Ajker Patrika

মতামত /শেখ হাসিনার জঙ্গি দমনের পেছনের গল্প

এম আবুল কালাম আজাদ
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২: ০১
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় এক অধ্যায় রচিত হয় জঙ্গিদমন অভিযানে, কিন্তু সেটা মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে শুধু সরকার ও তার বাহিনীর বয়ান তুলে ধরা, যেখানে কতটা দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে তারা জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করেছে সে চিত্র ফুটে উঠত। এর পেছনে যে এক অন্যায় ও অমানবিক দিক রয়েছে তা মিডিয়ায় উঠে আসেনি, ফলে সেটা অন্ধকারেই রয়ে যায়।

আমরা জানি, ২০১৩ সাল থেকে জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলা হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা হয় হলি আর্টিজান বেকারিতে। এসব হামলায় বিদেশি নাগরিকসহ অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। আওয়ামী লীগ সরকার সেসব হামলা প্রতিহত করতে না পারলেও শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে সংসদে দাবি করেন জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল।

এমন দাবির পেছনে কারণ রয়েছে বলে যুক্তিও দেওয়া হয়। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জঙ্গিদের দমনে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়ে। তাই যেকোনো মূল্যে জঙ্গিদমনে সাফল্য দেখানোর প্রয়োজন। এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা জঙ্গিদের আটক করতে মরিয়া হয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক জঙ্গি আস্তানা খুঁজে পায় এবং সফল অভিযানে বড় বড় জঙ্গির মৃত্যু ঘটে। একই সঙ্গে শুরু হয় জঙ্গি আটকের হিড়িক। নবগঠিত সিটিটিসি ছাড়াও পুলিশ, র‍্যাব ও ডিবি দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে শত শত মানুষকে জঙ্গি হিসেবে আটক শুরু করে।

পরিস্থিতি দেখে মনে হয় যে পুরো দেশ জঙ্গিতে ছেয়ে গেছে। বাংলাদেশ যেন এক জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাংবাদিক হিসেবে জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও জঙ্গি আটকের ঘটনা নিয়ে আমাদের মাঝে সন্দেহ জন্মে। অনেকে মনে করে, অভিযান বা আটকের অনেক কিছু সাজানো। তবে যেহেতু তখন কেউ তা খতিয়ে দেখেনি বা আনুসন্ধান করেনি তাই পুলিশের দেওয়া তথ্য বা ন্যারেটিভের বাইরে অন্যকোনো গল্প থাকলেও তা চাপা পড়ে যায়।

দু-তিনটি ঘটনা নিয়ে মিডিয়া আনুসন্ধান করলে ভিন্ন রকম তথ্য বেরিয়ে আসে, যার সঙ্গে পুলিশ বা র‍্যাবের দেওয়া তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। এ থেকে ধারণা হয়, প্রতিটি ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো অন্য গল্প লুকিয়ে আছে।

সে সময় জঙ্গি ধরার এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয় বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে। প্রকৃত জঙ্গিদের ধরার পাশাপাশি নিরীহ নারী-পুরুষদের জঙ্গি বানানোর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তারা নানান রকম গল্পের আশ্রয় নেয়। কিন্তু কীভাবে, কেন এমন অন্যায় করা হয় তা জানতেই ২০২১ সালে নারী জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করি। অবাক হয়ে দেখি, জঙ্গিদমনে সাজানো নাটক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপকতা দেখে। ঘটনার যত ভেতরে প্রবেশ করি ততই জানতে পারি র‍্যাব, পুলিশ, ডিবি একই ধরনের গল্পের অবতারণা করে কীভাবে নিরপরাধ মানুষদের আটক করেছে, অনেককে বড় জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

পরিসং‌খ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানের অনেক ঘটনাই অসত্য। অর্থাৎ জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিদমন অভিযান সম্পর্কে আমরা বাইরে থেকে বা গণমাধ্যম থেকে যা জানি, তার বাইরেও আছে অন্য ঘটনা। সারা দেশ চষে বেড়িয়ে যেসব ঘটনা তুলে এনেছিলাম তার কয়েকটির কথা আজ তুলে ধরলেই বোঝা যাবে কেন ঘটনার পেছনের ঘটনা খুঁজতে হবে।

ভুয়া সুইসাইড স্কোয়াড মেম্বার

২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জ জেলা ডিবি পুলিশ চার নারীকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে জানায় যে, তারা নব্য জেএমবির সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য এবং ফিদায়ি হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ডিবি রাত আড়াইটায় তাদের এক গ্রাম থেকে আটক করে। আটক এক নারীর বাড়িতে তারা গোপন বৈঠক করছিল।

নারীদের মধ্যে ছিল একজন মা ও তার দুই অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, আর মধ্য বয়সী আরেকজন। যারা দুজনেই নিরক্ষর।

এই ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুসারে, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম আটক নারীদের ছবি ও ভিডিওসহ ফলাও করে রিপোর্ট করে।

অথচ প্রকৃত ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই নারীদের ডিবি পুলিশ এক মাস পূর্বে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং সেটা দিনের বেলায় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে। এরপর তাদের পুলিশ ডিবি অফিসে আটকে রেখে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও শারীরিক নির্যাতন করে জবানবন্দী আদায় করা হয়।

সত্য ঘটনা বের করা কঠিন ছিল না। এই নারীদের সিরাজগাঞ্জ শহর থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরের গ্রাম থেকে তুলে আনা হয়। গণমাধ্যম চাইলেই সেখানে গিয়ে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পারত। তা করা হয়নি। ফলে পুলিশের বানানো গল্প সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, গ্রামের নিরীহ নারীরা সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে খ্যাতি পায়।

সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের এমন ভূমিকায় পুলিশ আরও উৎসাহিত হয়।

সিরাজগঞ্জ ডিবির ওই টিম একই ধরনের আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়। আবার তারা চার নারীকে হাজির করে দাবি করে যে, তাদের শহরের এক বাড়িতে মধ্যরাতে গোপন বৈঠক করার সময় আটক করা হয়। সাংবাদিকেরা এবারও যাচাই বা অনুসন্ধান না করে পুলিশের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরে।

এই দুই ঘটনার অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, ওই নারীদের বাড়ি বিভিন্ন জেলায় এবং ডিবি একেক জনকে একেক স্থান একেক সময়ে তুলে এনে পূর্বের ঘটনার মতো অফিসে আটকে রেখে ও একই কায়দায় জবানবন্দী আদায় করে। এভাবেই তারা সফলভাবে জঙ্গি দমনের একেকটা উদাহরণ তৈরি করতে থাকে।

পহেলা বৈশাখবিরোধী লিফলেট ও ৯ জঙ্গি

২০১৮ সালে রাজশাহী জেলার এক বালিকা বিদ্যালয়ে দুজন ছাত্রী লিফলেট বিলি করে, যেখানে লেখা ছিল পহেলা বৈশাখ পালন করা ইসলামবিরোধী তাই তা পরিহার করা উচিত। তারা স্থানীয় ইসলামি ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

ঘটনার তিন দিন পর পুলিশ স্থানীয় এক জামায়াত নেতার বাড়িতে মধ্যরাতে অভিযান করে জামায়াত নেতা, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও তাঁর ভাইয়ের তিন মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে সাংবাদিকদের সামনে তাঁদের উপস্থাপন করে পুলিশ জানায়, আটককৃতরা নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা রাত ২টার সময় গোপন বৈঠক করে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। বৈঠকে বোমা হামলা চালিয়ে জীবন দিয়ে হলেও তাঁরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন প্রতিহত করবে বলে সভায় তাঁরা আলোচনা করেন।

স্থানীয় সাংবাদিকেরা পুলিশের ভাষ্যমতে রিপোর্ট করে।

ওই এলাকায় কয়েকদিন অনুসন্ধানের পর জানা যায়, ঘটনাটা এক ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলের নেতারা লিফলেটের ঘটনাকে ঘিরে ওই জামায়াত নেতাকে শায়েস্তা করতে চায়। আর তাই মধ্যরাতে অভিযান চালাতে দেরি হয়। স্থানীয় অনেক বাসিন্দা এসব জানেন। জঙ্গি ধরতে পুলিশ এতোটাই বেপরোয়া হয় যে, ওই ঘটনায় করা মামলায় তারা দূরের আরেকটি গ্রাম থেকে জামায়াত নেতার আত্মীয় দুজন নারীকে আটক করে।

স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, তিনি প্রকৃত ঘটনা জানলেও সেটা নিয়ে রিপোর্ট করার সাহস পাননি।

২ দিনব্যাপী বন্দুক যুদ্ধ, ২টি লাশ

২০১৭ সালের এপ্রিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে জঙ্গি অভিযানে পারদর্শী সিটিটিসি ও সোয়াতের সদস্যরা সেখানে যায়। গ্রামবাসীদের সরিয়ে দিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে দুই দিনব্যাপী গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যেন বড় এক সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। দুই দিন পর আস্তানার বাড়িতে ঢুকে পুলিশ দুটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। দাবি করে, এরা নিজেরা বোমা ফাটিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পায়ে গুলিবদ্ধ এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তাঁর শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এমন ভাষ্য সব মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।

পুলিশের নথিতে বলা হয়, পুলিশ মোট ২ হাজার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এর বিপরীতে জঙ্গিদের দিক থেকেও অনেক গুলি করার কথা। সে ক্ষেত্রে জঙ্গিদের কাছে ভারি অস্ত্র ও গুলি থাকার কথা। কিন্তু তার প্রমাণ অভিযান শেষে পাওয়া যায়নি।

আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত বাড়ির দেয়ালে অনেক গুলির দাগ থাকলেও আশপাশের কোনো বাড়ির দেয়ালে দেখা যায়নি। জঙ্গিরা গুলি করলে তা থাকার কথা।

এখানেও সন্দেহের অনেক উপাদান থাকায় অনুসন্ধানে করতে নেমে অন্যরকম তথ্য পাওয়া যায়। আহত নারী ও তাঁর স্বামী যে বাড়িতে বসবাস করতেন সেটি ছিল এক প্রবাসীর। তিনি তাঁদের সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। ওই নারীর স্বামী যাকে পুলিশ বড় জঙ্গি হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে খুব ধার্মিক ও ভিন্নভাবে নামাজ পড়ার কারণে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখত বলে আহত নারী ও আশপাশের গ্রামবাসীরা জানায়।

অন্য যে ব্যক্তির লাশ সেখানে পাওয়া গেছে তিনি বড় জঙ্গি ছিলেন। ওই জঙ্গি ঢাকার ডিবি অফিস থেকে পালিয়ে যান। তবে পুলিশ তাঁকে আবার আটক করে। অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশের দুজন সদস্য জানান, তাঁকে আগেই মেরে লাশ ওই বাড়িতে নেওয়া হয়েছিল। আর আহত নারীর স্বামীকে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলি করা হয় বলে তাঁরা জানান।

ফলে মধ্যরাতের অনেক গোপন বৈঠক আসলেই যে সংগঠিত হয়নি এগুলো তার প্রমাণ।

সত্যিকার অর্থে প্রায় সব জঙ্গি ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো গল্প আছে যা আমরা জানি না।

যেমন, ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনায় শাকিরা নামের এক নারী আত্মঘাতী হামলা চালায়। দেশের ইতিহাসে সেটা প্রথম। সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় সেটা প্রকাশিত হয়। আত্মসমর্পণ না করে ওই নারী তার কোমরে বেঁধে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে সেখানে তার মৃত্যু হয়। সঙ্গে থাকা তার মেয়ে আহত হলেও উপস্থিত কোনো পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়নি।

এই ঘটনা নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করেনি। তবে এর সঙ্গেও অন্য এক সত্য লুকিয়ে আছে। আর তা হলো, শাকিরাকে খুব কাছে থেকে গুলি করা হয়, যা সিটিটিসি একাধিক সদস্য নিশ্চিত করেছে।

সোয়াতের এক শুটার যিনি সে সময় উপস্থিত ছিলেন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, তিনি নিজেও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন এবং সেগুলো শাকিরাকে বিদ্ধ করে। মজার ব্যাপার হলো, শাকিরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলির কথা উল্লেখ করা হয়নি। এমন ঘটনাও ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। শাকিরা আত্মঘাতী হয়েছে, নাকি গুলিতে মারা গেছে সে প্রশ্ন অমীমাংসিত।

বাংলাদেশের নারী জঙ্গিদের আগাপাশতলা জানতে প্রায় তিন বছর আমরা গবেষণা করেছি। গবষেণালব্ধ ফল জার্মানি থেকে ২০২৩ সালে ‘উইমেন ইন টেরোরিজম ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটির সহ-লেখক জার্মান গবেষক ও লেখক ড. ইয়াসমিন লরচ।

সেই বইয়ে নিহত শাকিরার ঘটনার মতো আরো অনেক কাহিনীর বর্ণনা উঠে এসেছে।

যৌথ এই গবেষণায় বেরিয়ে আসে, ১২০ জন নারীকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে, যাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন নিরপরাধ। এই সংখ্যা পুরুষ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি বলে পুলিশ ও র‍্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

জঙ্গি দমনে নাটক কেন?

জঙ্গি দমনে হাসিনা সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ছাড়াও সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও জঙ্গি ধরার জন্য বিশেষ প্রণোদনা, পুরস্কার, পদোন্নতি, ভালো পদায়ন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় আকর্ষণের বিষয় ছিল মিডিয়ায় ব্যাপক কাভারেজ।

২০১৬ সাল থেকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে জঙ্গি ধরার এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যে যত সফল জঙ্গি অভিযান ও জঙ্গি আটক করেছে তারা ততই বাহিনী ও সরকারের বাহাবা পেয়েছে। বিপিএম ও পিপিএম তো ছিলই। ফলে এই প্রতিযোগিতা মাঠ পর্যায়ের পুলিশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

আবার অভিযানের ঘটনাকে বড় করে দেখানো হয় বেশি মিডিয়া কাভারেজ ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির জন্য। প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে, ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পুলিশ দমন করতে পারে।

২০১৫ সাল থেকে নারী জঙ্গির সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। যেহেতু নারীদের সংবাদমূল্য বেশি ফলে প্রকৃত নারী জঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিবাদে জড়িত না এমন অনেককে আটক করা হয়। নারীদের একটা গ্রুপ হিসেবে দেখালে গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এই প্রবণতা প্রবল আকার ধারণ করে।

গবেষণা ও অনুসন্ধানের সময় অনেক পুলিশ ও র‍্যাবের কর্মকর্তা তথ্য ও নথি দিয়ে সহায়তা করেন।

এদের অনেকে জানিয়েছেন কীভাবে তৈরি গল্পের মাধ্যমে নিরাপরাধ নারী-পুরুষদের জঙ্গি বানানো হয়েছে। আর এটা বেশি করেছে র‍্যাব। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপে এটা করতে হয়েছে বলেও দাবি তাদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্র্যাপ করে কিছু ধার্মিক ব্যক্তিকে জঙ্গি হিসেবে ধরা হয়, সে তথ্য অবলীলায় স্বীকার করেছেন দুই কর্মকর্তা।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে সবাই জানতেন কীভাবে এমন অন্যায় কাজ করা হচ্ছে। সবাই নীরব ছিলেন। কারণ এ থেকে তাঁরা নিজেরা ও সরকার বড় ধরনের সুবিধা পেত।

ব্যাপারটা সরকারের ভেতরে অজানা ছিল না। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক শহিদুল হকের লেখা বই থেকে এর প্রমাণ মেলে। তিনি তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পান্থপথে জঙ্গি অভিযানের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছিলেন, এখানে এসে এমন নাটক না করলেও পারতে।

প্রকৃত ও ফেইক জঙ্গি সবাই নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। ধনী পরিবারের সদস্য ছাড়া কেউই সহজে আইনি সুবিধা পায়নি, জামিনও পায়নি। জঙ্গিদের আইনি সহযোগিতা না দেওয়ার জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেই উকিলদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

এটা নিরপরাধ ব্যক্তিদের জন্য বেশি মর্মান্তিক। একদিকে তারা জঙ্গিবাদে জড়িত না, অন্যদিকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আইনি লড়াইয়ের জন্য উকিল না পাওয়া, বছরের পর বছর কারাবন্দি থাকা তাদের জন্য অনেক বড় অন্যায়। জামিনের পর মামলার ঘানি বয়ে বেড়ানো তো আছেই।

একজন নিরপরাধ নারী বা পুরুষকে জঙ্গি তকমা দিলে তার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যায়। এই কালিমা তার পক্ষে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রের সব ধরনের সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত হয়। চাকরি না পেয়ে তারা পরিবার ও সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তারা অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের কাছে জঙ্গিবাদ বড় একটি রাজনৈতিক কার্ড ছিল। এই কার্ড তারা শেষ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। কিন্তু জঙ্গি দমনের নামে বড় সংখ্যক নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার ও তাদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা বড় ধরনের অন্যায়। কিন্তু মিডিয়া জেনে অথবা না জেনে বিষয়টি এড়িয়ে যায় বলে এখনো মানুষ সে সম্পর্কে জানে না।

মিডিয়া যে কোনো ঘটনা বিনা প্রশ্নে বা খতিয়ে দেখা ছাড়া প্রকাশ করলে সেটা মানুষ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনে না, বরং অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। জঙ্গিবাদ সাংবাদিকতা এর বড় উদাহরণ।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সংযোগ সড়কহীন সেতু

সম্পাদকীয়
সংযোগ সড়কহীন সেতু

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।

সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।

অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।

সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

জাহীদ রেজা নূর
এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’

ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।

রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।

রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’

আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:

— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?

— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।

পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:

— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?

— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।

স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:

নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু

ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।

রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’

কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’

একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’

এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।

এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।

কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে

চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।

দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’

প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’

চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।

বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।

২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।

ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।

নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।

নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।

এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।

আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।

দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।

তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।

চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।

পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।

অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।

২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।

আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।

সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যা করণীয়

সম্পাদকীয়
যা করণীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।

আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত