এ কে এম শামসুদ্দিন
৪ অক্টোবর আজকের পত্রিকার একটি শিরোনাম দেখে বেশ আগ্রহ নিয়েই সংবাদটি পড়লাম। শিরোনামটি ছিল, ‘সরকারি চাকরিজীবী: সম্পদের হিসাব দেননি একজনও’। খবরটি চমকপ্রদ হলেও গুরুত্বপূর্ণ। ‘চমকপ্রদ’ এ কারণে যে, সরকারি চাকরিজীবী হয়েও সরকারি কোনো নির্দেশ গণহারে অমান্য করার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম দেখল দেশবাসী। আমরা এত দিন ক্ষমতাসীনদের আস্থাভাজন কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা শুনেছি। আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবহারে তাঁদের অনেক সহকর্মীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ভালো ও মন্দের বিভাজন থাকলেও সম্পদের হিসাব না দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের এমন ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সত্যিই চোখে পড়ার মতো। তবে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তাগাদা থাকা সত্ত্বেও তা অমান্য করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের অসৌজন্য আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এরই সঙ্গে ১৯৭৯ সালে জারি করা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার বরখেলাপও হয়েছে বটে। এই বিধিমালার মাধ্যমে পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম করা হয়।
গত ২৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে বিধিমালা বাস্তবায়নে চিঠি দিয়ে এর অগ্রগতি জানাতে বলেছিল। এরপর তিন মাস পার হয়ে গেলেও কারও হিসাব জমা পড়েনি; বরং সম্পদের হিসাব জমা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সচিব পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ভেতর একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্পদের হিসাবটি কোথায় জমা দেবেন, এ বিষয়ে একেক জনের একেক রকম বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এরূপ বক্তব্য শুনে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার ইচ্ছেই যদি থাকত, তাহলে তিন মাস চলে যাওয়ার পর কোথায় জমা দিতে হবে—এ প্রশ্ন না তুলে, নোটিশ জারির পরপরই তা পরিষ্কার করে নিতে পারতেন। এ বিষয়টি দু-একজন পরিচিত চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলে চমকে গেছি। তাঁদের অনেকে মনে করছেন, ‘সম্পদের হিসাব আলাদাভাবে দেওয়ার কী প্রয়োজন আছে? প্রতিবছর তো সরকারি চাকরিজীবীদের আয়কর রিটার্ন জমা দিতেই হয়। সেই আয়কর বিবরণী তৈরির সময় সবাই সম্পদের হিসাব দাখিল করে থাকেন। কাজেই নতুন করে সম্পদের হিসাব দেওয়ার দরকার নেই!’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘বিধিমালা তো জারি হয়েছিল সেই জিয়াউর রহমানের আমলে! জিয়ার অনেক কিছুই যখন আমরা বর্জন করেছি, তখন এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কী আছে?’ তাঁদের প্রশ্ন, ‘এই বিধিমালা জারির পর এযাবৎ কোনো চাকরিজীবী কি সম্পদের হিসাব দিয়েছেন?’ তাঁরা অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের বার্ষিক আয় ও সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন। আমরা কি আজ পর্যন্ত সরকারের সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেখেছি? তাঁরা নিজেরাই যখন নিজেদের হাঁড়ির খবর জানাতে অপারগ, তখন আমাদের হেঁসেল নিয়ে টানাটানি কেন?’
এ কথা ঠিক, ২০১১ সালের ৪ জুলাই মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও সমমর্যাদার ব্যক্তিদের সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রার্থীর (মন্ত্রী পদমর্যাদার নেতা) দাখিল করা সম্পদের বিবরণী নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় হয়েছিল। দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেওয়া সম্পদের বিবরণী অনুযায়ী যে নেতা ৪ বিঘা জমির মালিক ছিলেন; সেই নেতা ক্ষমতার ৫ বছরের মধ্যেই ঢাকার গুলশানে বাড়ি-গাড়িসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ৪০০ একরের বেশি জমির মালিক হয়ে গেছেন। এসব সম্পত্তির বিবরণ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সম্পদের হলফনামার বিবরণী থেকে জানা গিয়েছিল।
আমাদের দেশে নির্বাচন ঘিরে একটি বিষয়ে সবার মাঝে উৎসাহ লক্ষ করা যায়। তা হলো, প্রার্থীদের সম্পদের হলফনামা। এই হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদের হিসাবসহ আটটি বিষয়ে অঙ্গীকার করে থাকেন। প্রতি নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেছে, প্রার্থীদের চেয়ে তাঁদের স্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি শক্ত অবস্থান ছিল। তা ছাড়া, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দেশে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেখানে ৫.২ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে বলে উল্লেখ করা ছিল। এ হিসাব চাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, দেশের মানুষ যাতে বুঝতে পারে, একজন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হওয়ার আগে কী পরিমাণ সম্পদ ছিল তাঁর, দায়িত্ব নেওয়ার পর কী পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়ে তখন জোরালো উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। শোনা গেছে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বলে সহকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। এ ঘটনার তিন মাসের মাথায় মন্ত্রিসভার আরেক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের নতুন করে জনসমক্ষে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে না। নির্বাচনের আগে দাখিল করা তথ্যই যথেষ্ট। তখন থেকে আজ অবধি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব দাখিল হয়েছে বলে শুনিনি। সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপিরাও সম্পদের হিসাব দেবেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য খুবই আশাব্যঞ্জক শোনালেও দেশের কতজন মানুষ তা বিশ্বাস করেছে, সন্দেহ আছে। উল্লেখ্য, পাশের দেশ ভারতে নির্বাচন শেষ হওয়ার তিন মাসের মাথায় ‘মেম্বার্স অব দ্য লোকসভা ডিক্লারেশন অব অ্যাসেট’ আইনের আওতায় সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব দিতে হয়। পাকিস্তানের ১৯৭৬ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং সিনেট অ্যাক্ট (ইলেকশন) অনুযায়ী, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। সুযোগ পেলেই দুর্নীতির আখড়া বলে আমাদের ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা যে পাকিস্তানকে নিয়ে যখন সমালোচনা করেন, তখন পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ায় সে দেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের ২১২ জন সদস্যের সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির মূলে তিনটি ভিন্ন চরিত্রের মানুষের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। চাকরিজীবী এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া রাজনীতিক, অর্থাৎ মন্ত্রী-এমপি পর্যায়ের ব্যক্তি, যিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন এবং বেসরকারি খাতের অন্যান্য ব্যক্তি; বিশেষ করে ব্যবসায়ী মহল। চাকরিজীবী বলতে সরকারি ও বেসরকারি (ব্যাংকে চাকরি করেন) চাকরি করেন এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। এই তিন বিশেষ চরিত্রের ব্যক্তিদের যোগসাজশেই এ দেশের বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে থাকে। চাকরিজীবী, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী বলতে এখানে ঢালাওভাবে সবাইকে বোঝানো হচ্ছে না। প্রায় এক যুগ ধরে যেসব ব্যক্তি বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের প্রায় সবাই সমাজে পরিচিত। তারপরও অদৃশ্য শক্তির বলে তাঁরা যখন পার পেয়ে যান, তখন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি চাকরিজীবীরা সেই সুযোগ যে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক; অতঃপর সরকারি নির্দেশের তোয়াক্কা না করে সম্পদের হিসাব দেওয়া থেকে যে তাঁরা বিরত থাকবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত ১০ বছরে সরকারি অনেক কর্মকর্তাই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট গুটিকয়েক কর্মকর্তার দুর্নীতির পিলে কাঁপানো ঘটনা দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়ও তুলেছে। একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নিম্নপর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মীর সাড়াজাগানো দুর্নীতির ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এসব চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীকে আইনের আওতায় আনা গেলেও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা কিন্তু রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে দুর্নীতির ঘোড়দৌড় এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, বড় বড় দুর্নীতির ঘটনাগুলোও এখন মানুষের গা-সহা হয়ে গেছে। সরকারি চাকরিজীবী, মন্ত্রী এবং এমপিদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার কারণও কিন্তু দুর্নীতি! অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে যেন কেউ রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে না পারেন, এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, পাকিস্তানের মতো একটি দেশ একই ব্যবস্থা যদি কার্যকর করতে পারে, তাহলে আমাদের দেশে কেন নয়?
কারণটা মনে হয় অন্যখানে! এই কারণ অনুসন্ধানের জন্য বেশি দূর যেতে হবে না। আমরা সবাই তা জানি। আমরা জানি কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না বলে অনেকেই এখন কোলে চেপে বসার চেষ্টা করছেন। সম্ভবত এ জন্যই চাকরিজীবীরা সরকারের নির্দেশ অমান্য করার সাহস পান। কথায় বলে ‘শর্ষের ভেতর যদি ভূত থাকে, তাহলে ভূত তাড়াবে কে?’ অন্যের ঘাড়ের ভূত তাড়ানোর আগে নিজের ঘাড়ে চেপে বসা ভূতটাকে আগে তাড়াতে হবে। আমাদের রাজনীতিকেরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন; দেশের জন্য ততই মঙ্গলকর।
৪ অক্টোবর আজকের পত্রিকার একটি শিরোনাম দেখে বেশ আগ্রহ নিয়েই সংবাদটি পড়লাম। শিরোনামটি ছিল, ‘সরকারি চাকরিজীবী: সম্পদের হিসাব দেননি একজনও’। খবরটি চমকপ্রদ হলেও গুরুত্বপূর্ণ। ‘চমকপ্রদ’ এ কারণে যে, সরকারি চাকরিজীবী হয়েও সরকারি কোনো নির্দেশ গণহারে অমান্য করার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম দেখল দেশবাসী। আমরা এত দিন ক্ষমতাসীনদের আস্থাভাজন কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা শুনেছি। আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবহারে তাঁদের অনেক সহকর্মীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ভালো ও মন্দের বিভাজন থাকলেও সম্পদের হিসাব না দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের এমন ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সত্যিই চোখে পড়ার মতো। তবে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তাগাদা থাকা সত্ত্বেও তা অমান্য করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের অসৌজন্য আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এরই সঙ্গে ১৯৭৯ সালে জারি করা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার বরখেলাপও হয়েছে বটে। এই বিধিমালার মাধ্যমে পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম করা হয়।
গত ২৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে বিধিমালা বাস্তবায়নে চিঠি দিয়ে এর অগ্রগতি জানাতে বলেছিল। এরপর তিন মাস পার হয়ে গেলেও কারও হিসাব জমা পড়েনি; বরং সম্পদের হিসাব জমা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সচিব পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ভেতর একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্পদের হিসাবটি কোথায় জমা দেবেন, এ বিষয়ে একেক জনের একেক রকম বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এরূপ বক্তব্য শুনে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার ইচ্ছেই যদি থাকত, তাহলে তিন মাস চলে যাওয়ার পর কোথায় জমা দিতে হবে—এ প্রশ্ন না তুলে, নোটিশ জারির পরপরই তা পরিষ্কার করে নিতে পারতেন। এ বিষয়টি দু-একজন পরিচিত চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলে চমকে গেছি। তাঁদের অনেকে মনে করছেন, ‘সম্পদের হিসাব আলাদাভাবে দেওয়ার কী প্রয়োজন আছে? প্রতিবছর তো সরকারি চাকরিজীবীদের আয়কর রিটার্ন জমা দিতেই হয়। সেই আয়কর বিবরণী তৈরির সময় সবাই সম্পদের হিসাব দাখিল করে থাকেন। কাজেই নতুন করে সম্পদের হিসাব দেওয়ার দরকার নেই!’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘বিধিমালা তো জারি হয়েছিল সেই জিয়াউর রহমানের আমলে! জিয়ার অনেক কিছুই যখন আমরা বর্জন করেছি, তখন এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কী আছে?’ তাঁদের প্রশ্ন, ‘এই বিধিমালা জারির পর এযাবৎ কোনো চাকরিজীবী কি সম্পদের হিসাব দিয়েছেন?’ তাঁরা অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের বার্ষিক আয় ও সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন। আমরা কি আজ পর্যন্ত সরকারের সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেখেছি? তাঁরা নিজেরাই যখন নিজেদের হাঁড়ির খবর জানাতে অপারগ, তখন আমাদের হেঁসেল নিয়ে টানাটানি কেন?’
এ কথা ঠিক, ২০১১ সালের ৪ জুলাই মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও সমমর্যাদার ব্যক্তিদের সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রার্থীর (মন্ত্রী পদমর্যাদার নেতা) দাখিল করা সম্পদের বিবরণী নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় হয়েছিল। দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেওয়া সম্পদের বিবরণী অনুযায়ী যে নেতা ৪ বিঘা জমির মালিক ছিলেন; সেই নেতা ক্ষমতার ৫ বছরের মধ্যেই ঢাকার গুলশানে বাড়ি-গাড়িসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ৪০০ একরের বেশি জমির মালিক হয়ে গেছেন। এসব সম্পত্তির বিবরণ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সম্পদের হলফনামার বিবরণী থেকে জানা গিয়েছিল।
আমাদের দেশে নির্বাচন ঘিরে একটি বিষয়ে সবার মাঝে উৎসাহ লক্ষ করা যায়। তা হলো, প্রার্থীদের সম্পদের হলফনামা। এই হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদের হিসাবসহ আটটি বিষয়ে অঙ্গীকার করে থাকেন। প্রতি নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেছে, প্রার্থীদের চেয়ে তাঁদের স্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি শক্ত অবস্থান ছিল। তা ছাড়া, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দেশে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেখানে ৫.২ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে বলে উল্লেখ করা ছিল। এ হিসাব চাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, দেশের মানুষ যাতে বুঝতে পারে, একজন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হওয়ার আগে কী পরিমাণ সম্পদ ছিল তাঁর, দায়িত্ব নেওয়ার পর কী পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়ে তখন জোরালো উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। শোনা গেছে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বলে সহকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। এ ঘটনার তিন মাসের মাথায় মন্ত্রিসভার আরেক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের নতুন করে জনসমক্ষে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে না। নির্বাচনের আগে দাখিল করা তথ্যই যথেষ্ট। তখন থেকে আজ অবধি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব দাখিল হয়েছে বলে শুনিনি। সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপিরাও সম্পদের হিসাব দেবেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য খুবই আশাব্যঞ্জক শোনালেও দেশের কতজন মানুষ তা বিশ্বাস করেছে, সন্দেহ আছে। উল্লেখ্য, পাশের দেশ ভারতে নির্বাচন শেষ হওয়ার তিন মাসের মাথায় ‘মেম্বার্স অব দ্য লোকসভা ডিক্লারেশন অব অ্যাসেট’ আইনের আওতায় সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব দিতে হয়। পাকিস্তানের ১৯৭৬ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং সিনেট অ্যাক্ট (ইলেকশন) অনুযায়ী, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। সুযোগ পেলেই দুর্নীতির আখড়া বলে আমাদের ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা যে পাকিস্তানকে নিয়ে যখন সমালোচনা করেন, তখন পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ায় সে দেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের ২১২ জন সদস্যের সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির মূলে তিনটি ভিন্ন চরিত্রের মানুষের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। চাকরিজীবী এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া রাজনীতিক, অর্থাৎ মন্ত্রী-এমপি পর্যায়ের ব্যক্তি, যিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন এবং বেসরকারি খাতের অন্যান্য ব্যক্তি; বিশেষ করে ব্যবসায়ী মহল। চাকরিজীবী বলতে সরকারি ও বেসরকারি (ব্যাংকে চাকরি করেন) চাকরি করেন এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। এই তিন বিশেষ চরিত্রের ব্যক্তিদের যোগসাজশেই এ দেশের বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে থাকে। চাকরিজীবী, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী বলতে এখানে ঢালাওভাবে সবাইকে বোঝানো হচ্ছে না। প্রায় এক যুগ ধরে যেসব ব্যক্তি বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের প্রায় সবাই সমাজে পরিচিত। তারপরও অদৃশ্য শক্তির বলে তাঁরা যখন পার পেয়ে যান, তখন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি চাকরিজীবীরা সেই সুযোগ যে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক; অতঃপর সরকারি নির্দেশের তোয়াক্কা না করে সম্পদের হিসাব দেওয়া থেকে যে তাঁরা বিরত থাকবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত ১০ বছরে সরকারি অনেক কর্মকর্তাই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট গুটিকয়েক কর্মকর্তার দুর্নীতির পিলে কাঁপানো ঘটনা দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়ও তুলেছে। একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নিম্নপর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মীর সাড়াজাগানো দুর্নীতির ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এসব চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীকে আইনের আওতায় আনা গেলেও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা কিন্তু রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে দুর্নীতির ঘোড়দৌড় এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, বড় বড় দুর্নীতির ঘটনাগুলোও এখন মানুষের গা-সহা হয়ে গেছে। সরকারি চাকরিজীবী, মন্ত্রী এবং এমপিদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার কারণও কিন্তু দুর্নীতি! অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে যেন কেউ রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে না পারেন, এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, পাকিস্তানের মতো একটি দেশ একই ব্যবস্থা যদি কার্যকর করতে পারে, তাহলে আমাদের দেশে কেন নয়?
কারণটা মনে হয় অন্যখানে! এই কারণ অনুসন্ধানের জন্য বেশি দূর যেতে হবে না। আমরা সবাই তা জানি। আমরা জানি কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না বলে অনেকেই এখন কোলে চেপে বসার চেষ্টা করছেন। সম্ভবত এ জন্যই চাকরিজীবীরা সরকারের নির্দেশ অমান্য করার সাহস পান। কথায় বলে ‘শর্ষের ভেতর যদি ভূত থাকে, তাহলে ভূত তাড়াবে কে?’ অন্যের ঘাড়ের ভূত তাড়ানোর আগে নিজের ঘাড়ে চেপে বসা ভূতটাকে আগে তাড়াতে হবে। আমাদের রাজনীতিকেরা এ কথা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন; দেশের জন্য ততই মঙ্গলকর।
৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্
১৯ ঘণ্টা আগেইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি করেছে। ইরানের ওপর সাম্প্রতিক ইসরায়েলি বিমান হামলা ঝুঁকি বাড়ালেও তা পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধের পথে পা বাড়ানোর কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। ইসরায়েলের এখনকার লক্ষ্য তার সীমানা সুরক্ষিত করা। অন্যদিকে ইরানের দরকার বর্তমান শাসন-ক্ষমত
২০ ঘণ্টা আগেবিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের এক হাটে কৃষকের আনাগোনা, শোরগোল। ভ্যানে তুলে বস্তা বোঝাই আলু এনে আশানুরূপ দাম না পেয়ে হতাশ তাঁরা। বলছিলেন, কৃষিকাজই বাদ দিয়ে দেবেন। তাঁরা যে আলু বিক্রি করেন কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকায়, সেই আলুই ভোক্তার হাতে যায় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। মাঝের এই মূল্য বৃদ্ধির পথ প
২০ ঘণ্টা আগেলিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই বাগিয়ে নিতে হয় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পদগুলো। লিখিত পরীক্ষায় যাঁরা বাকিদের টেক্কা দিতে পারেন, পরবর্তী মওকা তাঁদের জন্য সুরক্ষিত। মৌখিক পরীক্ষায় উতরে গেলেই চাকরি নিজের। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ পায় কী করে কিছু পরীক্ষার্থী—বিষয়টি শুধু অ
২১ ঘণ্টা আগে