Ajker Patrika

রাসায়নিকে মোড়ানো আনারসে স্বাস্থ্যঝুঁকি

  • নিষিদ্ধ ওষুধ, গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করে পাকার সময় এগিয়ে আনা হয়েছে।
  • শুধু মধুপুরে বছরে বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার কীটনাশক।
আনোয়ার সাদাৎ ইমরান, টাঙ্গাইল 
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮: ২৮
ক্ষতিকর রাসায়নিক ছিটানো হচ্ছে আনারসখেতে। ছবি: আজকের পত্রিকা
ক্ষতিকর রাসায়নিক ছিটানো হচ্ছে আনারসখেতে। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাইপেন, ইথোফন, জিব্রেলিক অ্যাসিডসহ নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারসে। এর কারণে ঔষধি গুণসম্পন্ন সুস্বাদু আনারস মরণঘাতী ক্যানসারের উপকরণবাহী ফলে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এমন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে দ্রুত আনারস দ্রুত বড় হয় এবং পবিত্র রমজানে বাজারে আনা যায়।

এদিকে আনারসে রাসায়নিক ব্যবহার করে শারীরিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকেরাও। তাঁরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যানসারে।

মধুপুরের মহিষমারা, কুড়াগাছা, শোলাকুড়ি, ফুলবাগচালা, বেরীবাইদ, অরণখোলা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি লাল মাটির পুরো এলাকায় আনারস বাগান। বাগানগুলোর মধ্যে কোনোটি ক্যালেন্ডার জাতের আবার কোনোটি জলডুবি বা জলডুঙ্গি জাতের। মধুপুর উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, মধুপুরে চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে আনারস আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ক্যালেন্ডার ৪ হাজার ২২০ হেক্টর, জলডুবি বা জলডুঙ্গি ২ হাজার ৩৯২ এবং এমডি ১৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।

উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, আনারস পাকার প্রকৃত সময় হলো জুন-জুলাই মাসে। এই আনারসগুলোতে গ্রোথ হরমোন, ইথ্রেল, রাইপেনিং, জিব্রেলিক অ্যাসিড ব্যবহার করে অমৌসুমে ফল উৎপাদন করেছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাকিব আল রানা বলেন, মধুপুরের অর্থনীতি সচল করেছে আনারস। এই আনারসের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বাজার রয়েছে মধুপুরে। শুধু জলডুবি আনারসই বিক্রি হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার। এই আনারস মূলত বর্ষা মৌসুমে দ্রুত বড় হয় এবং পেকে যায়। কিন্তু বর্তমানে কিছু কৃষক ও অসাধু ব্যবসায়ী আগাম বাজারজাত করার জন্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেমিক্যাল ব্যবহার করছেন।

অননুমোদিত ওষুধে সয়লাব

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মধুপুরে সার ও কীটনাশকের দোকান আছে ৩৩৪টি। শুধু কীটনাশক বিক্রির দোকান হলো ২৩৫টি। বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমানে মধুপুরে এমন রাসায়নিক বিক্রি করছে ১০৮টির অধিক কোম্পানি। সব মিলিয়ে ৭৬-৮০ কোটি টাকার রাসায়নিক বিক্রি হয়ে থাকে মধুপুর অঞ্চলে। বড় কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিনিধি দিয়ে ইন্ডিয়ান নিষিদ্ধ প্রানোফিক্স, মিরাক্কেল, ব্রাইট ও ইতোফেন-জাতীয় কেমিক্যাল কৃষকের বাড়িতেও পৌঁছে দেয় অনেক সময়। প্রতিটি কৃষক তাদের বাড়িতেও সংরক্ষিত রাখে এই কেমিক্যাল। এই তথ্যদাতার কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক

আনারস চারার ২৮ পাতা হওয়ার পর রাসায়নিক দেওয়ার বিধি থাকলেও ১৬-২০ পাতা হওয়ার পরই কৃষক হরমোন বা গর্ভবতী বা সিজার করছে। এ ছাড়া কার্বলিক অ্যাসিড, ক্লোরোফেনেক্সি অ্যাসিটিক অ্যাসিড, জিব্রেলিক অ্যাসিড-জাতীয় রাসায়নিক বিভিন্ন কোম্পানির ভিন্ন ভিন্ন নামের ওষুধ পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে প্রতিটি আনারস পুরোপুরি ভিজিয়ে দেয়। নিষিদ্ধ এই রাসায়নিকগুলো ভারত ও চীন থেকে অবৈধভাবে আমদানি করে বাজারজাত হচ্ছে মধুপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে।

উপজেলার অরণখোলার আবু তালেব বলেন, ‘জলডুবি আনারস লাগানোর ৭-৮ মাস পরে আনারসে কেমিক্যাল করি। ৩০-৪০ দিনের মধ্যেই ঝাত কইরা এক লগে সব গাছে ফুল বাইর অয়। এই ফুল থেকে গুটি ধরলেই ভিটামিন দেই। তিন মাস পরেই পাকানির ওষুধ দিয়া বাজারে বিক্রি করি।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু হাদি নূর আলী খান বলেন, ভারত থেকে চোরাই পথে আনা রাসায়নিক দ্রবণ ব্যবসায়ীরা বা তাঁদের প্রতিনিধিদের দিয়ে গোপনে প্রকাশ্যে কৃষকদের মাঝে বিক্রি করছে। তারা কয়েক ধরনের কেমিক্যাল মিশিয়ে ‘ককটেল’ তৈরি করে আনারসে প্রয়োগ করে ফুল আনা, ফল বড় করা এবং আনারস পাকানোর মতো অপকর্ম করছে, যা খেলে মানুষের ক্ষতি হবেই।

আক্রান্ত হচ্ছেন কৃষকেরা

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) অধ্যাপক পুষ্টিবিজ্ঞানী মো. আবু জুবাইর বলেন, স্থানীয় কৃষকেরা এই ক্ষতির ভয়াবহতা জানেন না বলেই তাঁরা ক্ষতিকর রাসায়নিক স্প্রে করে থাকেন। যার ফলে দেশে বহু কৃষক এখন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন।

উপজেলা কৃষি অফিসার রাকিব আল রানা জানান, বর্তমানে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৩৭ শতাংশই কৃষক। তাঁরা জানেন না কেন তাঁরা ক্যানসারের মতো মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

এদিকে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা হোসাইন জানান, মধুপুরে ২০১৪ সালে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের একটু ওপরে। বর্তমানে এই প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৫০ জন।

এলাকার মানুষ কম খায় আনারস

অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে মধুপুর ও আশপাশের এলাকায় আনারসের ভোক্তা কমে গেছে। জামালপুরের তারাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী আক্কাস আলী বলেন, ‘যে ফল শিয়ালে খায় না, বানরে খায় না, টগায় খায় না হেইডা কিবা কইরা কিনা নিয়া মানসেরে খাওয়ামু। তাই আনারসের ব্যবসা ছাইরা কলা বেচি।’

মধুপুর পৌর শহরের গৃহবধূ শামছুন নাহার জানান, আনারস কাটার পর সুঘ্রাণের বদলে বেরিয়ে আসতে থাকে উৎকট ওষুধের গন্ধ। তিনি বলেন, ‘দুই টুকরা খাওয়ার পর আনারস খাওয়ার ইচ্ছাই মিটে গেছে।’

মধুপুরের বাজারের আনারস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পুষ্টিবিজ্ঞানী মো. আবু জুবাইর। তিনি বলেন, মধুপুরের আনারসে ইথোফন, রাইপেনিংসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রবণ মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহারের কারণে ঔষধি গুণসম্পন্ন আনারস ক্যানসার সৃষ্টির উপকরণবাহী মরণঘাতী ফলে পরিণত হচ্ছে। ক্ষতিকর রাসায়নিকে পূর্ণ আনারস খেলে গর্ভবতী মা ও গর্ভের সন্তান ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এমনকি গর্ভের সন্তান প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বেও ড. খলিলুর রহমান

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পর আপাতত ভরসা ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দর

বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল ভারত

বাথরুমে গোপনে নারীদের ভিডিও ধারণ, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কর্মচারী আটক

একমাত্র বিদেশি ‘বীর প্রতীক’ ঔডারল্যান্ড, যাঁর জন্য মুক্তিযুদ্ধের অংশ হলো বাটা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত