই মাত্র চৌদ্দ দিনের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেছিল, যা আধুনিক ইতিহাসে বৃহত্তম সামরিক আত্মসমর্পণগুলোর মধ্যে একটি।’ এভাবেই ভারতীয়রা মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্বকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আসছেন। ভারতীয়দের এসব বিবৃতি নিয়ে তখন কিছু কিছু সংবাদপত্রে খবর বের হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো মন্ত্রী কিংবা দলের কোনো নেতা, আওয়ামী লীগ ঘারানার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। অন্যভাবে যদি বলি, মোদির সেই বিবৃতির প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস পাননি। কারণ, ভারত অখুশি হবে এমন বিবৃতি দেওয়ার পরিবেশ তখন ছিল না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ আমাদের করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কৃতিত্ব, কট্টর হিন্দুত্ববাদী কোনো রাজনৈতিক নেতার সার্টিফিকেটের ওপর নির্ভর করে না। তবে এমন ব্যক্তিকে যদি সে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়, তখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেওয়া তাঁর বিবৃতি কিছুটা গুরুত্ব বহন করে বইকি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত যেকোনো বিবৃতির আমরা নিন্দা জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহানির শিকার আড়াই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগকে যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অবজ্ঞা করে; আমরা অবশ্যই তাদের সেই অসৎ উদ্দেশ্যকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া একটি পোস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। এই দিনটি তাই বাংলাদেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। এমন একটি গৌরবোজ্জ্বল দিনকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদি তাঁর বার্তায় লিখেছেন, ‘আজ বিজয় দিবসে আমরা সেই সাহসী সৈনিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই, যাঁরা ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের নিঃস্বার্থ, নিষ্ঠা ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে সুরক্ষিত করেছে এবং আমাদের গৌরবে ভরিয়ে দিয়েছে। এই দিনটি তাঁদের অসামান্য বীরত্ব ও অবিচল মানসিকতাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন। তাঁদের আত্মত্যাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে চিরদিনের জন্য গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’ তাঁর এই বার্তায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ সাফল্যের বর্ণনা থাকলেও এই বিজয় দিবসের সঙ্গে যে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক আছে; তা বোঝাই যায় না। মোদির এই বার্তা দেখে বিস্ময় জাগালেও অপ্রত্যাশিত নয়। ভারতীয়দের এই অহংবোধ আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ভারত, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের কৃতিত্বকে যে ছোট করার চেষ্টা করে আসছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ভারতের এই হীনম্মন্যতা অনেক আগেই প্রকাশ পেয়েছে। ভারত বরাবরই মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘পাক-ভারত’ যুদ্ধ বলার চেষ্টা করে আসছে।
২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওই কর্মকর্তার লেখা ‘১২ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করা হয়। ভারতীয় ওই সেনা কর্মকর্তার বইয়ের নাম ও বক্তব্য নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা মন খারাপ করলেও মুখ ফুটে বলতে পারেননি। তাতে ভারত নাখোশ হলে সরকারপ্রধানও নাখোশ হবেন ভেবে তেমন জোরালো প্রতিবাদ করার সাহস করলেন না তাঁরা। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় বিজয় দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা আগের দিন ঢাকায় ঘটে যাওয়া বিতর্কিত বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দায়সারাভাবে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নিয়েছিল।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ ও বাঙালি ইপিআর সদস্য, নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ যুদ্ধের রসদ যখন প্রায় নিঃশেষ, এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সহযোগী ফোর্স হিসেবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা এবং এ দেশের সাধারণ মানুষের সহায়তা ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর পাকিস্তানিদের পরাজিত করা এত সহজ হতো না। এই কথা মুক্তিযুদ্ধের সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা নিজে স্বীকার করেছেন।
১৯৯৮ সালে জেনারেল অরোরা ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ যদি সহায়তা না করত, তাহলে আমরা কোনো দিনই বাংলাদেশে ঢুকতে পারতাম না।’ জেনারেল অরোরা পাঁচ দিনের সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনের সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় সম্ভব ছিল। এতে সময় হয়তো দু-তিন বছর বেশি লাগত। কারণ, বাংলাদেশের যুদ্ধটি ছিল একটি জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধ। কোনো যুদ্ধ যদি স্বাধীনতার জন্য হয়, তবে সে যুদ্ধকে কোনোভাবেই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।’ বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও জনগণের ভূমিকার প্রশংসা করে সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘তাঁরা একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য প্রাণপণ অবদান রেখেছেন।’
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর দেশব্যাপী সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর সম্মুখ সমরে নেতৃত্বদানকারী ভারতীয় কমান্ডারের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অভিযানে নিয়োজিত ভারতীয় ২০ মাউন্টেইন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল লচমন সিং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের এক অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তাঁরই লেখা ‘ইন্ডিয়ান সর্ড স্ট্রাইকস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ের ১২৫ ও ১২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মুক্তিবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল বলেই আমরা সহজে শত্রুকে পরাস্ত করতে পেরেছি। যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিবাহিনী বেশ দক্ষতার সঙ্গে আমাদের গাইড করেছে, এ জন্য গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি ব্রিগেড ডিফেন্স পজিশন বাইপাস করে পেছন থেকে আমরা সম্মিলিত আক্রমণ করে পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছি। পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানকে বাইপাস করতে আমাদের একটা নদী অতিক্রম করতে হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো পথ অনুসরণ করেই সেদিন ভারী যুদ্ধসরঞ্জামসহ ভারতীয় সেনাদল নদীটি নির্বিঘ্নে অতিক্রম করতে পেরেছিল।
নদী পার হতে শত্রু মোকাবিলা করতে হয়নি এবং পথে কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি।’
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ঊহ্য রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বার্তাই দিন না কেন, ইতিহাসের অনিবার্য সত্যকে তুলে ধরে আমাদের সঠিক জবাব দিতেই হবে। প্রয়োজনে বারবার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্র সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। কিছুদিন আগেও হয়তো ভারতের এমন আচরণের প্রতিবাদ করা যেত না। তখন অবশ্য সে পরিবেশও ছিল না। নরেন্দ্র মোদি এবারই প্রথম বিজয় দিবসে এমন বিতর্কিত বিবৃতি দেননি। ২০১৮ সালেও তিনি অনুরূপ বিবৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞার উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। তখন শুধু মোদি নয়, ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী, এমনকি এয়ারফোর্সের বার্তায়ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভারতীয় তারকা, খেলোয়াড়, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদেরা একাত্তরে বাংলাদেশের বিজয়কে তাঁদের বিজয় বলে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ বার্তায় ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনকে ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।
ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারাম ওই সময় এক টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, ‘ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি, সাহস আর সংকল্পই মাত্র চৌদ্দ দিনের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেছিল, যা আধুনিক ইতিহাসে বৃহত্তম সামরিক আত্মসমর্পণগুলোর মধ্যে একটি।’ এভাবেই ভারতীয়রা মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্বকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আসছেন। ভারতীয়দের এসব বিবৃতি নিয়ে তখন কিছু কিছু সংবাদপত্রে খবর বের হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো মন্ত্রী কিংবা দলের কোনো নেতা, আওয়ামী লীগ ঘারানার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। অন্যভাবে যদি বলি, মোদির সেই বিবৃতির প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস পাননি। কারণ, ভারত অখুশি হবে এমন বিবৃতি দেওয়ার পরিবেশ তখন ছিল না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ আমাদের করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কৃতিত্ব, কট্টর হিন্দুত্ববাদী কোনো রাজনৈতিক নেতার সার্টিফিকেটের ওপর নির্ভর করে না। তবে এমন ব্যক্তিকে যদি সে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়, তখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেওয়া তাঁর বিবৃতি কিছুটা গুরুত্ব বহন করে বইকি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত যেকোনো বিবৃতির আমরা নিন্দা জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহানির শিকার আড়াই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগকে যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অবজ্ঞা করে; আমরা অবশ্যই তাদের সেই অসৎ উদ্দেশ্যকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ নিয়ে দলের বক্তব্য স্পষ্ট ক
১৪ ঘণ্টা আগেডিসেম্বর মাসে এসে বোঝা যাচ্ছিল, পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া সেন্সরশিপ সেভাবে কাজ করছে না। বহু খবরই তখন প্রকাশিত হচ্ছিল অবরুদ্ধ নগরীর সংবাদপত্রে। ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন কিংবা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবৃতি একই দিনে প্রকাশিত হলো। সেদিন ইত্তেফাক ‘পিটুনি কর’ বিষয়ক রিপোর্টটির যে শিরোনাম করেছিল,
১৪ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে গণহত্যা কিংবা জেনোসাইড কম হয়নি। যত যুদ্ধের যত গণকবর রয়েছে, সেগুলো বর্বরতার সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে নিহত মানুষের গণকবর যেমন সাক্ষ্য দেয়, রুয়ান্ডার নিয়াবারোঙ্গো নদীও সাক্ষ্য দেয়, তার বুক দিয়ে ভেসে গেছে রক্তস্নাত মানুষের লাশ। তবে বর্বরতার চরম মাত্রা মনে
১৪ ঘণ্টা আগেসংস্কারের দাবিগুলো শুরু থেকেই উঠছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বলা হচ্ছিল—এমন একটা ব্যবস্থা চাই, যাতে ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তারা যেন চাইলেও স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। প্রত্যাশিত সেই ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই সংস্কার। বলা হলো, এই যে আমাদের সংবিধান, কাটা-ছেঁড়া করতে করতে এটাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়
২ দিন আগে