আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি

সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ২৬

আমার বাড়ি বরিশাল জেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে। নদীর তীরে বসে বিভিন্ন লঞ্চ, পণ্যবাহী কার্গোর চলাচল দেখতাম এবং নামগুলো মুখস্থ রাখতাম। সেই সময় এটা একটা ‘মনে রাখা’ প্রতিযোগিতার প্রক্রিয়া ছিল বটে।

এবার বাড়িতে গিয়ে দেখি, আগের মতো সে রকম লঞ্চের আনাগোনা নেই, পণ্যবাহী কার্গো আগের মতো যাতায়াত করে না। সবাই বলে নদীপথে সময় বেশি লাগে, তাই মানুষ নদীপথ ছেড়ে রাস্তার পথ ধরেছে। নদীপথে যে সস্তায় সবকিছু পরিবহন করা যায়, সেটা মানুষ ভুলে গেছে। সবকিছুই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনশীল সমাজকেই আমাদের মেনে নিতে হবে।

যা-ই হোক, একবার আমাদের বাড়ির সামনের সন্ধ্যা নদীতে ডুবোচরে একটি পণ্যবাহী কার্গো আটকা পড়েছে। সত্তর দশকের গোড়ার দিকের ঘটনা। বেলা আনুমানিক ৩টা। তখন ভাটির মাঝামাঝি সময়। কার্গোটি বেশ কিছুক্ষণ—প্রায় ঘণ্টা তিনেক হবে আটকা পড়েছে। আমরা সবাই নদীর তীরে বসে দেখছি। তীর থেকে কার্গোটির দূরত্ব আড়াই শ থেকে তিন শ মিটার। জাহাজের নাবিকেরা নির্ভীকভাবে হাঁটাচলা করছেন। ভেতরে হয়তো রান্নাবান্না হচ্ছে।

বেশ খানিকটা সময় যাওয়ার পর পাশের বাড়ির শাহেদা এসে বলল, ‘এই কার্গোটা আটকা পড়েছে অনেকক্ষণ হলো। এর মধ্যে একবার ভাত-তরকারি রান্না করে খাওয়া হয়ে যেত, আরও একবার ভাত রান্না করা যেত।’ অন্য বাড়ির গণি চাচা এসে বললেন, ‘এতক্ষণে পাঁচ মণ কাঠ কাটা যেত।’ অন্য এক বাড়ি থেকে জব্বার চাচা এসে বললেন, ‘এতক্ষণে কুড়ি মণ ধান সেদ্ধ করা যেত।’ মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, ‘ফজরের আজান দিয়ে নামাজ পড়ে সব কাজ সেরে, সকালের খাবার খেতে যে সময় লাগবে, সেই সময় অবধি কার্গোটি আটকা পড়ে আছে।’ আমার বড় চাচা ইসমাইল মাস্টার বললেন, ‘নদীতে এখন ভাটার শেষ, ভাটা শেষ হওয়ার পরে জোয়ার আসবে, সেই জোয়ার যখন শেষ প্রান্তে যাবে, তখন এ কার্গোটি ছাড়া পাবে, তাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগবে।’ তরকারি বিক্রেতা মহব্বত আলী বললেন, ‘এতক্ষণে বাজারে গিয়ে ৫০ টাকার তরকারি বিক্রি করে আসতে পারতাম।’

এখানে এই কার্গোর ডুবচরে আটকা পড়ার সময়টাকে যে যাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। শাহেদা ছিল পাঁচ ভাইয়ের এক বোন। সে ভাইদের রান্না করে খাওয়াত। তাই তার কাছে ওই রান্নাবান্নার সময়টাই পরিমাপের একক। গণি চাচা কাঠ কাটেন, তাঁর কাছে কাঠ কাটার সময়টা সময়ের একক। জব্বার চাচা ধান-চালের ব্যবসা করেন, তাই তাঁর কাছে ধান সেদ্ধর সময়টা সময়ের একক। মসজিদের ইমাম সাহেব তাঁর নিয়মের মধ্যে যে সময়টুকু সকাল থেকে হিসাব রাখেন, সেটাই তাঁর সময়ের একক। বড় চাচা লেখাপড়া জানা মানুষ, তিনি তাঁর জ্ঞান দিয়ে সময় প্রকাশ করেছেন। মহব্বত আলী তরকারি বিক্রেতা, তিনি তাঁর ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে সময়কে নির্ধারণ করেছেন।

আমরা সামনে যা কিছুই দেখি না কেন, নিজের জ্ঞানবুদ্ধি, নিজের কর্মকাণ্ডের হিসাব-নিকাশ করে সবকিছুকে মেলানোর চেষ্টা করি। এই মেলানোর জ্ঞানবুদ্ধি একেক জনের একেক রকম, দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রকাশভঙ্গিও ভিন্ন। সবাই নিজের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে সবকিছু প্রকাশ করেন, এটা মানুষের সহজাত স্বভাব।

এই যে দেখুন, কত রকম দল কত-কী বলে তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে। কেউ বলে ‘ঈদের পরে’, কেউ বলে ‘দুই-এক মাস পরে’, কেউ বলে ‘বৃষ্টি গেলেই’, কেউ বলে ‘শীত এলেই’। আসলে সবাই সবার মতো করে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব বলে। এখন আবার দেখি একেকটা তারিখ ঘোষণা করে—১০ তারিখ, ২৮ তারিখ, ১৪ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ—আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক করে দেয়। সবাই পেছনে যা ঘটে গেছে তার পুনরাবৃত্তি করতে চায়। ইতিহাস থেকে যে কেউ শিক্ষা নেয় না, তার একটা প্রমাণ এই সময় বেঁধে দেওয়া। আজ পর্যন্ত পেছনের কোনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে সরকার পরিবর্তন বা গণ-অভ্যুত্থান হয়নি।

এসব বেঁধে দেওয়া তারিখ যখন কাজে আসছে না, তখন দেখি বিদেশি শক্তির কাছে, শক্তিধর রাষ্ট্রের কাছে, শক্তিধর রাষ্ট্রের দূতাবাসের কাছে ধরনা দিতে। সবাই মনে করছে বিদেশি প্রভুরা এসে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করে দিয়ে যাবে। সবার একটা কথা মনে রাখা উচিত, বিদেশি প্রভুরা এখানে আসে আমাদের দেশ দখল করতে, আমাদের সম্পদ লুটতে, আমাদের স্বাধীনতাকে পরাজিত বা হরণ করতে। একটি সাধারণ কথা কেন যে আমাদের রাজনীতিবিদেরা বোঝেন না, সেটাই বোধগম্য নয়। পৃথিবীর সব দেশই নিজের দেশের স্বার্থ দেখবে, সে জন্যই তারা মিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের রাষ্ট্রদূতদের এবং দূতাবাস পোষে। সব দলের উচিত, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আন্দোলন-সংগ্রাম করা বা দাবি আদায়ের চেষ্টা করা।

একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘পুথিগত বিদ্যা পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন, হলে প্রয়োজন’। আমরা ইতিহাসের কিছু আন্দোলন-সংগ্রামের কথা জানি আর সেটাকেই যদি বিদ্যা বা অভিজ্ঞতা মনে করি, বিদেশি শক্তিকে যদি সত্যি মনে করি, তাহলে প্রয়োজনের মুহূর্তে কোনো অভিজ্ঞতাই কাজে লাগবে না। এ কথা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যাবে, জাতির জন্য, সমাজের জন্য তত তাড়াতাড়ি মঙ্গল আসবে। অযথা জীবনহানি, সম্পদহানির ঘটনা ঘটবে না। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-কষ্ট বাড়বে না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত