Ajker Patrika

স্নায়ু গবেষণায় স্ত্রী প্রাণী পরিহারের নীতি ফিরিয়ে আনছেন ট্রাম্প

অনলাইন ডেস্ক
গবেষণায় কোনো প্রাণীকে ব্যবহার করা হলে তখন তার লিঙ্গকে বিবেচনা করতে হবে। ছবি: নরপ্রিক্স
গবেষণায় কোনো প্রাণীকে ব্যবহার করা হলে তখন তার লিঙ্গকে বিবেচনা করতে হবে। ছবি: নরপ্রিক্স

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রে বৈচিত্র্য, ন্যায়সংগত সুযোগ এবং অন্তর্ভুক্তি (ডিইআইএ) প্রকল্প বাদ দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সঙ্গে সরকারিভাবে কেবল পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ট্রাম্পের এসব উদ্যোগ প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাতেও প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এ ধরনের পরিবর্তন চলতে থাকে, তা মস্তিষ্কের কার্যকলাপ এবং স্নায়ুজনিত রোগে সম্পর্কে জানতে বাধা সৃষ্টি করবে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।

কয়েক বছর ধরে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ) একটি নীতি অনুসরণ করে আসছে। এই নীতি অনুসারে, গবেষণায় কোনো প্রাণীকে ব্যবহার করা হলে তখন তার লিঙ্গকে বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ, গবেষণার জন্য অর্থায়ন পেতে হলে, গবেষকদের এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হবে যে তাঁরা কীভাবে তাঁদের গবেষণার নকশায় লিঙ্গের পার্থক্য বিবেচনা করছেন, যাতে পুরুষ ও নারী মধ্যে যেকোনো পার্থক্য স্পষ্টভাবে উঠে আসে।

তবে সম্প্রতি নিউরোসায়েন্স সম্পর্কিত নিউজ মিডিয়া ‘দ্য ট্রান্সমিটার’ জানিয়েছে, এনআইএইচ সম্ভবত এই নীতিটি স্থগিত করেছে। যদিও এনআইএইচ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি দেয়নি। তবে এই পদক্ষেপটি ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাহী আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হতে পারে, যেখানে ‘লিঙ্গ মতাদর্শ’ এবং ডিইআইএ কর্মসূচি বাতিলের কথা বলা হয়েছিল।

যদি সত্যিই এই নীতি স্থগিত হয়ে যায়। তবে গবেষণায় পুরুষ ও নারী প্রাণী উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা কমে যেতে পারে। আর এর ফলস্বরূপ, এটি স্নায়ুবিজ্ঞান সম্পর্কিত মৌলিক গবেষণার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

প্রাণীর ওপর গবেষণার মাধ্যমে সম্প্রতি পুরুষ ও নারী মস্তিষ্কের মৌলিক পার্থক্যগুলো সামনে এসেছে। এই পার্থক্যগুলো হরমোনগুলোর প্রভাব, স্মৃতির সৃষ্টি এবং স্নায়ু কোষের কাজের প্রক্রিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। এসব পার্থক্য শুধু গবেষণাগারের প্রাণী নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। শুধু একটি লিঙ্গের প্রাণী ব্যবহার করলে, মানব মস্তিষ্কের মৌলিক কাঠামো ও ওষুধের প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অজানা থেকে যেতে পারে।

নারী ও পুরুষ মস্তিষ্ক কি আলাদাভাবে কাজ করে?—এই প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের মাঝে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলেও উত্তর খোঁজার কাজটি খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে। পুরুষ ও নারী প্রাণীদের পার্থক্য খুঁজে বের করতে হলে উভয় লিঙ্গের প্রাণীই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। অথচ অতীতে বিজ্ঞানীরা এই পার্থক্য উপেক্ষা করে শুধু পুরুষ প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করতেন। ২০০৯ সালের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গবেষণায় পুরুষ প্রাণীর ব্যবহার নারী প্রাণীর চেয়ে ৫ দশমিক ৫ গুণ বেশি হয়েছে।

প্রাণী গবেষণার মাধ্যমে এমন কিছু পরীক্ষা করা সম্ভব হয়, যা মানুষের সঙ্গে করা সম্ভব নয়। গবেষকেরা জীবিত মানুষের মাথা কেটে, তাদের স্নায়ু কোষ বের করে বা ইলেকট্রোড প্রতিস্থাপন করতে পারেন না।

এ ছাড়া পুরুষ ও নারী আলাদা পরিবেশে বড় হন এবং তাদের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা আলাদা। মানব মস্তিষ্কের গঠনে বায়োলজিক্যাল (যেমন হরমোন এবং ক্রোমোজোম) এবং সাংস্কৃতিক (যেমন পরিবার এবং সমাজের প্রভাব) উভয়েরই ভূমিকা থাকে।

গবেষকদের মধ্যে একটি ধারণা ছিল, নারীদের প্রজনন চক্র ‘ডেটা বা তথ্য বিকৃত’ করতে পারে এবং তাই গবেষণার জন্য পুরুষ প্রাণী ব্যবহার করা উচিত। যদিও এই ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও দীর্ঘ সময় ধরে গবেষকেরা পুরুষ প্রাণী ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই মনোভাব বদলাতে শুরু করেছে।

গবেষণায় নারী প্রাণী অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এমন কিছু আবিষ্কার হয়েছে, যা মস্তিষ্কের কাজ করার প্রথাগত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছে। নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েইনবার্গ কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের নিউরোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথরিন উলি গবেষণায় ইঁদুর ব্যবহার করেন। তাঁর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো—কীভাবে ইস্ট্রোজেন (লিঙ্গ হরমোন) মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ‘সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি’কে প্রভাবিত করে।

সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি হলো মস্তিষ্কের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা, যার মাধ্যমে স্নায়ু কোষের মধ্যে সংযোগগুলো সময়ের সঙ্গে শক্তিশালী বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্কের শিক্ষণ এবং স্মৃতি তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কাথরিন উলি দেখিয়েছেন যে সিন্যাপটিক প্লাস্টিসিটি নারী এবং পুরুষদের মস্তিষ্কে আলাদাভাবে কাজ করে।

মস্তিষ্কে স্নায়ু কোষের মধ্যে সংযোগ শক্তিশালী হওয়ার প্রক্রিয়াটি ‘লং-টার্ম পটেনসিয়েশন’ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়াটি দুটি পর্যায়ে ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়, যা কিছু ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং পরে একটি দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়, যা অনেক সময় ধরে চলে। এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম থাকে, যার নাম প্রোটিন ‘কিনেজ এ’ (পিকেএ)। আগে ধারণা করা হয়েছিল যে এই এনজাইমটি শুধু পরবর্তী পর্যায়ের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।

তবে, কাথরিন উলির গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে নারীদের ক্ষেত্রে এনজাইমটি শুধু পরে নয়, প্রথম পর্যায়েরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অর্থাৎ, নারীদের মস্তিষ্কে স্নায়ু কোষের সংযোগ শক্তিশালী করার এই প্রক্রিয়াটি পুরুষদের থেকে ভিন্নভাবে কাজ করে।

আরেকটি গবেষণায়, কাথরিন উলি এবং তার দল ‘হিপোক্যাম্পাস’ অঞ্চলে লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন, যা শেখা এবং স্মৃতি গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কের অঞ্চল। তারা দেখিয়েছেন, শুধু নারী ইঁদুরের একটি নির্দিষ্ট ধরনের ‘ইস্ট্রোজেন’ নিউরনগুলোকে সংকেত প্রেরণের জন্য আরও প্রস্তুত করে।

এই বিশেষ ধরনের ইস্ট্রোজেন উভয় পুরুষ এবং নারী ইঁদুরের মস্তিষ্কে তৈরি হয়। তবে এটি নারীর প্রজনন ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া ইস্ট্রোজেনের মতো একটি চক্র অনুসরণ করে না।

গবেষক বলেন, ‘এই গবেষণায়, আমরা একটি পরীক্ষা করছিলাম যা আগে করা হয়েছিল এবং আমাদের ফলাফল ছিল ভিন্ন। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে ফলাফলগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রকাশিত গবেষণাগুলোর থেকে আলাদা ছিল কারণ আমরা নারী প্রাণী ব্যবহার করছিলাম। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে শুধু পুরুষ প্রাণী ব্যবহার করা হয়েছিল।’

কাথরিন উলি বলেছেন, ‘অনেক ওষুধ স্নায়ু কোষের মধ্যে সংযোগস্থলে কাজ করে, তাই এই সংযোগগুলো কীভাবে গঠিত এবং রক্ষা করা হয় তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, প্রাণীভিত্তিক গবেষণার ফলাফলগুলো ভবিষ্যতে মানুষের চিকিৎসা এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

ইঁদুর এবং মানুষের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। যেমন—মানুষের পিরিয়ড সাইকেল ইঁদুরের তুলনায় প্রায় সাত গুণ দীর্ঘ হয়।

তবে অনেক গবেষণা রয়েছে দেখা যায়, ইস্ট্রোজেন কীভাবে ইঁদুরের মস্তিষ্ক এবং মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাইমেটের (স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি শ্রেণি) মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলছে এবং এই প্রভাবগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য খুঁজে বের করেছে।

উলি মনে করছেন, ইঁদুরের মস্তিষ্কে যে পরিবর্তন বা প্রক্রিয়া ঘটছে, তা মানব মস্তিষ্কেও কিছুটা বা একটি ভিন্নভাবে ঘটতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, এই পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, ইঁদুরের মস্তিষ্কের ওপর করা গবেষণার ফলাফলগুলো মানুষের মস্তিষ্কের গবেষণায় কিছুটা সহায়ক হতে পারে।

বিজ্ঞানী উলি ছাড়াও অন্য বিজ্ঞানীরাও পুরুষ এবং নারী ইঁদুরদের মধ্যে ভয়জনিত স্মৃতি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। পুরুষ ইঁদুরদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালার সংকেত পাঠানো বন্ধ করলে ভয়জনিত স্মৃতি মস্তিষ্কে জমা হওয়ার প্রক্রিয়া থেমে যায়, তবে নারী ইঁদুরে তা একইভাবে কাজ করে না।

গবেষণার এই ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, পুরুষ ও নারী ভয়জনিত স্মৃতি ভিন্নভাবে সংরক্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ওষুধ ব্যবহার করা হয় যা অ্যামিগডালার সংকেতগুলো ব্লক করে, তাহলে তা পুরুষদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর না-ও হতে পারে।

আরেকটি গবেষণায় মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস অ্যাকম্বেন্স নামক অংশে পার্থক্য পাওয়া গেছে। এটি মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থার মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে দেখা গেছে, নারী ইঁদুর তুলনায় পুরুষ ইঁদুরের নিউক্লিয়াস অ্যাকম্বেন্সে বেশি উত্তেজক বা ‘অ্যাকটিভেটিং’ সংকেত ঘটে।

গবেষকেরা আরও উল্লেখ করেছেন, পুরুষদের মধ্যে এই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু পদ্ধতি কার্যকর হলেও, সেই একই পদ্ধতিগুলো নারী ইঁদুরে কাজ করে না। এই ফলাফলগুলো (হতাশা ও আসক্তি) বুঝতে সাহায্য করতে পারে। কারণ, পুরস্কার ব্যবস্থায় সংকেতের এই কার্যকলাপ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, নারী-পুরুষের মধ্যে এই লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য ভালোভাবে বোঝা গেলে, তা মনস্তাত্ত্বিক এবং স্নায়বিক চিকিৎসা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে, যা প্রতিটি লিঙ্গের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত হবে। তবে, এই গবেষণার ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত। কারণ, বর্তমানে আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে পরিবর্তনগুলো ঘটছে, তা এই গবেষণার অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল দিল্লি

‘ক্রিকেটাররা আমাকে ন্যুড পাঠাত’, বিস্ফোরক ভারতের সাবেক কোচের সন্তান

নালিতাবাড়ীতে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে যুবক আটক

‘শেখ হাসিনা আসবে, বাংলাদেশ হাসবে’ ব্যানারে বিমানবন্দর এলাকায় আ.লীগের মিছিল

পারদর্শী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ, স্থিতিশীল হচ্ছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক: ভারতীয় বিশেষজ্ঞ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত