Ajker Patrika

বিমানবন্দরের সম্পত্তি দেদার দখল

  • এক প্লটের ২৮ একর জমি দখলে রেখেছে সামিট, কনফিডেন্সসহ ৩৪ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
  • বিমানবন্দরের মালিকানাধীন তিনটি ক্যানটিনের ভাড়া পরিশোধ করা হয় না ১৭-১৮ বছর।
  • বিমানবন্দরের এস্টেট শাখার কর্মচারীদের যোগসাজশে সম্পত্তি দখলের অভিযোগ।
 আবু বকর ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৬: ৩৩
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মালিকানায় থাকা এক প্লটের ২৮ একর জমি মিলেমিশে দখলে রেখেছে ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

এদিকে বিমানবন্দরের মালিকানাধীন তিনটি ক্যানটিনের ভাড়া পরিশোধ না করে ১৭-১৮ বছর দখলে রেখেছে একটি মহল। তা ছাড়া বিজয়নগর আবাসিক এলাকায় বিমানবন্দরেরই সরকারি জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ৮০টি দোকান। এসব দোকান থেকে আসা আয় মসজিদের নামে খরচ করা হচ্ছে বলে দাবি করছে একটি পক্ষ।

শুধু এসব জমিতে নয়, বিমানবন্দরের সরকারি আরও জমিতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত স্কুল। বিজয়নগর এলাকায় বিমানবন্দরের মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি সরকারি প্লট দখলে নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন কয়েক ব্যক্তি। এসব দখলের সঙ্গে বিমানবন্দরের এস্টেট (ভূসম্পত্তি) শাখার কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।

এ অবস্থায় স্থানীয় এক ব্যক্তির মন্তব্য, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সম্পত্তি যেন গনিমতের মাল! যে যার মতো এর সরকারি জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই।

বিমানবন্দরের জায়গায় মসজিদের নামে মার্কেট নির্মাণ করার প্রসঙ্গে ‘মসজিদে আলে ইবনে আবি তালেব’-এর পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমরা বিমানবন্দরের জায়গায় মসজিদে আলে ইবনে আবি তালেবের জন্য ১৭টি, মাদ্রাসার জন্য ১০টি, মুন্সী সর্দার জামে মসজিদের জন্য ১৪টি দোকান নির্মাণ করেছি। এগুলোর আয় মসজিদ, মাদ্রাসার নামে জমা হয়।’ তবে সরকারি জায়গায় দোকান নির্মাণের অনুমতি না থাকার কথা স্বীকার করেন আব্দুস সাত্তার।

বিমানবন্দরসংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় লোকজনের বিবরণ অনুযায়ী, বিমানবন্দরের মালিকানাধীন বিমানবন্দরের সামনের তিনটি ক্যানটিন পরিচালনা করছে বিমান কর্মচারীদের একটি পক্ষ। কিন্তু বিমানবন্দরকে কোনো ধরনের ভাড়া দিচ্ছে না। বিমানবন্দরের নিরবচ্ছিন্ন (অ্যাসেনশিয়াল, নন-অ্যাসেনশিয়াল) বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেও ন্যূনতম বিল পরিশোধ করছে না। ১৬ বছর ধরে তারাই এভাবেই চালাচ্ছে তিনটি ক্যানটিন। এসব ক্যানটিনের সম্প্রসারিত অংশে চলছে বিভিন্ন ব্যবসা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিমান বন্দরের ক্যানটিনগুলো টিন দিয়ে এবং সিমেন্টের স্ল্যাব বসিয়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বরাদ্দের বাইরে আরও দোকান বসানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ পতেঙ্গা মৌজায় (জেএল নং ২৫, বিএস) চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামে এক প্লটে ২৮ একর সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তি দুটি প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপসহ মিলেমিশে দখল করে নিয়েছে ৩৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল) ১২ একর এবং কনফিডেন্স সিমেন্ট ২ দশমিক ৭৩ একর জমি দখলে নেয়। এ ছাড়া স্থানীয় আরও ৩২ ব্যক্তি অবশিষ্ট জমি দখলে নেন।

এক-দুই বছর নয়, সরকারি এই জায়গা ১৬ বছর ধরে দখলে রেখেছে এসএপিএলের কনটেইনার টার্মিনাল। নগরের পতেঙ্গা নাজিরপাড়া (চড়ি হলদা) এলাকায় কনটেইনার টার্মিনালটির অবস্থান। অবৈধভাবে দখলে রাখা জায়গাটি ছেড়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে কয়েক দফা নোটিশ দিয়েছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জায়গাটি পুনরুদ্ধারে আবার তোড়জোড় শুরু করে। এর আগে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই বেবিচকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডকে একটি উচ্ছেদ নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে সাত দিনের মধ্যে সেখানে নির্মিত স্থাপনা অপসারণের জন্য বলা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহাম্মেদ জামিল নোটিশটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের পক্ষে নোটিশ গ্রহণ করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (অপারেশন) ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার।

একইভাবে বিমানবন্দরের দখল করা জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই বেবিচকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে কনফিডেন্স সিমেন্ট কর্তৃপক্ষকেও নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে সাত দিনের মধ্যে সেখানে নির্মিত স্থাপনা অপসারণের জন্য বলা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুটি এখনো বিমানবন্দরের দখল করা জমি ছেড়ে দেয়নি।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

এসএপিএলের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। ফোর্বস সাময়িকীর ২০২৪ সালের সিঙ্গাপুরের ৫০ ধনীর তালিকার তিনি ৪৩তম। আজিজ খান সে দেশেই থাকেন বলে জানা যায়। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সদ্য সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের ভাই।

জানতে চাইলে এসএপিএলের পরিচালক (অপারেশন) ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের কেনা সম্পত্তির ওপর কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড বিমানবন্দরের কোনো জায়গা দখল করেনি। অবৈধ দখলদার হিসেবে বেবিচক থেকে দেওয়া নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান।

এভাবেই বিমানবন্দরের বিজয়নগর আবাসিক এলাকায় সরকারি জায়গায় দুটি মসজিদের নাম দিয়ে প্রায় ৮০টি দোকানের মার্কেট নির্মাণ করেছে সংশ্লিষ্ট দখলদারেরা। কেজি স্কুলের নামেও বিজয়নগরে বিমানবন্দরের মালিকানাধীন সরকারি জায়গা দখল হয়েছে। বিমানবন্দরের ভূসম্পত্তি শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক মো. হাবিব উল্যা খান এসব দখলদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য মো. হাবিব উল্যা খান তাঁর জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এ প্রসঙ্গে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন শেখ আব্দুল্লাহ আলমগীর বলেন, ‘বিজয়নগরে কিছু অবৈধ দখলদার রয়েছে; তাদের ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। সামিটসহ ৩৪ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের দখল থেকে ২৮ একর জমি উদ্ধারের ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। সব জায়গা উদ্ধারে কাজ চলছে।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত