Ajker Patrika

গত দুই নির্বাচনে সক্রিয় ছিল ৫০টির বেশি নামসর্বস্ব ইসলামি দল

সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা
গত দুই নির্বাচনে সক্রিয় ছিল ৫০টির বেশি নামসর্বস্ব ইসলামি দল

বিপুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের অভাব নেই। তবে সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনসমর্থন এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও প্রভাবের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো ধর্মীয় দলের সংখ্যা নগণ্য। দেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামি দলের সংখ্যা ১১। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক দলগুলোর তৎপরতা নির্বাচনের মৌসুমেই সীমাবদ্ধ। গত দুটি সাধারণ নির্বাচনের সময় সামনে আসা এসব দলের বেশ কয়েকটির নেতা ও কার্যালয়ের খোঁজ করতে গিয়ে এ প্রতিবেদককে সম্প্রতি নিরাশ হতে হয়েছে।

২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় ৫০টির বেশি ইসলামপন্থী দল বিভিন্নভাবে সক্রিয় হয়েছিল। পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, এদের অধিকাংশই আর্থিকসহ নানান সুবিধার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যত একতরফা ভোটকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

গত দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৎপর হওয়া ইসলামপন্থী দলগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এদের অধিকাংশেরই কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেই। নেই উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি। অনেকের কেন্দ্রীয় কমিটিও নেই। সাধারণত কিছু একক নেতার ওপর নির্ভরশীল দলগুলো। বছরের অন্য সময়ে কার্যক্রম না থাকলেও ভোটের আগে সুবিধা পেতে তৎপর হয়েছে।

২০১৮ সালে মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫টি দল নিয়ে গঠিত হয় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ)। জোটটি আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট হয়ে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় ছিল। 
মিছবাহুর রহমানের নিজের বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট ছয়টি দল নিয়ে সরকারপন্থী ইসলামি জোট ‘লিবারেল ইসলামিক জোট’ এ যুক্ত হয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ এনে লিবারেল ইসলামিক জোট গত ৭ আগস্ট মিছবাহুরকে বহিষ্কার করে।

২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়ালের নেতৃত্বে ‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট’ নামে ১৫ দলীয় আরেকটি জোট গঠিত হয়। প্রগতিশীল ইসলামী জোটের শরিক বাংলাদেশ ইসলামী ডেমোক্রেটিক ফোরাম ২০১৮ সালে গঠিত মোর্চা আইডিএরও সদস্য ছিল। দলটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাওলানা হারিছুল হক বর্তমানে নেজামে ইসলাম বাংলাদেশের (একাংশ) চেয়ারম্যান। নেজামে ইসলামও প্রগতিশীল ইসলামী জোটে রয়েছে। দলটির বর্তমান মহাসচিব মাওলানা জোবায়ের হোসাইন নেজামী আজকের পত্রিকাকে বলেন, পুরানা পল্টনে নোয়াখালী টাওয়ারের পাশেই তাঁদের প্রধান কার্যালয়। দলটির ৫৪ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে বলেও জানান তিনি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে জোবায়ের হোসাইন নেজামী বলেন, ‘আমরা ২০২৪ এ নির্বাচন বর্জন করেছি। এখন অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট করার চিন্তাভাবনা আছে।’

প্রগতিশীল ইসলামী জোট ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের আরেক শরিক ইসলামী ইউনিয়ন বাংলাদেশের অস্তিত্বই নেই এখন। দলটির চেয়ারম্যান মুফতি সৈয়দ মাহাদী হাসান বুলবুল বর্তমানে বাংলাদেশ তরীকত ফ্রন্টের চেয়ারম্যান। ইসলামী ইউনিয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহাদী হাসান বুলবুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইসলামী ইউনিয়ন বাংলাদেশ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন ছিল। এই ব্যানারে সংগঠনটির সদস্যরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে না চাওয়ায় বাংলাদেশ তরীকত ফ্রন্ট দলটি গঠন করা হয়েছে।’ নিজের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রসঙ্গে বুলবুল বলেন, ‘কেন্দ্রীয় অফিস বলতে...আগে কলাবাগান থেকে কার্যক্রম পরিচালিত হতো, এখন আশুলিয়া থেকে হচ্ছে। দলের ১০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ২৫টি জেলা কমিটি আছে।’

 এদের কার্যক্রম খুব একটা নেই। মাঠে-ময়দানে তেমন কিছু হচ্ছে না। অফিসে বসেই আলাপ-আলোচনা চলে। মুফতি সৈয়দ মাহাদী হাসান বুলবুল,বাংলাদেশ তরীকত ফ্রন্টের চেয়ারম্যান

জোটের অন্যান্য দল সম্পর্কে বুলবুল বলেন, ‘এদের কার্যক্রম খুব একটা নেই। মাঠে-ময়দানে তেমন কিছু হচ্ছে না। অফিসে বসেই আলাপ-আলোচনা চলে।’

আইডিএ জোটের শরিক বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান আবু তাহের চৌধুরী ও মহাসচিব মো. আবুল কাশেম। কয়েক দিন আগেও ফেসবুকে দলটির পেজে ফলোয়ারের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭। ইসলামিক পার্টির সদস্যসংখ্যা জানতে চাইলে মহাসচিব মো. আবুল কাশেম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সদস্যসংখ্যা কত, তা এখন বলতে পারব না।’ দলের ১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে বলে জানিয়েছেন কাশেম।

এই জোটের শরিক হাসরত খান ভাসানীর বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ভাসানী, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জমিয়তে দারুসসুন্নাহ, বাংলাদেশ গণ কাফেলা, বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলন, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী পেশাজীবী পরিষদ, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন ও ন্যাশনাল লেবার পার্টির সাম্প্রতিক তৎপরতার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ৫৮ দলের সম্মিলিত জাতীয় জোট (ইউএনএ) গঠিত হয়েছিল। এর মধ্যেও ছিল ৩৫টি ইসলামপন্থী দল। তার ৩৪টি ধর্মীয় দল ছিল ইসলামী মহাজোটের অধীনে। আসন নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় নির্বাচনের আগেই অবশ্য নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জোটটি। গত সংসদ নির্বাচনের আগে আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই জোটের নেতাদের তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ডাকে সম্মিলিত জাতীয় জোটে যুক্ত হওয়া ইসলামী মহাজোটে ছিল জমিয়তুল ওলামা পার্টি, গণ ইসলামিক পার্টি, পিপলস জাস্টিস পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফেডারেশন, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী জনকল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামিক লীগ, জমিয়তে মুসলিমিন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী গণ আন্দোলন, জাতীয় ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় ইসলামিক মুভমেন্ট, বাংলাদেশ ইত্তেহাদুল মুসলিমিনসহ প্রায় তিন ডজন দল। সম্প্রতি অনুসন্ধান করে এ জোটের অনেক দলেরই নেতা বা কার্যালয়ের সুলুকসন্ধান করা যায়নি।

ইসলামী মহাজোটের নেতাদের সঙ্গে জাপা (রওশন) মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদের যোগাযোগ ছিল। এসব দল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাজী মামুনুর রশীদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা তাদের কোনো আসনের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। তাই তারা আমাদের সঙ্গে নির্বাচনে ছিল না। আমরাই তাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারিনি। কয়েকটি দল ছাড়া অন্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক লেনদেন বা যোগাযোগ নেই। মাঝেমধ্যে এদের সঙ্গে হাই-হ্যালো হয় কেবল।’

এসব দল প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মাওলানা শেখ ফজলুল করীম মারুফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই দলগুলো একেবারেই কিংস পার্টি। তাই আমরা কখনোই এদের সঙ্গে সংযোগ রাখিনি।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম তাঁর নিজ গবেষণার বরাত দিয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুধু রাজধানীতেই ধর্মীয় দল মিলিয়ে প্রায় ১৬২টি রাজনৈতিক সংগঠনের খোঁজ পাওয়া যায়। এগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কিছু রাজনৈতিক দল সুবিধা নেওয়ার জন্য এমন দলগুলোকে সঙ্গে রাখে। এদের সবার মধ্যে ইসলামের প্রকৃত চর্চা নেই, বরং সুবিধাবাদিতা আছে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনেও এ ধরনের রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনে অংশ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অনেককে টাকা দেওয়া হয়েছিল, যাতে অংশগ্রহণমূলক ভোট হচ্ছে বলে বিদেশিদের দেখানো যায়।’

কার্যত নিষ্ক্রিয় এসব দল সম্পর্কে অভিমত চাইলে নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব দলের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। শুধু নিবন্ধিত ১১টি ধর্মীয় দলের তথ্য আছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কিছু বলতে পারব না।’

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত