রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি শেষ হচ্ছে

জাহীদ রেজা নূর  
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮: ৫৭
Thumbnail image
যুদ্ধ নয়, কূটনীতি দিয়েই ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে চাইছেন। ছবি: এএফপি

যাঁরা একটু পুরোনো আমলের মানুষ, তাঁদের মনে এখনো আমেরিকা-রাশিয়া নিয়ে অনেক আগ্রহ। পৃথিবী বদলে গেছে। এই রাশিয়া যে বিগত সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শিক উত্তরসূরি নয়, সে কথাও সবাই জানে। তার পরও সত্তর ও আশির দশকের ঠান্ডা লড়াইকালের রাশিয়া-আমেরিকাকেই এখনো মনের মধ্যে স্থান দিয়ে রাখা হয়েছে। পুতিনের রাশিয়া যে সাম্যবাদ চর্চার ভরসাস্থল নয়, সে কথা মানতে চায় না সেই সময়ের মানুষের মন। তাই তাঁরা এখনো বিশ্বের মূল লড়াই আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে হচ্ছে বলে মনে করেন।

কিন্তু বদলে যাওয়া পৃথিবীতে পৃথিবীর মালিক হওয়ার প্রতি আগ্রহ জন্মেছে অনেকের। অনেকেই অর্থনৈতিক অবস্থা পোক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এর মধ্যে এশিয়ার চীনকে এগিয়ে রাখতে হয়। ইউরোপের দেশগুলোয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে দুর্দশা তৈরি হয়েছে, তাতে বিশ্বের মোড়লিপনার জন্য তারা আর যোগ্য নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে। এককভাবে কোনো দেশ ভবিষ্যতে পৃথিবীর ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে কি না, তা নিয়েও চলছে ভাবনাচিন্তা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো পৃথিবীজুড়েই পরাজয়ের স্বাদ কেন পাচ্ছে, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তার শেষ নেই।

ব্রিকস নিয়ে যে সম্ভাবনা জেগেছে, তার ওপরও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। যদিও মার্কিন নির্বাচনে জয়ী হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প ডলারের জায়গায় অন্য কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রার ব্যাপারে হুমকি দিয়েছেন, তার পরও ডলারের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের বাইরে এসে পৃথিবী অন্য কোনো বিনিময়যোগ্য মুদ্রার দিকে যাচ্ছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। এত কিছু জানার পরও রাশিয়া-আমেরিকার পুরোনো দ্বন্দ্বই যে এখন পর্যন্ত অনেকের ভাবনার প্রধান সংঘাত হিসেবে টিকে রইল, সেটা বিস্ময়কর। তবে এ কথাও তো ঠিক, পুতিনের পুঁজিবাদী রাশিয়া কোনো না কোনোভাবে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবেই টিকে আছে। পুতিন জুজুর ভয় মার্কিন দেশে এখনো দেখানো হয়। কমিউনিজমের কোনো চিহ্নই পুতিনের রাশিয়ায় নেই, কিন্তু দেশটিকে শত্রু ভাবা হলে অস্ত্র ব্যবসা ভালোভাবে চলে, এটাও মার্কিন ভাবনার অন্তর্নিহিত কারণ হতে পারে।

২. যা হোক, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তাঁর ভাবনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে পৃথিবীজুড়েই। যদিও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সমাজতন্ত্রের সৈনিকেরা যখন সারা পৃথিবীতেই আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন, কোন পথে এগিয়ে যেতে পারলে সব মানুষের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি মিলবে, তা নিয়ে দোদুল্যমান, তখন বর্তমান রাশিয়াকে সমাজতন্ত্রের তীর্থভূমি ভাবাটা অন্যায়। এখানেই সবচেয়ে বড় সংকটটা দেখা যাবে। রাশিয়া বা পুতিনের প্রতি কেন সমাজতন্ত্র-প্রত্যাশীদের পক্ষপাত, তার কার্যকারণ জানার চেষ্টা দুরূহ কাজের একটি। সমাজতন্ত্র আসলে কোথায় কীভাবে টিকে আছে, তা নিয়ে গবেষণা করলে কোনো প্রশ্নের উত্তর কি পাওয়া যাবে? এ নিয়েও ভাবনার শেষ নেই। এ কথা মনে রেখেই মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

মার্কিন নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলেছিলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি দেখতে চান তিনি। এক দিনেই এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন। ট্রাম্পের এসব প্রচারণা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু ট্রাম্প যত সহজে যুদ্ধের অবসান দেখছেন, বাস্তব সমস্যা আদতে কি ততটা সহজ?

মজার ব্যাপার হলো, পুতিনের জন্য বাইডেন যতটা আরামদায়ক প্রতিপক্ষ ছিলেন, ট্রাম্প ততটা নন। পুতিন মনে করে থাকেন, বাইডেনের চালগুলো বোঝা যায়, কিন্তু ট্রাম্প কখন কী বলবেন আর কী করবেন, সেটা বোঝা কঠিন। বাইডেন সেই ঠান্ডা যুদ্ধ আমলের রাজনীতিবিদ, তাই তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাগুলো পড়া যায়। আর ট্রাম্প? না, তাঁকে নিয়ে আগাম কোনো ভাষ্য দেওয়া সম্ভব নয়।

বাইডেনের ওপর জেলেনস্কি খেপে আছেন। বাইডেন তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাজ করছেন না। তাই ট্রাম্পের ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতির দিকেও ঝুঁকে পড়তে পারেন জেলেনস্কি।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ মার্কিন নির্বাচনের আগে যদিও বলছিলেন যে, নির্বাচনে কে জয়ী হলো, তাতে রাশিয়ার কিছু আসে-যায় না। যিনিই ক্ষমতায় আসুন, রুশভীতি তাদের কারও মন থেকে মুছে যাবে না।’ কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, বাইডেনের সঙ্গেই কাজ করা ছিল সহজ।

৩. ইউক্রেন খুব চাইছিল, রাশিয়ার সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সার্বিক সাহায্য করুক। বাইডেন ইউক্রেনকে বুঝিয়েছিলেন, যুদ্ধটা যেন ইউক্রেনের সীমানা ছাড়িয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর দিকে ধাবিত না হয়। বাইডেন জেলেনস্কিকে রাশিয়ার দিকে দূরপাল্লার মিসাইল ব্যবহার করতে নিষেধ করেছিলেন। তাহলে আসলে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের কাছে চাইছেটা কী—এই প্রশ্ন জেলেনস্কির।

আর এ কারণেই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ইউক্রেনের জন্য কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে কি না, সেটাও জানতে চান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার কোনো সদুত্তর তিনি পাননি।

ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ রাশিয়ার জন্যও খুব প্রীতিকর হবে না। পুতিন জানেন, ট্রাম্পের গত শাসনামলেই রাশিয়ার ওপর সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। এমনকি ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ও এতটা কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। সের্গেই লাভরভ তো এ কারণেই বলেছেন, ‘ট্রাম্পই রাশিয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন, ‘আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমার মতো কঠোর হতে পারেননি।’ একজন রুশ কূটনীতিকও বলেছেন, ‘ট্রাম্পের পূর্ববর্তী শাসনামল রাশিয়ার জন্য ছিল সবচেয়ে খারাপ সময়।’ পুতিন ভুলে যাননি, বাইডেন নন, ট্রাম্পই ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করেছিলেন। ইউক্রেনকে তিনিই রাশিয়ার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছিলেন। বাইডেন শুধু তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনাতোল লিভেন যথার্থই বলেছেন, ‘রাশিয়ার অভিজাতেরা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেন না।’

জেলেনস্কি যদিও ভাবতে চাইছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তাঁর দেশের পক্ষে ইতিবাচক কিছু ঘটতে পারে, কিন্তু তিনি এ কথাও মনে রেখেছেন যে, যুদ্ধ নয়, কূটনীতি দিয়েই ট্রাম্প এই যুদ্ধ থামাতে চাইছেন। যার অর্থ দাঁড়ায়, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি পিছিয়ে যাবে এবং দেশের হারানো অঞ্চলগুলোও আর ফেরত পাওয়া যাবে না।

জেলেনস্কি এখন বুঝতে পারছেন, রাশিয়ার সঙ্গে এই যুদ্ধে ইউক্রেন জয়ী হবে না। এখন যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেন, তবে তা দেশবাসীর কাছে জেলেনস্কির জবাবদিহির পথ খুলে দেবে। অর্থাৎ তিনি বলতে পারবেন, বাইডেন যুদ্ধজয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেননি, ট্রাম্প হুমকি দিয়ে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসাচ্ছেন, ইউক্রেন এ অবস্থায় কী করবে? ইউক্রেন এই আলোচনায় বসার ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র প্রমাণ হিসেবে ইউক্রেনবাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করবে। কিংবা নরমভাবে বলতে পারে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের কারণেই আমরা আলোচনার টেবিলে বসলাম। আমাদের আর কী দোষ?’

৪. তবে একটি বিব্রতকর অবস্থায় পেড়েছেন জেলেনস্কি।ব্রিটেনের মার্ক হলিংসওয়ার্থ সরাসরি দুষছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে। যুদ্ধের জন্য এত ঋণ নিচ্ছেন ভদ্রলোক, শোধ করবেন কোত্থেকে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। মার্ক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ট্যাংক-রকেটসহ নানা অস্ত্র কেনার জন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড দিয়েছে ইউক্রেনকে। শুধু কি যুক্তরাষ্ট্র? লুক্সেমবার্গের মতো ছোট দেশও বুলেট আর দেহবর্ম দিয়েছে ইউক্রেনকে। আলবেনিয়ান অ্যামবুলেন্স, বেলজিয়ান স্লিপিং ব্যাগ এবং আইরিশ পিকআপ ভ্যানগুলোর কথাও এখানে বলতে হবে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, গত মার্চ পর্যন্ত পৃথিবীর ৪১টি দেশ জেলেনস্কি সরকারকে ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো সহযোগিতা করেছে। পশ্চিমা সাহায্য ও ঋণের পরিমাণ অনেক এবং এই টাকা নিয়ে দুর্নীতির কথাও শোনা যাচ্ছে।

দুর্নীতির কথা বলতে হলে বলতে হয়, এই প্রশ্নে ইউক্রেন বাংলাদেশকে ছেড়ে কথা বলে না। ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুর্নীতির ভয়াবহতা বেড়েছে। এ বছরই অস্ত্র কেনা বাবদ ৪০ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, কিন্তু তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে না। বড় মাপের কর্মকর্তারাই এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবৈধভাবে অর্জন করা এই টাকার সিংহভাগ এরই মধ্যে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেনাকাটায় এই জালিয়াতি খুবই সংবেদনশীল ব্যাপার। বিষয়টিকে ঠিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া না হলে ভবিষ্যতে মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তা ইউক্রেনে অর্থায়নে বাধা হয়ে উঠতে পারে।

যুদ্ধের অবসান ঘটলেও এই প্রশ্নের সদুত্তর তো দিতেই হবে ইউক্রেনকে। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে আলোচনাগুলো যে একরৈখিক থাকবে না, সে কথা এখন নিশ্চিন্তে বলা যায়।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত