Ajker Patrika

বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে নতুন ফ্রন্ট খুলছে কোথায়

আজাদুর রহমান চন্দন
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গুণবতী ডিগ্রি কলেজে শহীদ মিনার ভাঙচুরের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। ছবি: আজকের পত্রিকা
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গুণবতী ডিগ্রি কলেজে শহীদ মিনার ভাঙচুরের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। ছবি: আজকের পত্রিকা

কোমর্বিডিটিসম্পন্ন রোগী, তাই সাধারণ সর্দি-গরমিও সয়ে চলা কঠিন। গত কয়েক দিন দেহের উচ্চ তাপমাত্রায় এতটাই কাহিল যে মাথা সোজা করাই ছিল ভার। টেলিভিশন বা পত্রপত্রিকা দূরের কথা, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকেও চোখ বোলানোর সুযোগ হয়েছে কম। ফলে চলতি সংখ্যার নির্ধারিত লেখাটির জন্য অপারগতা প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেব—এমনটা ঠিক করেই ফেলেছিলাম মনে মনে। কিন্তু বাদ সাধল অমর একুশে। এই দিনের আবেগ প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের এতটাই গভীরে প্রোথিত যে শত বছরেও তা একটুও মলিন হওয়ার নয়। আর এই দিনেই কিনা চোখে পড়ল আঁতকে ওঠার মতো কিছু বার্তা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের ফেসবুক ওয়ালে। ছোট ছোট সেই সব বার্তার তাৎপর্য-পরিণাম অনেক ব্যাপক ও গভীর। কী সেই সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যবাহী বার্তা? ‘চট্টগ্রামে একুশের আবৃত্তি অনুষ্ঠান মাঝপথে বন্ধ করে শিল্পীকে হেনস্তা’, ‘চৌদ্দগ্রামে (কুমিল্লা) গুণবতী ডিগ্রি কলেজের শহীদ মিনার ভাঙচুর’, ‘মনিরামপুরে (যশোর) শহীদ মিনার ভেঙে টয়লেট নির্মাণের চেষ্টা’, ‘বরিশালে কনসার্ট করতে গিয়ে আতঙ্কে শিল্পীরা গভীর জঙ্গলে’, ‘মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে বাউলসম্রাট হিসেবে পরিচিত আব্দুর রশিদ বয়াতির বাৎসরিক ওরস মাহফিলে স্থানীয় তৌহিদি জনতার বাধা’। দ্রুত মূলধারার সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণ থেকে ঘটনাগুলো যাচাই করে নিলাম। বেশির ভাগ ঘটনাই অমর একুশের দিনের, বাকিগুলো আগের দিনের বা রাতের। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, দেশে এমন ঘটনা কি আগে আর ঘটেনি? নিশ্চয়ই ঘটেছে। তবে অমর একুশের দিনে এত মাত্রায় নয়। সবচেয়ে বড় বিষয়—এসব ঘটনায় কর্তৃপক্ষকে এমন নির্বিকার থাকতে কখনো দেখা যায়নি।

সেই ১৯৫২ সালের পর থেকেই ‘অমর একুশে’ পালিত হয়ে আসছে মহান ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায় বায়ান্নর চেতনা বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আশির দশক থেকেই যেন ‘বাতাসে একুশের সেই গন্ধ’ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না পুরোপুরি। শহীদ দিবস পালনের অনুষ্ঠানমালায় শুরু থেকেই যুক্ত ছিল হৃদয় নিংড়ানো বেদনা আর বুকফাটা কান্না। সেই শোক ও বেদনার অনুভূতির রূপায়ণ ছিল একুশের ‘প্রভাতফেরি’। পুরুষদের পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি বা প্যান্ট-শার্ট। মেয়েদের কালো পাড়ের সাদা শাড়ি। সবারই বুকে কালো ব্যাজ। নগ্ন পায়ে দুই সারিতে সুশৃঙ্খলভাবে রাজপথ ধরে পদযাত্রা। কারও হাতে ব্যানার অথবা ফেস্টুন। অধিকাংশ মানুষের হাতে ফুল। একেক দলের সামনে বা মাঝে গলায় হারমোনিয়াম ঝোলানো। সমবেত কণ্ঠে গান। মাঝেমধ্যে স্লোগান—‘শহীদ স্মৃতি, অমর হোক’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো’ ইত্যাদি। পাড়া-মহল্লা থেকে প্রভাতফেরিগুলোর শুরু। রওনা দেওয়ার সময়টা এমনভাবে ঠিক করা, যেন আজিমপুর গোরস্থানে শহীদদের কবরগুলোতে ফুল দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মিছিলটি যখন পৌঁছাবে, তখন পুব আকাশে কেবল আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সবখানে সবার মধ্যে ভাবগম্ভীর পরিবেশ। সবকিছু নিবেদিত শহীদদের স্মৃতিতে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য যে আবেগঘন পরিবেশ ফুটে উঠত প্রভাতফেরির মাধ্যমে, সেই ‘প্রভাতফেরি’ নেই করে দেওয়া হলো সামরিক শাসকের কলমের খোঁচায়। এত বছরেও তা আর ফিরিয়ে আনা গেল না।

একুশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অসাম্প্রদায়িকতা। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিল্পী আবদুল লতিফের এক অমর সৃষ্টি। ওই গানেই ফুটে উঠেছে ভাষা আন্দোলনের অন্তর্গত অসাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্য। শিল্পীর ভাষায় ‘জপ-কীর্তন, ভাসান-জারি/গাজীর গীত আর কবি সারি/আমার এই বাংলাদেশের বয়াতিরা/নাইচা নাইচা কেমন গায়’। ‘আমার এ দেশ সব মানুষের’ এই বার্তাও ভাষা আন্দোলনে প্রচ্ছন্ন ছিল, যার বাস্তব রূপায়ণ হওয়ার পথ করে দিয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু এখন তো ক্রমাগত আঘাত আসছে স্বাধীনতাসংগ্রাম, অমর একুশের ওপর। ক্ষেত্রবিশেষে ‘তৌহিদি জনতা’র নামে চালানো এসব ঘটনা দেখে যাঁরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন তাঁদের বলব, ধীরে বৎস, ধীরে। চারদিকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধের শেষ ফ্রন্টটি কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই বন্ধ করে দিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ইতিহাস বলে, যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ টিকতে পারে না। তাহলে নতুন ফ্রন্ট কি খুলবে না? এমনিতেই আমাদের ধারেকাছে নানা আলামত স্পষ্ট হচ্ছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। এখন আমাদের ‘তৌহিদি’ ভাইয়েরা যদি অতি উৎসাহে খোলা তলোয়ার হাতে সেক্যুলারপন্থী বা উদারপন্থীদের ওপর হামলে পড়তে শুরু করেন, তাহলে আমাদের এই ভূখণ্ডই যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নতুন ফ্রন্ট হয়ে উঠবে না, সে কথা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না।

বলে রাখা ভালো, ইউক্রেন নামের যে ফ্রন্টটি ট্রাম্প সাহেব বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, সেই যুদ্ধের সূচনা ২০২২ সালে দেখা গেলেও আসলে লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বসবাসকারী রুশ ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বকীয়তা ও অধিকারকে অস্বীকার করার মাধ্যমে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় কালার রেভল্যুশন তথা রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসন রুশ ভাষার ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করে। নতুন সরকার সে দেশের ২০১২ সালের ভাষা আইনটি বাতিল করার চেষ্টা করে, যা রুশ ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। ফলে সরকারের উদ্যোগ সফল হয়নি এবং পুরোনো আইন কার্যকর থাকে। ২০১২ সালে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ওই আইন পাস করেছিল, যা রুশ ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা দেয়। এই আইনের ফলে রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা, প্রশাসন এবং অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শে ২০১৯ সালে ইউক্রেন একটি নতুন রাষ্ট্রভাষা আইন পাস করে, যা ইউক্রেনীয় ভাষার ব্যবহারের ওপর জোর দেয়। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরে ইউক্রেনীয় ভাষার বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।

সেই থেকে কিছু শহর ও অঞ্চলে রুশ ভাষা ব্যবহারের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ শুরু হয়। অথচ একসময় খোদ ইউক্রেন ছিল রাশিয়ার অংশ। জার সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কিয়েভ।

বাংলাদেশে বরাবরই অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ওপর আঘাতটা করা হয় মূলত ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ বা ‘ধর্ম অবমাননা’র অজুহাতে দেশে যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে যেকোনো অমুসলিম এমনকি অসাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত মুসলিম ব্যক্তির ওপর হামলে পড়াটা খুব সহজ হয়ে উঠেছে। বিষয়টিকে সহজ করে তোলার ক্ষেত্রে মূল দায় সরকার ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর। এসব ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হতো, তারা যেন একবার ব্যাঙের গালে আর একবার সাপের গালে চুমু খায়। তখন অনেকবার বলেছি, দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে না পারলে কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়নই পারবে না ধ্বংস ঠেকাতে। তো সেই ‘কওমি জননী’র কী হাল হলো তা তো সবাই দেখছেন, কিন্তু শিক্ষা নিচ্ছেন না। এখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা সেক্যুলারপন্থীদের ওপর হামলা হলেও ধীরে ধীরে হানাহানি ছড়িয়ে পড়বে ইসলাম ধর্মেরই বিভিন্ন মাজহাবের অনুসারীদের মধ্যে। কে সাচ্চা মুসলমান, সেই প্রতিযোগিতা শুরু হবে সম্পদ ও ক্ষমতা কবজা করার স্বার্থে। বারবার বলে আসছি, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলাটা আগুন নিয়ে খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আগুন যে লাগাতে যাবে, তার হাতও যে পুড়বে না, সেই নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারবেন না। আর বাজারে আগুন লাগলে আলু পোড়া খাওয়ার লোকের অভাব তো কোনোকালেই হয়নি।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত