রজত কান্তি রায়
এবারের শারদীয় উৎসবে ছন্দপতন ঘটেছে বিস্ময়কর রকমের। প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় এ উৎসবে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তবে এ বছর ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। এরপরও বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ক্ষতির চরিত্রটি বহুমাত্রিক। প্রশ্ন হলো, ক্ষতি কি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়েরই হয়েছে? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষতির মুখে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও আছে। তাদের ক্ষতির ধরন যদিও আলাদা।
হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়েছে। গবাদিপশু খোয়া গেছে। স্বর্ণালংকার লুট হয়েছে। লুট হয়েছে মন্দিরের দানবাক্স ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে থাকা নগদ অর্থ। এ ক্ষতি তাৎক্ষণিক। এটা একটা দিক। দীর্ঘ মেয়াদে পুরো ঘটনার অভিঘাতে হিন্দুদের যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে, সেটা আরেকটা দিক। যদিও সে কথা আড়ালে রয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দ্রুতই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে বিভিন্ন মহলের আন্তরিক সহযোগিতায়; কিন্তু মানসিকভাবে পুরো সম্প্রদায় কি দ্রুত আগের জায়গায় ফিরতে পারবে? পারস্পরিক নির্ভরতা, বিশ্বাস আর নিরাপত্তার ভাবনা কি আগের মতোই থাকবে?
এই সাধারণ প্রশ্নগুলো তোলার কারণ আছে। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার দিক থেকে এগিয়ে থেকেছে সব সময়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত বাবরি মসজিদের ঘটনাও ওই এলাকায় খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেখানে ঘটেনি। এর কারণ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সহিষ্ণুতা ও প্রতিবেশীসুলভ আচরণ। প্রতিবছর শারদীয় উৎসবে পুরো রংপুর-দিনাজপুর জেলায় অনুল্লেখযোগ্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে একই কারণে।
কিন্তু গত দশ বছরে দৃশ্যটা ধীরে ধীরে বদলে গেছে। ২০১৩-১৪ সালের আগুন-সন্ত্রাস রংপুরসহ পুরো উত্তরবঙ্গকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেবারও হামলা হয়েছিল রংপুর-দিনাজপুরের বেশ কিছু মন্দিরে এবং মন্দিরের একজন সেবায়েতও খুন হয়েছিলেন। নীলফামারীর জলঢাকা ও দিনাজপুরের রানিরবন্দরে, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুরের দুর্গম এলাকাগুলোয় বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দুরা। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের গত এক দশকের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক কারণে সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার জায়গাটি ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেছে। কোনো ঘটনা এক দিনে ঘটে না। তার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে হয়। উত্তরবঙ্গে এ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। ফলে এবার পীরগঞ্জের ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনা জানান দিয়েছে সতর্কতার।
এবার ফেরা যাক অন্যদিকে। বলেছিলাম, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতির চিত্র বহুমাত্রিক এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরাও। হামলার পর যে মামলা হবে, পুলিশ আসবে, দৌড়ের ওপরে থাকতে হবে, মামলাবাজ বাঙালি সে বিষয়টা বেমালুম ভুলে যায়। আইনি প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য পুলিশ বিপুলসংখ্যক জনগণের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া কোনো ঘটনার পর অনেক মানুষকে আসামি করে। বেশ কিছু ন্যক্কারজনক ঘটনা শুরু হয় সেই মামলার পর।
এবারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর মামলা ও তাতে আসামি হওয়া মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়। রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ সহিংসতাসংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় মামলা হয়েছে মোট ১১৬টি। সেসব মামলায় আসামি ২২ হাজার ২২০ জন। তাদের মধ্যে এজাহারে নাম দিয়ে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৫৫১ জনকে। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ৭০৯ জনকে (আজকের পত্রিকা, ২৬ অক্টোবর)। আরও যে কয়েক শ মানুষ গ্রেপ্তার হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই সব মামলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ আসামি। আইনি প্রক্রিয়ায় কী ঘটবে, সেটা পরের বিষয়। এখন যা ঘটছে, সেটা কম কিছু নয়। ইতিমধ্যে ‘পুরুষশূন্য পীরগঞ্জের রামনাথপুর, চারদিকে ভয়ের আবহ।’ (আজকের পত্রিকা অনলাইন, ২৫ অক্টোবর) পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের হঠাৎ উপস্থিতি আতঙ্কিত করে তুলছে পীরগঞ্জের সাধারণ মুসলমানদের। কুমিল্লা, নোয়াখালী বা সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয়ও একই ঘটনা যে ঘটছে না, তা নয়। এই যে শত শত মানুষ আসামি, তারা সবাই ভাঙচুর, লুটপাট বা হামলার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মামলার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তাদের অনেকের সঙ্গেই প্রকৃত ঘটনার হয়তো দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে তারা আসামি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিটি এলাকায় মুসলমানরা এই মামলার চিপায় আছে। এর ফলে কয়েক ধরনের ক্ষতির শিকার তারা। আর্থিক ক্ষতি এ ক্ষেত্রে প্রধান। পুলিশ যখন গণমামলা দেয়, তখন নীরবে একধরনের গ্রেপ্তার-বাণিজ্য চলতে থাকে। সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। আর্থিক বিষয়টির বড় অংশ বরাদ্দ রাখতে হয় গণমামলা থেকে নিজেদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য। তার পরিমাণ কী, সেটা নির্ধারিত নয়। গণমামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য যে অর্থের লেনদেন হয়, তার ভাগের জন্য স্থানীয় ক্ষমতাবলয়ের অনেকেই ওত পেতে থাকে। ফলে সে অনির্ধারিত অর্থের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌঁছায়। আর যদি সত্যিই ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তিটির সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। গণমামলা থেকে বাঁচতে জমিজিরেত বিক্রির ঘটনাও আমাদের জানা। কারণ, গ্রামের মানুষের কাছে শহরের মানুষের মতো নগদ অর্থ থাকে না। নগদ অর্থের জন্য তাদের ধান-চাল বিক্রি বা জমি বন্ধক রাখতে অথবা বিক্রি করতে হয়, যখন অর্থের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌঁছায়। অর্থনৈতিক এ ক্ষতির যে দুর্বিষহ অভিঘাত, সেটা সাধারণ মানুষকে টেনে যেতে হয় দীর্ঘদিন।
এরপর থাকে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা না পড়ার জন্য আত্মগোপনে থাকার বিড়ম্বনা। সে জন্যও বিরাট অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি যে হয়, তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া থাকে অনির্দিষ্ট দিন পরিবার-পরিজন ছেড়ে এক উদ্বিগ্ন সময় কাটানোর মাসিক চাপ। পরিবার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উভয় পক্ষকেই এ চাপ সামলাতে হয়।
সহিংসতার মতো কোনো ঘটনার গণমামলায় যখন কারও নাম আসে, তাদের অনেককেই সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। যারা নির্দোষ কিন্তু মামলায় নাম আছে, তাদের পক্ষে এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরও চলতে হয় সামাজিকতার মধ্য দিয়েই। বেশির ভাগ মানুষ ঘটে চলা নেতিবাচক বিষয়গুলোকে সহজভাবে নেয় না। ফলে যারা মামলায় পড়ে বা ঘটনা সংশ্লিষ্টতায় যাদের নাম আসে, তারা সামাজিকভাবে খুব যে ভালো থাকে, তা নয়। মুখের ওপর কেউ কিছু বলে না হয়তো। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে নির্দিষ্ট মানুষটিকে নিয়ে চর্চা চলতে থাকে। তার পরিবারের মানুষেরাও রেহাই পায় না সেই চর্চার হাত থেকে। সামাজিকভাবে বয়কটের ভয় হয়তো থাকে না, তবে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহসও খুব একটা থাকে না তাদের। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন কিছু মানুষকে চিনি, যাঁরা ২০১৩-১৪ সালের আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনায় এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরে শহরে চলে গেছেন ‘লজ্জা’ থেকে বাঁচতে। সেই ঘটনাগুলো ঘটেছিল মূলত গণমামলায় নাম আসার কারণে। স্থানীয় ক্ষমতাবলয়ের অর্থনৈতিক লোভে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে নিরীহ মানুষদের গণমামলায় নাম আসার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়গুলো ‘ওপেন সিক্রেট’। সবাই জানে, বোঝে কিন্তু কিছু বলে না।
না হয় বোঝা গেল, টাকাপয়সা খরচ করে মামলা থেকে উদ্ধার পেল অনেকেই। কিন্তু প্রতিবেশীদের যে আস্থা তারা হারাল, তাদের ওপরে থাকা যে বিশ্বাসটা চলে গেল, সেটা ফেরত পাবে কীভাবে? রামনাথপুর কৃষক লীগের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি মো. আনোয়ারুল মণ্ডল। আজকের পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে তিনি বলেছেন, ‘বছরের পর বছর হিন্দু-মুসলিম একত্রে বসবাস করে আসছি। তারা মাছ ধরে, মাছ ব্যবসা করে। আর সেই মাছ আমরাই কিনে থাকি। ফলে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল।’ এ নির্ভরতা কি ফিরবে শিগগিরই?
আমরা জানি, নির্ভরতার আশ্বাস যদি না থাকে, সৌহার্দ্যের সম্ভাবনা যদি না থাকে, হামলা হবে। হামলা হলে মামলাও হবে। সাধারণ মানুষ দৌড়ের ওপরে থাকবে। আর আমরা লিখেই যাব, হামলার পরে মামলা: ক্ষতির চরিত্র বহুমাত্রিক।
এবারের শারদীয় উৎসবে ছন্দপতন ঘটেছে বিস্ময়কর রকমের। প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় এ উৎসবে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তবে এ বছর ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। এরপরও বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ক্ষতির চরিত্রটি বহুমাত্রিক। প্রশ্ন হলো, ক্ষতি কি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়েরই হয়েছে? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষতির মুখে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও আছে। তাদের ক্ষতির ধরন যদিও আলাদা।
হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়েছে। গবাদিপশু খোয়া গেছে। স্বর্ণালংকার লুট হয়েছে। লুট হয়েছে মন্দিরের দানবাক্স ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে থাকা নগদ অর্থ। এ ক্ষতি তাৎক্ষণিক। এটা একটা দিক। দীর্ঘ মেয়াদে পুরো ঘটনার অভিঘাতে হিন্দুদের যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে, সেটা আরেকটা দিক। যদিও সে কথা আড়ালে রয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দ্রুতই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে বিভিন্ন মহলের আন্তরিক সহযোগিতায়; কিন্তু মানসিকভাবে পুরো সম্প্রদায় কি দ্রুত আগের জায়গায় ফিরতে পারবে? পারস্পরিক নির্ভরতা, বিশ্বাস আর নিরাপত্তার ভাবনা কি আগের মতোই থাকবে?
এই সাধারণ প্রশ্নগুলো তোলার কারণ আছে। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার দিক থেকে এগিয়ে থেকেছে সব সময়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত বাবরি মসজিদের ঘটনাও ওই এলাকায় খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেখানে ঘটেনি। এর কারণ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সহিষ্ণুতা ও প্রতিবেশীসুলভ আচরণ। প্রতিবছর শারদীয় উৎসবে পুরো রংপুর-দিনাজপুর জেলায় অনুল্লেখযোগ্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে একই কারণে।
কিন্তু গত দশ বছরে দৃশ্যটা ধীরে ধীরে বদলে গেছে। ২০১৩-১৪ সালের আগুন-সন্ত্রাস রংপুরসহ পুরো উত্তরবঙ্গকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেবারও হামলা হয়েছিল রংপুর-দিনাজপুরের বেশ কিছু মন্দিরে এবং মন্দিরের একজন সেবায়েতও খুন হয়েছিলেন। নীলফামারীর জলঢাকা ও দিনাজপুরের রানিরবন্দরে, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুরের দুর্গম এলাকাগুলোয় বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দুরা। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের গত এক দশকের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক কারণে সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার জায়গাটি ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেছে। কোনো ঘটনা এক দিনে ঘটে না। তার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে হয়। উত্তরবঙ্গে এ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। ফলে এবার পীরগঞ্জের ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনা জানান দিয়েছে সতর্কতার।
এবার ফেরা যাক অন্যদিকে। বলেছিলাম, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতির চিত্র বহুমাত্রিক এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরাও। হামলার পর যে মামলা হবে, পুলিশ আসবে, দৌড়ের ওপরে থাকতে হবে, মামলাবাজ বাঙালি সে বিষয়টা বেমালুম ভুলে যায়। আইনি প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য পুলিশ বিপুলসংখ্যক জনগণের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া কোনো ঘটনার পর অনেক মানুষকে আসামি করে। বেশ কিছু ন্যক্কারজনক ঘটনা শুরু হয় সেই মামলার পর।
এবারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর মামলা ও তাতে আসামি হওয়া মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়। রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ সহিংসতাসংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় মামলা হয়েছে মোট ১১৬টি। সেসব মামলায় আসামি ২২ হাজার ২২০ জন। তাদের মধ্যে এজাহারে নাম দিয়ে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৫৫১ জনকে। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ৭০৯ জনকে (আজকের পত্রিকা, ২৬ অক্টোবর)। আরও যে কয়েক শ মানুষ গ্রেপ্তার হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই সব মামলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ আসামি। আইনি প্রক্রিয়ায় কী ঘটবে, সেটা পরের বিষয়। এখন যা ঘটছে, সেটা কম কিছু নয়। ইতিমধ্যে ‘পুরুষশূন্য পীরগঞ্জের রামনাথপুর, চারদিকে ভয়ের আবহ।’ (আজকের পত্রিকা অনলাইন, ২৫ অক্টোবর) পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের হঠাৎ উপস্থিতি আতঙ্কিত করে তুলছে পীরগঞ্জের সাধারণ মুসলমানদের। কুমিল্লা, নোয়াখালী বা সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয়ও একই ঘটনা যে ঘটছে না, তা নয়। এই যে শত শত মানুষ আসামি, তারা সবাই ভাঙচুর, লুটপাট বা হামলার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মামলার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তাদের অনেকের সঙ্গেই প্রকৃত ঘটনার হয়তো দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে তারা আসামি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিটি এলাকায় মুসলমানরা এই মামলার চিপায় আছে। এর ফলে কয়েক ধরনের ক্ষতির শিকার তারা। আর্থিক ক্ষতি এ ক্ষেত্রে প্রধান। পুলিশ যখন গণমামলা দেয়, তখন নীরবে একধরনের গ্রেপ্তার-বাণিজ্য চলতে থাকে। সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। আর্থিক বিষয়টির বড় অংশ বরাদ্দ রাখতে হয় গণমামলা থেকে নিজেদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য। তার পরিমাণ কী, সেটা নির্ধারিত নয়। গণমামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য যে অর্থের লেনদেন হয়, তার ভাগের জন্য স্থানীয় ক্ষমতাবলয়ের অনেকেই ওত পেতে থাকে। ফলে সে অনির্ধারিত অর্থের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌঁছায়। আর যদি সত্যিই ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তিটির সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। গণমামলা থেকে বাঁচতে জমিজিরেত বিক্রির ঘটনাও আমাদের জানা। কারণ, গ্রামের মানুষের কাছে শহরের মানুষের মতো নগদ অর্থ থাকে না। নগদ অর্থের জন্য তাদের ধান-চাল বিক্রি বা জমি বন্ধক রাখতে অথবা বিক্রি করতে হয়, যখন অর্থের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌঁছায়। অর্থনৈতিক এ ক্ষতির যে দুর্বিষহ অভিঘাত, সেটা সাধারণ মানুষকে টেনে যেতে হয় দীর্ঘদিন।
এরপর থাকে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা না পড়ার জন্য আত্মগোপনে থাকার বিড়ম্বনা। সে জন্যও বিরাট অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি যে হয়, তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া থাকে অনির্দিষ্ট দিন পরিবার-পরিজন ছেড়ে এক উদ্বিগ্ন সময় কাটানোর মাসিক চাপ। পরিবার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উভয় পক্ষকেই এ চাপ সামলাতে হয়।
সহিংসতার মতো কোনো ঘটনার গণমামলায় যখন কারও নাম আসে, তাদের অনেককেই সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। যারা নির্দোষ কিন্তু মামলায় নাম আছে, তাদের পক্ষে এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। ধর্মীয়ভাবে সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরও চলতে হয় সামাজিকতার মধ্য দিয়েই। বেশির ভাগ মানুষ ঘটে চলা নেতিবাচক বিষয়গুলোকে সহজভাবে নেয় না। ফলে যারা মামলায় পড়ে বা ঘটনা সংশ্লিষ্টতায় যাদের নাম আসে, তারা সামাজিকভাবে খুব যে ভালো থাকে, তা নয়। মুখের ওপর কেউ কিছু বলে না হয়তো। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে নির্দিষ্ট মানুষটিকে নিয়ে চর্চা চলতে থাকে। তার পরিবারের মানুষেরাও রেহাই পায় না সেই চর্চার হাত থেকে। সামাজিকভাবে বয়কটের ভয় হয়তো থাকে না, তবে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহসও খুব একটা থাকে না তাদের। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন কিছু মানুষকে চিনি, যাঁরা ২০১৩-১৪ সালের আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনায় এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরে শহরে চলে গেছেন ‘লজ্জা’ থেকে বাঁচতে। সেই ঘটনাগুলো ঘটেছিল মূলত গণমামলায় নাম আসার কারণে। স্থানীয় ক্ষমতাবলয়ের অর্থনৈতিক লোভে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে নিরীহ মানুষদের গণমামলায় নাম আসার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়গুলো ‘ওপেন সিক্রেট’। সবাই জানে, বোঝে কিন্তু কিছু বলে না।
না হয় বোঝা গেল, টাকাপয়সা খরচ করে মামলা থেকে উদ্ধার পেল অনেকেই। কিন্তু প্রতিবেশীদের যে আস্থা তারা হারাল, তাদের ওপরে থাকা যে বিশ্বাসটা চলে গেল, সেটা ফেরত পাবে কীভাবে? রামনাথপুর কৃষক লীগের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি মো. আনোয়ারুল মণ্ডল। আজকের পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে তিনি বলেছেন, ‘বছরের পর বছর হিন্দু-মুসলিম একত্রে বসবাস করে আসছি। তারা মাছ ধরে, মাছ ব্যবসা করে। আর সেই মাছ আমরাই কিনে থাকি। ফলে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল।’ এ নির্ভরতা কি ফিরবে শিগগিরই?
আমরা জানি, নির্ভরতার আশ্বাস যদি না থাকে, সৌহার্দ্যের সম্ভাবনা যদি না থাকে, হামলা হবে। হামলা হলে মামলাও হবে। সাধারণ মানুষ দৌড়ের ওপরে থাকবে। আর আমরা লিখেই যাব, হামলার পরে মামলা: ক্ষতির চরিত্র বহুমাত্রিক।
১৫ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দরকার। ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত খুব প্রয়োজন। সেই বন্দোবস্তের রূপরেখাটা কেমন হবে, সেটা নিয়ে বহু বছর ধরে কথা হচ্ছে।
১ দিন আগেযেকোনো সরকারের অজনপ্রিয় তথা জনবিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তার পরিণতিতে পতনের পেছনে আমলাতন্ত্রের বিরাট ভূমিকা থাকে। বিপরীতে সরকারের জনপ্রিয় হওয়ার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে তার প্রশাসনযন্ত্র। কেননা, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা এবং তার রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয় প্রশাসনের লোকজনের মাধ্যমেই
১ দিন আগেনভেম্বর মাসে ঢাকা শহরের অবস্থা কতটা অরক্ষিত ছিল, সেটা বোঝা যাবে ১১ নভেম্বর প্রকাশিত একটি সংবাদে। সংক্ষেপে সে খবরটি এ রকম: রোকেয়া হলে ডাকাতি গত মঙ্গলবার দিবাগত শেষ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে এক মারাত্মক ডাকাতি সংঘটিত হয়। দুষ্কৃতিকারীরা হলের প্রভোষ্ট ও হলে অবস্থানকারী ছাত্রীদের হাজার হাজার
১ দিন আগেপ্রতিকূলে চলা মানুষেরাই। আমাদের খাই খাই স্বভাবের সমাজে একজন ব্যতিক্রমী মানুষের উদাহরণ ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পাহাড়ভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ আলী। তিনি একাই ১ লাখ ১০ হাজার তালগাছ রোপণ করেছেন। এ জন্য তিনি নিজের জমি বিক্রি করতেও কার্পণ্য করেননি। আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নন খোরশেদ। অভাব-অনটন তাঁর সংসারে
১ দিন আগে