মধ্যরাতের মূল্যোত্থান!  

বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৮: ০০
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৮: ২০

এত দিন জেনে এসেছি, বিভিন্ন দেশে মধ্যরাতে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়! শনিবার ঘুম থেকে উঠে জানলাম, আগের রাতে এমনই উত্থানের ঘটনা ঘটেছে। তবে তা জ্বালানি তেলের মূল্যোত্থান। ডিজেল, পেট্রল, অকটেনের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিকে আর কী বলা যায়!

সামরিক অভ্যুত্থান সাধারণত বলেকয়ে হয় না, জানান দিয়ে হয় না, আকস্মিকভাবে রাতের আঁধারেই হয়। তবে তার আগে একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। অবশ্য প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কিন্তু জানান দিয়ে, প্রস্তুতি নিয়েই অভ্যুত্থান করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকেই তিনি নানাভাবে এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি ছাড়া আর উপায় নেই। বিএনপির বিচারপতি সাত্তার দেশকে রসাতলে ঠেলে দিচ্ছেন, দুর্বৃত্ত-অপরাধীরা মন্ত্রীর বাসায় আশ্রয় পাচ্ছে। তাই জাতির ত্রাতা হিসেবে তিনি এক মধ্যরাতে বয়োবৃদ্ধ বিচারপতিকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে নিজেই জাতির ভার কাঁধে তুলে নেন। এমন পরোপকারী স্বেচ্ছাসেবক দ্বিতীয়টি পাওয়া কঠিন!

বলা হয়ে থাকে, এরশাদ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় বসেছেন। কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু ক্ষমতায় বসে তিনি অনেক রক্ত ঝরিয়েছেন।

শুক্রবার মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের যে মূল্যোত্থান হয়েছে, সেটাও রক্তপাতহীন, কিন্তু এর ফলে মানুষের হৃদয়ে যে গভীর রক্তক্ষরণ হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এমনিতেই মূল্যবৃদ্ধির করাতকলে চাপা পড়ে মানুষের জীবন যায় যায় অবস্থা, তার ওপর এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আরেক দফা দাম বাড়বে সব পণ্যের। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু ব্যয় বাড়ছে অব্যাহতভাবে। মানুষকে কৃচ্ছ্রসাধনের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া অধিকাংশ মানুষই তো কৃচ্ছ্রসাধন করেই চলছেন সেই করোনাকালের শুরু থেকেই। মানুষের পেট পিঠে ঠেকেছে আর পিঠ ঠেকেছে দেওয়ালে। দেওয়ালের পেছনে যেতে হলে তো দেওয়ালটা ভাঙতে হবে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আওয়াজ তো পাওয়া যাচ্ছিলই। কে যেন বলেছিলেন, অবিলম্বে দাম না বাড়ালে জ্বালানি তেল পাচার হয়ে যাবে দেশের বাইরে। কোনো দেশপ্রেমিকই ‘পাচার’ ব্যাপারটা বরদাস্ত করতে পারে না। এমনিতেই টাকা পাচার নিয়ে নাচার অবস্থায় আছি আমরা! যাক, আসি আসি করে দাম বাড়ানোর ঘোষণাটা এসেই গেল। এখন সাধারণ মানুষের অবস্থা তো ত্রাহি মধুসূদন। করোনার ভয়াবহ মারণাঘাত বিশ্বজুড়ে মানুষের সাজানো জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। সেই তাণ্ডব শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে এক নতুন সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। কবে, কীভাবে এই যুদ্ধের অবসান ঘটবে, কী হবে মানব জাতির ভবিষ্যৎ, তা এখন আর কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এই যুদ্ধে শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা তো নয়; এর অভিঘাত বিশ্বজুড়ে, এমনকি বাংলাদেশের নিভৃত এক পল্লিবাসীর জীবনকেও সংকটময় করে তুলেছে।

1

যুদ্ধের কারণেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সংকট ও দাম বাড়ার কথা জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছিল। ডিজেল, পেট্রল, গ্যাসের দাম বাইরের দুনিয়ায়, বিশেষ করে যেখান থেকে আমরা আমদানি করি, সেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে আমাদের সরকার তো আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে পারে না। আমাদের সরকারও দাম বাড়ানোর দৌড় প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।

সরকার ভর্তুকি দিতে পারবে না, কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে। তা ছাড়া সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি তো আর উচ্চ বেতনের চাকরিজীবী নয়, বরং উচ্চ বেতনের চাকরিজীবীরাই সরকার পরিচালনা করেন। সরকারের দেশ চালানোর যে ব্যয়, তা তো দেশের মানুষের কাছ থেকেই সংগ্রহ করা হয়। সরকারের সমস্যা হলে মানুষের কাছে কিংবা বিদেশি মহাজনদের কাছেই হাত পাতে। কিন্তু দেশের মানুষের যখন সমস্যা হয়, তখন মানুষ কার কাছে হাত পাতবে?

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, যত দিন সম্ভব ছিল, তত দিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর চিন্তা করেনি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা সমন্বয় করতে হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হবে।

মন্ত্রী সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন। তবে প্রশ্ন হলো, সরকার তো ‘নিরুপায়’ হয়ে নিজের চাপ কমানোর জন্য মূল্য সমন্বয় করল, এখন সাধারণ মানুষ কীভাবে নিজেদের আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করবে? তারাও তো নিরুপায় অবস্থায়ই আছে! জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। মানুষের ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে পণ্য পরিবহন ব্যয়। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের বড় অংশই মানুষের ঘাড় মটকে মুনাফার টাকা পকেটে ভরতে ওস্তাদ। পরিবহন মালিকেরাও নিজেদের লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। আবার রাজনীতিবিদেরাও এখন জনসেবার পরিবর্তে রাজনীতিকে বানিয়ে ফেলেছেন ব্যবসা। রাজনীতি ও ব্যবসা একাকার হয়ে এমন এক দুষ্টচক্র গড়ে উঠছে, যা মানুষকে কোনো আশার আলো দেখাচ্ছে না।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কদিন আগে কিছুটা যেন ভয়ের কথাই শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র জোরদার করা হচ্ছে। ঘাতকেরা একসময় আমাদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। আজও তারা তৎপর। আমাকে ও আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে চক্রান্ত করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও করেছে। আবার এখন নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন আমাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে এ দেশের মানুষের কল্যাণ হয় না।’

বিভুরঞ্জন সরকারশেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশে চক্রান্ত করে কার কী লাভ হবে জানি না, তবে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতিই হবে। কারণ, আমরা তো এক-একটা জিনিস টার্গেট করে কাজ করছি। যেমন বলেছি একটি মানুষও ভূমিহীন থাকবে না। জাতির পিতা যে পদক্ষেপ শুরু করেছিলেন নোয়াখালী থেকে। আমি সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। এখন আরও ৫৬ হাজার ঘর তৈরি হচ্ছে (বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য)। তাহলে এখানে আর কোনো ভূমিহীন থাকবে না।’

দেশে ভূমিহীন-গৃহহীন খুঁজে বের করায় সরকারের পাশাপাশি দলের নেতা-কর্মীদেরও দায়িত্ব দিয়েছেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ‘তার পরেও আমি আলাদাভাবে খবর নিচ্ছি। রংপুরসহ বিভিন্ন বিভাগে আমাদের কৃষক লীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বলেছি, কোথায় কে ভূমিহীন-গৃহহীন রয়েছে, তাদের খোঁজ করে তালিকা করতে হবে। এক-একটা এলাকা ধরে আমাকে তালিকা দিতে বলেছি, যাতে কেউ বাদ না যায়। আমরা তাদের ঘর করে দেওয়ার পাশাপাশি জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেব। কেননা, বাংলাদেশে একটা মানুষও আর ভূমিহীন বা গৃহহীন থাকবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিলেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা সীমিত করতে বাধ্য হয়েছি। কেবল আমরাই নই, এখন ইউরোপের দেশগুলো থেকে শুরু করে আমেরিকা পর্যন্ত জ্বালানি সাশ্রয় করছে। কাজেই আমরা আগাম ব্যবস্থা নিচ্ছি ভবিষ্যতে যেন বিপদে না পড়তে হয়। তা ছাড়া ১ কোটি মানুষকে আমরা স্বল্পমূল্যে খাবার দিচ্ছি, অর্থাৎ কোনো মানুষ যাতে কষ্টে না থাকে সেটাই আমাদের চেষ্টা।’

মানুষের কষ্ট কমাতে গিয়ে সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ বিএনপির কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে, তার আলামতও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিএনপির মতো একটি বড় দল গিয়ে ধরনা দিচ্ছে রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুরের সদ্য ভূমিষ্ঠ দলের দরবারে। ছোট দলের বড় কথা হজম করে সরকার পতনের আন্দোলন করাকে এখন কোন উত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সেই উক্তি মনে পড়ছে: কুকুরে লেজ নাড়ে, না লেজে কুকুর?

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

জ্বালানি তেল সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত