Ajker Patrika

১০ কোটি রং দেখতে পান যিনি তাঁর চোখে পৃথিবী কেমন?

আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬: ০২
১০ কোটি রং দেখতে পান যিনি তাঁর চোখে পৃথিবী কেমন?

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ চোখ দিয়ে ১০ লাখ রং আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে। মৌলিক রং যেখানে মাত্র পাঁচটি, সেখানে এতগুলো বর্ণালির পর আর হয়তো কোনো রং থাকার কথা না। অনেকে এমনটিই বিশ্বাস করেন। কিন্তু চিত্রকর কনসেটা অ্যান্টিকোর মতো মানুষদের কথা আলাদা। তিনি প্রায় ১০ কোটি রং দেখতে পারেন। সম্ভবত তাঁর মতো অতটা রঙিন পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য কারও হয় না! 

এই যে এতগুলো রং দেখতে পারা সেটি স্পষ্টত বোঝা যায় কনসেটার শিল্পকর্মে। তাঁর পেইন্টিংগুলোতে রঙের প্রাণবন্ত বিন্যাস দেখলে যেকোনো শিল্পরসিকই স্বীকার করবেন, কনসেটার নিজস্ব শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন—ইউক্যালিপটাসগাছের কাণ্ডে বেগুনি এবং ফ্যাকাশে নীল-লোহিত রং; কাকাতুয়ার হলুদ ঝুঁটিতে সবুজ এবং নীল রঙের আভা; বাগানের ল্যান্ডস্কেপে রঙের অতি ব্যবহার সাইকেডেলিক অনুভূতি দেয়। 

এই অনন্য অঙ্কনকৌশলের ব্যাপারে কনসেটা বলেন, ‘এটি শুধু বর্ণের ঠাট বা স্বতন্ত্র শিল্পবৈশিষ্ট্য নয়—আমি আসলে যা দেখি ঠিক তা-ই আঁকছি। যদি এটি একটি গোলাপি ফুল হয় এবং তারপরে হঠাৎ আপনি কিছুটা লিলাক (নীল-লোহিত) বা নীল দেখতে পান, আমি আসলে তেমনটিই দেখছি।’ 

শৈশবে রঙিন প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হতে কনসেটা। প্রায়ই হারিয়ে যেতেন প্রকৃতির মাঝেবিজ্ঞানীরা করসেটার এই বিশেষ দৃষ্টিশক্তিকে বলছেন টেট্রাক্রোম্যাট। এর অর্থ চোখের রেটিনায় একটি চতুর্থ কালার রিসেপ্টর রয়েছে। সাধারণত মানুষের চোখে তিনটি রিসেপ্টর থাকে। এগুলোকে বলে কোন কোষ। এই কোষগুলো প্রায় ১০ লাখ ভিন্ন ভিন্ন রঙের পার্থক্য করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু টেট্রাক্রোম্যাট আনুমানিক ১০ কোটি রং দেখতে পায়। 

করসেটা বলেন, ১০ বছর আগেও আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝিনি। আমি বুঝতাম না যে, অন্য মানুষের মতো করে বিশ্বকে আমি অনুভব করছি না। আমার জন্য পৃথিবীটা সত্যিই খুব বেশি রঙিন।’ 

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা করসেটার। তিনি ছোটবেলা থেকেই অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। সব সময় ব্যতিক্রম থাকতে চাইতেন। চুলে উজ্জ্বল রং করতেন, শোয়ারঘরের জন্য পান্নার মতো সবুজ কার্পেট এবং কালো ও লাইম-গ্রিন পর্দা ছিল প্রিয়। প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধ, তিনি প্রায়ই কাছাকাছি একটি গলফ কোর্সে সারা দিনের জন্য হারিয়ে যেতেন। 

করসেটা বলেন, ‘সব সময় আমার মনে হতো যেন আমি এক জাদুর জগতে বাস করছি। আমি জানি, শিশুরা এমন বলে, কিন্তু আমার কাছে সবকিছুই ছিল অতি অসাধারণ, অত্যন্ত আলাদা। আমি সর্বদা প্রকৃতির মধ্যে ঔৎসুক্য নিয়ে ঘুরতাম, জটিলতাগুলো দেখার বোঝার চেষ্টা করতাম। কারণ, আমি সবকিছুতেই অন্যদের চেয়ে অনেক বিশদ কিছু দেখতে চাইতাম। অন্যরা হয়তো ফুলের পাতা বা পাপড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু এই তাকানোটা আমার জন্য সব সময় সত্যিই একটা বোঝা, ক্লান্তিকর। কখনো কখনো একটা সাধারণ জিনিস দেখার জন্যও আমি দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে বাধ্য হই। দেখার এই অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা আমি তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে চাইতাম।’ 

ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর করসেটা অ্যান্টিকো যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে সান দিয়েগোতে একজন শিল্পী এবং শিল্পের শিক্ষক হয়ে ওঠেন। রঙিন প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর অনন্য শৈলী ক্যানভাসে তাঁর হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। 

করসেটার চোখের বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ধরা পড়ে ২০১২ সালে। তাঁরই এক নিউরোলজিস্ট ছাত্র তাঁকে টেট্রাক্রোম্যাসি সম্পর্কে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র ই-মেইল করেন। ওই ছাত্রের অনুমান ছিল করসেটার এমন একটা ব্যাপার থাকতে পারে। এর কয়েক মাস আগে, করসেটা আবিষ্কার করেন তাঁর মেয়েটা বর্ণান্ধ। করসেটা মেয়েকে বুঝিয়েছিলেন, এটা কোনো সমস্যা নয়। বরং সে কেবল অন্যদের থেকে আলাদা, স্পেশাল এবং বিস্ময়কর। মেয়েকে বলেন, ‘আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কীভাবে রং দেখতে হয়।’ গবেষণা নিবন্ধটি পড়ার পরই কেবল করসেটা বুঝতে পারেন, টেট্রাক্রোম্যাসি বৈশিষ্ট্যযুক্ত নারীও বর্ণান্ধ সন্তান জন্ম দিতে পারেন। 

২০১২ সালের আগে পর্যন্ত কনসেটা জানতেন না তিনি আসলে টেট্রাক্রোম্যাট।পরে করসেটা ওই নিবন্ধের লেখক গবেষককে একটি ই-মেইল করেন। ই-মেইলে তিনি লেখেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি আমার লালা ওয়াশিংটনে পাঠাচ্ছি।’ পরে সেখানে পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয়, করসেটার টেট্রাক্রোম্যাসির জন্য দায়ী জেনেটিক মিউটেশন। 

ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ডা. কিম্বার্লি জেমসন করসেটার ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ১৫ শতাংশ নারীর এ ধরনের জিন থাকে। কিন্তু রেটিনায় টেট্রাক্রোম্যাট থাকার জন্য এটিই যথেষ্ট নয়, তবে একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। কনসেটার ক্ষেত্রে… একটি জিনিস আমরা বিশ্বাস করি যে, সাত বছর বয়স থেকে তিনি ক্রমাগত ছবি আঁকছেন, তাই তিনি সত্যিই এই বাড়তি সম্ভাবনা/সক্ষমতাকে বুঝেছেন এবং সেটির ব্যবহার করেছেন। জেনেটিক্স এভাবে কাজ করে: এটি আপনার মধ্যে সম্ভাবনা সুপ্ত রাখে এবং পরিবেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আপনার মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে, বাস্তব রূপ পায়। 

কনসেটার একটি চিত্রকর্মনিজের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর পারিবারিক জিন পরীক্ষাও করেন করসেটা। তাতে জানতে পারেন, তাঁর মা যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। মা-ও সম্ভবত টেট্রাক্রোম্যাট ছিলেন। নিজের বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ছোটকালেই আবিষ্কার করতে পারার ফলে শৈশবে মায়ের অভাব কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পেরেছিলেন করসেটা। তাঁর শৈশবের বাড়িটি দেখলে সেটি কিছুটা অনুমান করা যায়। যেমন, ষাটের দশকে সুইমিং পুলে লাল এবং নীল আলোর যোগে বেগুনি রং তৈরি করেছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্রও ‘উদ্ভট’ এবং শৈশবের বাড়িটি অস্বাভাবিক রঙিন। 

এই সুপার ভিশন কনসেটা অ্যান্টিকোর জন্য অনেক আনন্দের। অনেকে হয়তো সন্দেহ করেন তিনি সাইকেডেলিক ড্রাগ নেন। কিন্তু কনসেটা বলেন, ‘আমি কঠোরভাবে মাদকবিরোধী। আমি নিশ্চিত যে লোকেরা শুধু মনে করে যে আমি সব সময় একটু ড্রাগজনিত ঘোরের মধ্যে থাকি। আমি সত্যিই জীবন এবং চারপাশের সৌন্দর্যের প্রতি ঘোরগ্রস্ত থাকি। আমি প্রায়ই মনে মনে ভাবি, এই পৃথিবীতে আপনি কীভাবে অসুখী হতে পারেন—শুধু একটা পার্কে গিয়ে বসুন। শুধু একটি ঝোপ বা একটি গাছ দেখতে যান, এটা কত বড় ব্যাপার আপনি বুঝতে পারবেন না!’ 

কনসেটার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর শিক্ষার্থীরাও বেশ উপকৃত হচ্ছেন। কারণ, তিনি যখন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দেন সেগুলো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্টের শিক্ষার্থীর মতো হয় না। সেখানে এমন কিছু থিমের সঙ্গে এমন সব রঙের ব্যবহার থাকে যা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এতে শিক্ষার্থীদের চিত্রকর্মগুলো আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। কনসেটা বলেন, ‘আমি আমার চোখে দেখা পাখি, প্রাণী, গাছ এঁকে রেখে যেতে চাই। আমি প্রকৃতিতে যা দেখছি তা বিশদভাবে বলতে চাই, দেখাতে চাই। কারণ এটি এমন একটি জানালা, যেটি দিয়ে এমন কিছু দেখা যায়, যা অন্য লোকেরা সত্যিই দেখতে পায় না।’ 

কনসেটার শোবার ঘরেও রঙের ছড়াছড়িএত রং দেখতে পারার ক্ষমতার কারণে প্রকৃতি কনসেটার জন্য একটি ইতিবাচক উদ্দীপক। তবে মানবসৃষ্ট কিছু পরিবেশ, যেমন ফ্লুরোসেন্ট আলোসহ একটি বড় শপিং সেন্টার বা এ রকম উজ্জ্বল রঙিন কিছু আলো তাঁর জন্য অস্বস্তিকর। কনসেটা বলেন, ‘আমি এ ধরনের ভবনগুলো এড়িয়ে চলি। কৃত্রিম রঙিন জিনিসগুলো আমার চোখে কুৎসিত!’ 

কনসেটা অ্যান্টিকোর এই বিশেষ ক্ষমতা আমাদেরও একটি অস্বস্তিকর বাস্তবার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বকে যেভাবে যে অবস্থায় দেখে সেটি আসলে অসম্পূর্ণ। তাহলে নিজের চোখে দেখার তৃপ্তি আসলে অজ্ঞতার মায়া! কত মানুষ একজীবনে তার পরিপার্শ্বের বহু ব্যবহারের বস্তুটিও আসলে অসম্পূর্ণ দেখে এক দিন মরে যাচ্ছে! 

বিজ্ঞান সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মডেল মেঘনাকে আটকের দিনই ঢাকা ছাড়েন সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা

সৌদি রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের ভিত্তিতেই মডেল মেঘনা কারাগারে

মডেল মেঘনার পরিবারের মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা করেছিল পুলিশ

বান্দরবান, মণিপুর, মিজোরাম ও রাখাইন নিয়ে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র চলছে: বজলুর রশীদ

ইসলামপুর বিএনপির সহসভাপতি যোগ দিলেন জামায়াতে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত