সৌভিক রেজা
বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’ আর এসবের পাশাপাশি ‘প্রতিভা’র দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিভার একটা কাজ হলো তাঁর জনগোষ্ঠীর অচেতন এবং অবচেতন মনস্ক্রিয়ায় যেসব আবেগ ও আইডিয়া তোলপাড় করে, সেগুলোকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুরোনো এই কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করতে হলো। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর মতো মানুষও সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। নিজের বক্তব্যকে বিস্তারে নিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি...একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে: যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে-বস্তুটি কী?’ বুদ্ধদেব যে সরাসরি উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, তা নয়। বোধকরি, এসব প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমাদের কারওরই জানা নেই। অগত্যা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে হয়েছিল, ‘তা [প্রতিভা] কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রম্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগের ক্ষেত্র এক ও অনন্য?’ তিনিও এই সব প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে না-পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এটি ভাবা অনুচিত হবে যে, সেটি ছিল বুদ্ধদেবের অক্ষমতা। কেননা বুদ্ধদেবের ওই গুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি আভাস আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়ে যায়।
২.
নিজের বিষয়ে কী অকপটেই-না সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পিতৃদেব (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি...অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম।’ শুধু তা-ই নয়, কবিতা রচনায় সোজাসুজি প্রেরণার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে, প্রেরণার মধ্যে অলৌকিকের আভাস রয়েছে। ফলে, প্রেরণার পরিবর্তে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল অভিজ্ঞতা। তিনি মনে করতেন যে কাব্যের সৃষ্টির উৎসে উক্তি ও উপলব্ধি একদম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রতিভা থাকলেই কবিতা রচনা সম্ভব নয়, কেননা কাব্য হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার।’ সেই পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের শৈল্পিক নমুনা আমরা সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেই নানাভাবে দেখতে পাই―
‘অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে
জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,
নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।
অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চলে
গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি, শান্তি, শান্তি চারিধারে!
কেবল অন্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।’ (অর্কেস্ট্রা)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যরচনার নেপথ্যের শক্তি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু এই কবির ‘জাগ্রত আত্মচেতনা’র কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে ‘বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এতে করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, ব্যক্তিগতভাবে সুধীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছ থেকে সাড়া পেলেন কম। পাঠককে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য অবশ্য তাঁর ছিল, যে-কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘জনসাধারণের রুচির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দা-প্রশংসায় আমি উদাসীন।’ এই মনোভাবের জন্য সুধীন্দ্রনাথকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে।
৩.
কবির দিক থেকে পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য ও তাঁর আত্মচেতনাকে স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখেছি, সেটাকে অনাদর করা যায় না।’ আর এরপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমার রচনাকে থিওরি দ্বারা পীড়ন না করে...সাংঘাতিক ঘনসন্নদ্ধ অলংকারের দ্বারা তার অঙ্গকে আচ্ছন্ন না করে তার দেহকে সহজ সজীবতার লাবণ্যে যদি প্রকাশ করো, তাহলে তোমার এই লেখাগুলি রসিক সমাজের উপাদেয় ভোজের আয়োজনে লাগবে।’
সুধীন্দ্রনাথকে এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবির দিকে না তাকিয়ে যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করবার চেষ্টা কোরো।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সেই উপদেশকে মান্যতা দেবার গরজ সুধীন্দ্রনাথ সেদিন দেখাননি। এখানেও হয়তো, তাঁর সেই জাগ্রত আত্মচেতনা, তাঁকে অন্যের উপদেশে পথ চলতে নিষেধ করেছিল।
৪.
সাহিত্যে প্রেরণার বদলে সুধীন্দ্রনাথ যেমন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ঠিক অনেকটা সেরকমই তিনি রবীন্দ্রনাথের বদলে টিএস এলিয়টের সাহিত্য-ভাবনাকেই খানিকটা শিরোধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের নিজের বয়ানে দেখতে পাই, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের সার্থকতা।’
আর এলিয়টের প্রণোদনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা যদিও অনন্ত, তবু বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবিতার মৌলিকতা বা সাফল্য বিজড়িত নয়।’ এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলা ‘কাব্যের মুখ্য সম্বল আবেগ; এবং আমাদের আবেগ সংখ্যা যেহেতু অত্যল্প, তাই প্রসঙ্গের দিক থেকে কবিতাবিশেষকে যত অপূর্বই দেখাক না কেন, ফলাফলের বিচারে তার মধ্যে একটা আনুপূর্বিকতা ধরা পড়বেই।’
সে-কারণেই তিনি ওই পথে চরতে চাননি। বরং তিন আজীবন এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, ‘ভাব ও ভাষার অবিচ্ছেদ্য সমীকরণই...কবির একমাত্র কর্তব্য।’ সেই আত্ম-উপলব্ধির জায়গা থেকেই তিনি লিখেছিলেন―
‘নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞানি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।’ (কস্মৈ দেবায়)
৫.
যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’, সেই জীবনানন্দ দাশও মনে করতেন যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিশ। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশি-বিদেশি খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’
আর সেই সঙ্গে এটিও জীবনানন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ।’ রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সুধীন্দ্রনাথের বইখানিতে (‘স্বগত’) জমেছে তাঁর মনন-সাধনার ফসল।’ সেই মনন-সাধনার ফসল যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনই তাঁর প্রবন্ধে স্বকীয়তায় স্থান করে নিতে পেরেছিল।
সম্ভবত সে-জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘সুধীন্দ্র দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন—মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ— সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’
তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ জানতেন, বুঝতেও তো পারতেন। দুজনের সাহিত্যদৃষ্টির যে পার্থক্য, সেটাকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
নিজের ভবিষ্যৎ যেন এই কবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যিক জীবনের অন্তিমপর্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই যে-কারও মনে হবে, এই সেই কবি, যিনি অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন!
৬.
কবির কর্তব্য, তাঁর উদ্দেশ্য ও ব্রত সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদ্ভাবন।’
জীবনের শেষ দশটি বছরে এক ‘দশমী’ ছাড়া তাঁর আর কোনো নতুন কবিতার বই বের হয়নি, প্রবন্ধ-গ্রন্থও নয়। তাতে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু এই কবি তাঁর বিশ্বাস থেকে, নিজের স্বভাবধর্ম থেকে আমৃত্যু একচুলও নড়েননি।
৭.
২৫ জুন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’ আর এসবের পাশাপাশি ‘প্রতিভা’র দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিভার একটা কাজ হলো তাঁর জনগোষ্ঠীর অচেতন এবং অবচেতন মনস্ক্রিয়ায় যেসব আবেগ ও আইডিয়া তোলপাড় করে, সেগুলোকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুরোনো এই কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করতে হলো। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর মতো মানুষও সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। নিজের বক্তব্যকে বিস্তারে নিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি...একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে: যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে-বস্তুটি কী?’ বুদ্ধদেব যে সরাসরি উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, তা নয়। বোধকরি, এসব প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমাদের কারওরই জানা নেই। অগত্যা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে হয়েছিল, ‘তা [প্রতিভা] কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রম্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগের ক্ষেত্র এক ও অনন্য?’ তিনিও এই সব প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে না-পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এটি ভাবা অনুচিত হবে যে, সেটি ছিল বুদ্ধদেবের অক্ষমতা। কেননা বুদ্ধদেবের ওই গুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি আভাস আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়ে যায়।
২.
নিজের বিষয়ে কী অকপটেই-না সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পিতৃদেব (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি...অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম।’ শুধু তা-ই নয়, কবিতা রচনায় সোজাসুজি প্রেরণার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে, প্রেরণার মধ্যে অলৌকিকের আভাস রয়েছে। ফলে, প্রেরণার পরিবর্তে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল অভিজ্ঞতা। তিনি মনে করতেন যে কাব্যের সৃষ্টির উৎসে উক্তি ও উপলব্ধি একদম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রতিভা থাকলেই কবিতা রচনা সম্ভব নয়, কেননা কাব্য হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার।’ সেই পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের শৈল্পিক নমুনা আমরা সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেই নানাভাবে দেখতে পাই―
‘অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে
জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,
নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।
অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চলে
গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি, শান্তি, শান্তি চারিধারে!
কেবল অন্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।’ (অর্কেস্ট্রা)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যরচনার নেপথ্যের শক্তি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু এই কবির ‘জাগ্রত আত্মচেতনা’র কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে ‘বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এতে করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, ব্যক্তিগতভাবে সুধীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছ থেকে সাড়া পেলেন কম। পাঠককে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য অবশ্য তাঁর ছিল, যে-কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘জনসাধারণের রুচির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দা-প্রশংসায় আমি উদাসীন।’ এই মনোভাবের জন্য সুধীন্দ্রনাথকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে।
৩.
কবির দিক থেকে পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য ও তাঁর আত্মচেতনাকে স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখেছি, সেটাকে অনাদর করা যায় না।’ আর এরপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমার রচনাকে থিওরি দ্বারা পীড়ন না করে...সাংঘাতিক ঘনসন্নদ্ধ অলংকারের দ্বারা তার অঙ্গকে আচ্ছন্ন না করে তার দেহকে সহজ সজীবতার লাবণ্যে যদি প্রকাশ করো, তাহলে তোমার এই লেখাগুলি রসিক সমাজের উপাদেয় ভোজের আয়োজনে লাগবে।’
সুধীন্দ্রনাথকে এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবির দিকে না তাকিয়ে যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করবার চেষ্টা কোরো।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সেই উপদেশকে মান্যতা দেবার গরজ সুধীন্দ্রনাথ সেদিন দেখাননি। এখানেও হয়তো, তাঁর সেই জাগ্রত আত্মচেতনা, তাঁকে অন্যের উপদেশে পথ চলতে নিষেধ করেছিল।
৪.
সাহিত্যে প্রেরণার বদলে সুধীন্দ্রনাথ যেমন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ঠিক অনেকটা সেরকমই তিনি রবীন্দ্রনাথের বদলে টিএস এলিয়টের সাহিত্য-ভাবনাকেই খানিকটা শিরোধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের নিজের বয়ানে দেখতে পাই, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের সার্থকতা।’
আর এলিয়টের প্রণোদনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা যদিও অনন্ত, তবু বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবিতার মৌলিকতা বা সাফল্য বিজড়িত নয়।’ এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলা ‘কাব্যের মুখ্য সম্বল আবেগ; এবং আমাদের আবেগ সংখ্যা যেহেতু অত্যল্প, তাই প্রসঙ্গের দিক থেকে কবিতাবিশেষকে যত অপূর্বই দেখাক না কেন, ফলাফলের বিচারে তার মধ্যে একটা আনুপূর্বিকতা ধরা পড়বেই।’
সে-কারণেই তিনি ওই পথে চরতে চাননি। বরং তিন আজীবন এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, ‘ভাব ও ভাষার অবিচ্ছেদ্য সমীকরণই...কবির একমাত্র কর্তব্য।’ সেই আত্ম-উপলব্ধির জায়গা থেকেই তিনি লিখেছিলেন―
‘নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞানি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।’ (কস্মৈ দেবায়)
৫.
যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’, সেই জীবনানন্দ দাশও মনে করতেন যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিশ। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশি-বিদেশি খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’
আর সেই সঙ্গে এটিও জীবনানন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ।’ রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সুধীন্দ্রনাথের বইখানিতে (‘স্বগত’) জমেছে তাঁর মনন-সাধনার ফসল।’ সেই মনন-সাধনার ফসল যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনই তাঁর প্রবন্ধে স্বকীয়তায় স্থান করে নিতে পেরেছিল।
সম্ভবত সে-জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘সুধীন্দ্র দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন—মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ— সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’
তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ জানতেন, বুঝতেও তো পারতেন। দুজনের সাহিত্যদৃষ্টির যে পার্থক্য, সেটাকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
নিজের ভবিষ্যৎ যেন এই কবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যিক জীবনের অন্তিমপর্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই যে-কারও মনে হবে, এই সেই কবি, যিনি অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন!
৬.
কবির কর্তব্য, তাঁর উদ্দেশ্য ও ব্রত সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদ্ভাবন।’
জীবনের শেষ দশটি বছরে এক ‘দশমী’ ছাড়া তাঁর আর কোনো নতুন কবিতার বই বের হয়নি, প্রবন্ধ-গ্রন্থও নয়। তাতে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু এই কবি তাঁর বিশ্বাস থেকে, নিজের স্বভাবধর্ম থেকে আমৃত্যু একচুলও নড়েননি।
৭.
২৫ জুন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে