Ajker Patrika

তাত্ত্বিক আলোচনা বনাম সমাজবাস্তবতা

গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি।

সেলিম জাহান 
যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতেও দেশের মূল্যস্ফীতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। ছবি: আজকের পত্রিকা
যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতেও দেশের মূল্যস্ফীতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। ছবি: আজকের পত্রিকা

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণ যে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবু অহরহ নানান তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে আমাদের জগতের বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলি। তাত্ত্বিক বহু ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমরা এমন ‘অন্ধ প্রেমে’ পড়ে যাই যে চারপাশের বাস্তবতাটুকু দেখতেই পাই না। এর ফলে, বহু ভ্রান্ত উপসংহারে গিয়ে আমরা পৌঁছাই।

নিজের কথাই বলি না কেন! ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতার কালে, উচ্চশিক্ষার সময়ে তাত্ত্বিক ধারণা, বিতর্ক-আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজেকে মননের জগতে একজন কেউকেটা বলে মনে হতো। তারুণ্যের অহম্ বোধ থেকে মনে হতো যে তত্ত্ব দিয়েই সব সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারব। নানান তাত্ত্বিকের মতামত, ধারণা আমার ঠোঁটস্থ ছিল। ফলে আমার চিন্তাচেতনায় দুটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. নিজস্ব চিন্তাভাবনার বদলে আমি অন্যের ভাবনাচিন্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দুই. তত্ত্বের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায় অনেক সময় আমি বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরে পড়ি।

উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, তফাৎ রয়েছে পড়ার বইয়ের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা গেল যে পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলছে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তব বাজারে নেই। কল্যাণমূলক অর্থনীতির সুগভীর তত্ত্ব পুস্তকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার হদিস মেলে না। এইসব বোধ শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার বেসাতি সাজাতে সাহায্য করেছে এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অর্থবহ শিক্ষাসংযোগ তৈরি করেছে। অর্থনীতির তত্ত্বের নানান কচকচিকে খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ করে সহজ ভাষায় আমি শ্রেণির দুর্বলতম শিক্ষার্থীর কাছেও পৌঁছে দিতে পেরেছি। শিক্ষক হিসেবে সেটুকুই আমার সার্থকতা।

গবেষণার জন্য বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, উন্নয়ন যে কী, তা আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারলাম। উপলব্ধি করলাম যে তাত্ত্বিক শিক্ষা কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার কিছু উপকরণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, গবেষণা সেসব উপকরণের প্রয়োগ শেখায়। কিন্তু সেসব উপকরণ নিমিত্ত মাত্র, সেগুলো দিয়ে আমরা বাস্তব সমস্যার একটি অর্থবহ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেসব থেকে কিছু অর্থবহ উপসংহারে উপনীত হতে পারি। অন্য কথায়, বঞ্চনা, সমতা, বৈষম্যের ওপরে খুব জোরালো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার ছিল। দারিদ্র্য এবং অসমতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও তাদের গাণিতিক সূত্রও আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গবেষণা করতে গিয়ে এসব আর্থসামাজিক বিষয়ের বাস্তব স্বরূপ ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞানলাভ হলো। আমার এ জ্ঞানলাভের জন্য আমি প্রয়াত দুজন অর্থনীতিবিদের কাছে কৃতজ্ঞ—অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও ড. মাহবুব হোসেন।

আশির দশকের কথা। গবেষণার কারণে ড. মাহবুব হোসেন ও আমি তখন ফরিদপুরে। নতুন এক প্রজাতির ধানের ফলন ভালো, খরচও কম। তবু কৃষকেরা এ ধান লাগাচ্ছেন না। কোনো তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে মাহবুব ভাই আর আমি চাষি ভাইদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কেন ওই ধানটা লাগাচ্ছেন না। একজন চাষি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন যে ধানের কথা কইতেছেন আপনেরা, তার সবই ভালো, কিন্তুক পাকনের কালে ওই ধানের শিষ চোহে দ্যাহা যায় না। শিষগুলান পাতার তলে ঢাইক্যা থাহে। কন্ স্যার, অ্যাতে কি নয়নসুখ হয়, না হেতে পরান ভরে?’ এ প্রশ্নের জবাব আমরা কেউ দিতে পারিনি। ব্যয় আর উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা যায়নি।

পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় পৃথিবীর ১০০টি দেশের দারিদ্র্য ও অসমতা সম্পর্কে যে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি, কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাত্ত্বিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক বাস্তবতার সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছি। তাই দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সমতা আমার কাছে আজ আর কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। দেশভেদে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অসমতার স্বরূপ, তার ভিন্নতা এবং সুনির্দিষ্ট সমাধান সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনেছি। তাত্ত্বিক শুদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, বিমূর্ত কোনো ধারণা থেকে বিভ্রান্ত হইনি, উল্টাপাল্টা উদাহরণ নিয়ে বেপথু হইনি—না চিন্তায়, না কাজে।

এই রকমের আরেকটি ধারণাকেও আমি বিমূর্তভাবে দেখিনি। ধারণাটি হচ্ছে ‘সামাজিক ন্যায্যতা’। সামাজিক ন্যায্যতার নিরিখে ব্যক্তিগত বনাম গোষ্ঠীগত কল্যাণ নিয়ে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে—মূলত দার্শনিক মাত্রিকতা বনাম এর প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে। আমরা পরে এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য, যেখানে প্রতিটি সমাজ পৌঁছাতে চায়।

সে পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা ঠিক নয় যে কোনো একটি দেশ পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করতে পেরেছে। আমরা প্রায়ই সুইডেন, নরওয়ে কিংবা ডেনমার্কের উদাহরণ দিই সামাজিক ন্যায্যতার ব্যাপারে। সেসব দেশে অর্জন অনেক সামাজিক ন্যায্যতার ক্ষেত্রে, কিন্তু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সেখানে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জিত হয়ে গেছে। বহুবার সেসব দেশে কার্যোপলক্ষে গিয়ে গৃহহীন মানুষের দেখা মিলেছে রাস্তায়, নেশাগ্রস্ত মানুষকে দেখেছি রেলস্টেশনে। তখনকার সুইডিশ সহপ্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লেভিনের সঙ্গে আলোচনায়ও এটা উঠে এসেছে। সুতরাং ওইসব দেশে বঞ্চিত মানুষ নেই, রাষ্ট্র সবার সবকিছু দেখছে এবং সামাজিক ন্যায্যতার দেশে মন্দ কিছু নেই—এমন ভাবাটা একটি আবেগপ্রসূত মনের ফল মাত্র।

তাত্ত্বিক আলোচনা বনাম সমাজবাস্তবতার ফারাকের দুটি উদাহরণ আমাদের দেশ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। ফলে সেসব দল বহু ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং সেসব দলের প্রাসঙ্গিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম মূল্যস্ফীতি নিয়ে। যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নীতিমালার উপকরণ ব্যবহার করেও দেশের মূল্যস্ফীতির অশ্বের ঊর্ধ্বগতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। কেননা, মূল্যস্ফীতির বাস্তব কারণটা রয়েছে কাঠামোগত। সেখানে হাত না দেওয়া পর্যন্ত সমস্যার সমাধান মিলবে না।

শেষের কথা হচ্ছে, যেকোনো আর্থসামাজিক বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাগবেই। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সেটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত বটে, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দ্বারা চালিত হতে হবে—সেটাই অভীষ্ট, তাতেই মঙ্গল।

লেখক: সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের বিপক্ষে সেমির আগেই ধাক্কা খেল অস্ট্রেলিয়া

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত