রাজনীতির পালাবদলের বছর

চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮: ০০
Thumbnail image
২০২৪ সালে বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ছবি: আজকের পত্রিকা

একাত্তরের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় পালাবদলের বছর হলো ২০২৪। টানা প্রায় ১৬ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালানোর পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হয় টানা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী শেখ হাসিনাকে। অভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ গণ-অভ্যুত্থান সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছে, অনেক কিছু ভেঙেচুরে দিয়েছে। কেবল স্থাপনা নয়, প্রচলিত ধারণা, চিন্তা-বিশ্বাস, দর্শন, মূল্যবোধ, গতানুগতিক রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। নতুন এক সম্ভাবনা ও শঙ্কার মুখে দাঁড়িয়েছে দেশ।

বছরের শুরুটা হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সমালোচনা এবং প্রধান বিরোধী দলগুলোর বয়কটকে অগ্রাহ্য করে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ জানুয়ারি ২০২৪। একতরফা এই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। যদিও জাতীয় পার্টি ও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে।

কিন্তু সব সমালোচনা ও প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নতুন সরকার গঠনের কিছুদিন পর পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাদের দুর্নীতির বিষয়গুলো গণমাধ্যমে আসতে থাকে। সবচেয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ। এর পরপরই আলোচনায় আসে মতিউর রহমান নামে এক এনবিআর কর্মকর্তার ছেলের ছাগল কেনার ঘটনা। কোরবানির ঈদের সময় ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১২ লাখ টাকায় মতিউরপুত্র ইফাতের ছাগল কেনার কথা ফেসবুকে লিখলে সেটা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সরকারি এক কর্মকর্তার ছেলে কোরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় ছাগল কেনার ঘটনায় মতিউর রহমানের সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

দুর্নীতির এসব ঘটনার মধ্যেই দেশে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে। শুরুতে সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমিত থাকলেও ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যের জের ধরে কোটা আন্দোলন আরও জোরদার হয়। শুরু হয় সহিংসতা। সংঘাত-সহিংসতা একপর্যায়ে তা গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ২০২৪-এর ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।

এটা সত্যিই অভাবনীয় যে আপাতদৃষ্টে কোটা সংস্কারের মতো একটি ছোট ও নিরীহ দাবির আন্দোলন কীভাবে অতিদ্রুত কয়েক দিনের মধ্যে একটি ব্যাপক ও তীব্র গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এর পেছনে ছিল ক্ষমতাসীনদের প্রতি মানুষের সীমাহীন ক্ষোভ। নানা কারণেই জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ ধূমায়িত ছিল, এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশিত হয়। জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দাম, সংকুচিত চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কারণে জনসাধারণের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। পাশাপাশি ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ এবং বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন। পনেরো বছর বেশি সময় ধরে সারা দেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট ও ক্ষমতার দাপটে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বিরক্ত ছিল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আন্দোলন দমনের দাম্ভিকতা। বিক্ষোভ দমন করার জন্য তাঁদের অত্যধিক শক্তিপ্রয়োগের ফলে মাত্র কয়েক দিনে অসংখ্য ছাত্র-জনতা হতাহত হয়, যা প্রতিবাদের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

আগস্টে সরকার পতনের পর দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ব্যাপক গণরোষের শিকার হয়। ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকার কর্তৃক নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় আসে। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০১৪ সালে দশম, ২০১৮ সালে একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রত্যেক নেতা-কর্মীর বেফাঁস মন্তব্য, আমিত্ব, অহমিকা, দাম্ভিকতা, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন, গুমের অভিযোগ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল যে দাবি ছিল, তা সমাধান করা ছিল অত্যন্ত সহজ একটা ব্যাপার। কিন্তু সরকারের একগুঁয়েমি এবং দলের দায়িত্বশীল নেতাদের আত্মম্ভরী মন্তব্যের কারণে শেষরক্ষা হয়নি।

বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময়ই জটিল। বর্তমানে তা আরও জটিলতর হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কার্যত ‘নেই’ হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষসহ ছাত্র-জনতার ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হওয়া এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অহমিকার কারণে পতন ঘটেছে ঐতিহ্যবাহী দলটির। দলের শীর্ষ নেতারা অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। কেউ কেউ দেশ ছাড়ার চেষ্টার সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন। হেভিওয়েট অনেকের আদালতে বিচার চলছে, আত্মগোপনে বেশির ভাগ নেতা। গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দলটি। আওয়ামী লীগের সেই শূন্য অংশ পূরণে এখন নানা গোষ্ঠী তৎপর। বিএনপি আপাতত সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল। রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কঠিন সংকটের মুহূর্তে তারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নতুন করে রাজনীতির মাঠে শক্ত অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দলকে নিয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের নতুন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাঠের রাজনীতিকে কিছুটা হলেও আলোচনায় রেখেছে। বছরের শেষ দিনে এই নতুন দলের নতুন ঘোষণাপত্র ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ছাত্র-তরুণদের এই দল নতুন রাজনীতি রচনার ভরকেন্দ্র হবে, নাকি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাবে, তার ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি।

বলে রাখা ভালো যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ মাস পরেও নাজুক পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারেনি। এখনো আইনশৃঙ্খলার অবনতি মোকাবিলা করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সরকার সফল হতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজনের জন্য চাপ দিচ্ছে। যদিও সরকার বলছে, তারা একটি অর্থবহ গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পক্ষে। যদিও সংস্কারের পক্ষে সরকারের ভূমিকা এখনো দৃশ্যমান নয়। এখন পর্যন্ত সংস্কার উদ্যোগ ব্যক্তিপর্যায়ের রদবদলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। চাকরিচ্যুতি, নিয়োগ, বদলি, কাউকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া, কাউকে জেলে ঢোকানো, প্রতিপক্ষের নামে নতুন নতুন মামলা দেওয়া, পুরোনো মামলা তুলে নেওয়ার মধ্যেই সরকারের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত কেবল শিক্ষা কারিকুলামের ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা অবশ্য আমাদের দেশে এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে আর কিছু করুক না করুক, সবার আগে শিক্ষা দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা হয়। এমন তৎপরতা কয়েক দশক ধরেই চলছে। রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল সংস্কারের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হয়ে উঠে আসেনি। সংস্কারের পাশাপাশি বিভক্তির বদলে ঐক্য়ের বা অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) বাংলাদেশ গঠনের কথা জোরেশোরে বলা হলেও তার রূপরেখা কেমন হবে, কী কী থাকবে এই অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশে, সে ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট ধারণা এখনো পাওয়া যায়নি। অতীতে যেমন আওয়ামী লীগের বিপক্ষে গেলেই ‘রাজাকার’ আখ্যা দেওয়ার মানসিকতা দেখা গেছে, এখন অনেক ক্ষেত্রেই সে জায়গা নিয়েছে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’, ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ।

বাংলাদেশের সমাজ নানা ইস্যুতে এমনিতেই প্রচণ্ড মাত্রায় বিভক্ত। সেই বিভক্তিকে কীভাবে একসূত্রে গাঁথা যাবে এবং ঐক্য কোন প্রক্রিয়ায় মজবুত করা হবে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই ইস্যুতে অস্পষ্টতা দূর করার উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থকদের মধ্যে একধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে নিগৃহীত হচ্ছেন। তাঁদের ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে মোটেও ইতিবাচক নয়। বাংলাদেশের পতাকা মাথায় বেঁধেই আন্দোলনকারীরা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এই পতাকার নেপথ্য কারিগরদের যত দূরে ঠেলে দেওয়া হবে, বিভক্তি তত বাড়বে।

এখনো জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। মব ট্রায়াল, মাজারে হামলা, তিন বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচারের পরিবর্তে সেগুলোকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে। এগুলোর সুষ্ঠু সমাধান না হলে কি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

অনেক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আমরা নতুন বছরে পদার্পণ করছি। পুরোনো শাসনব্যবস্থা, পুরোনো নেতৃত্ব, পুরোনো রাজনীতি ও পুরোনো জমানা পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর ওপর নির্ভর করছে আমাদের আগামীদিনের রাজনীতি। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের ফলে সব ধরনের আশঙ্কার মেঘ কেটে গিয়ে নতুন দিনের সূর্যের দেখা মিলবে—দেশবাসী সেই প্রতীক্ষায় আছে।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সমালোচকদের ধুয়ে দিলেন রোহিত

আজহারীর মাহফিলে অসংখ্য মানুষের স্বর্ণালংকার-মোবাইল খোয়া, থানায় জিডির হিড়িক

মানিকগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়ি ভাঙচুর মামলায় গ্রেপ্তার আসামির ঢামেকে মৃত্যু

টিউলিপকে লন্ডনের ফ্ল্যাটদাতা কে এই মোতালিফ, কীভাবে তিনি হাসিনা-ঘনিষ্ঠ

টিউলিপ সিদ্দিককে বিনামূল্যে লন্ডনে ফ্ল্যাট দেন আ.লীগ সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত