‘যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, সে-ই চাকু দিয়ে আমার চেহারা কাটে’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮: ২৭
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬: ৩২

‘নরপশুর মতো নির্যাতনের পরেও আমি কেন মরে যাইনি, সেটাই ওর রাগ। লজ্জায়, মান সম্মানের ভয়ে আমি এত দিন কথা বলি নাই। কিন্তু এখন আমার সন্তানকে অ্যাসিড মারার হুমকি দিচ্ছে। তাই আর চুপ থাকতে পারলাম না।’ —আজ রোববার আজকের পত্রিকাকে কথাগুলো বলছিলেন স্বামীর নির্যাতনের শিকার নারী তাসনিম সারা প্রিয়া। 

গত ১০ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর উত্তরার বাসায় স্বামী মো. রনি চাকু ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাঁর মুখ থেঁতলে দেন। এ ঘটনায় গত ২২ মে উত্তরা পশ্চিম থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন তিনি। সম্প্রতি তিনি এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টিকে সামনে আনেন। পরে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। 

তাসনিম সারা প্রিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, মো. রনি এরাবিয়ান বোরকা কালেকশনের কর্ণধার। ২০২০ সালে তাঁদের পরিচয় হয়। এরাবিয়ান বোরকা কালেকশনের অনলাইন পেজে লাইভ করতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। ২০২২ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। 

তাসনিম সারা প্রিয়ার অভিযোগ, বিয়ের পর রনি তাঁকে নজরবন্দী  জীবন যাপনে বাধ্য করেন। পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলতে দিতেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি যৌতুকের জন্যও চাপ দিতে থাকেন। বাবার ফ্ল্যাট বিক্রি করে অথবা বন্ধক রেখে টাকা এনে দিতে বলা হয়। এতে রাজি না হয়ে তালাক দিতে চাওয়ায় তাসনিমকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। 

তাসনিম সারা প্রিয়া বলেন, ‘যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, সে-ই চাকু দিয়ে আমার চেহারা কাটে। সেদিন দুপুরে আমি নামাজ পড়ছিলাম। তখন রনি তিনজনকে নিয়ে বাসায় ঢোকে। ড্রেসিং টেবিলের ভারী কাঠের টুল দিয়ে আমার মুখে বাড়ি দেয়, হাতে চেইন পেঁচিয়ে এসেছিল, সেটা দিয়ে ঘুষি দিয়ে আমার মাথা ফাটায়। চাকু দিয়ে কপাল থেকে ঠোঁটের নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলে। আমার চেহারা সে নষ্ট করে দিয়েছে। আমার নাক ভেঙে গিয়েছিল, নাকের কোনো হাড্ডি ছিল না। মুখের ওপরের চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল। বাম পাশের দাঁত নড়ে গেছে। মাথার হাড্ডি বের হয়ে গিয়েছিল।’ 

সেদিন বাসায় থাকা তাসনিমের মা এবং ছোট বোনকেও রনির সঙ্গে আসা লোকেরা মারধর করে বলে জানান তাসনিম। একপর্যায়ে তাঁদের চিৎকার শুনে ভাড়াটে ও বাড়ির মালিক এসে তাঁদের উদ্ধার করেন। তখন রনি পালিয়ে যায়। 

নির্যাতনে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তাসনিম সারা প্রিয়া। ছবি: সংগৃহীত তাসনিম জানান, ২০১৪ সালে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। সেই স্বামীর সঙ্গে ২০১৮ সালে বিচ্ছেদ ঘটে। সেই সংসারে তাঁদের একটি মেয়ে রয়েছে, যার বয়স বর্তমানে আট বছর। রনির একজন স্ত্রী রয়েছে জেনে তিনি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর জানতে পারেন, তাঁর দুজন স্ত্রী। 

তাসনিমের ভাষ্যমতে, রনির দুজন স্ত্রীই তাঁকে মোটা অঙ্কের যৌতুক দিয়েছিলেন। প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া তিন কোটি টাকা দিয়ে রনি তাঁর ব্যবসা দাঁড় করান। দ্বিতীয় স্ত্রীও তাঁকে ১৫-২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। 

তাসনিম বলেন, ‘আমার বেঁচে থাকার কোনো কথা ছিল না। আমি ২০ দিন হসপিটালে ছিলাম। দুইটা সার্জারি হয়েছে। এখনো আমার ট্রিটমেন্ট বাকি। আমার ছোট মেয়েটার বয়স ১০ মাস। আমি মরে গেলে আমার মেয়েদের কে দেখবে?’ 

রনির বিচার চেয়ে গত ২২ মে উত্তরা পশ্চিম থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন তাসনিম। এরপর গত ১৩ আগস্ট রনিকে তালাকের নোটিশও পাঠিয়েছেন। তাসনিম জানান, রনি এবং তার পরিবার বিত্তবান ও প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশের কাছ থেকে তিনি আশানুরূপ সাহায্য পাননি। 

এদিকে তাসনিমের লাইভের পর রনিও লাইভে এসে তাসনিমের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করেন। 

রনি বলেন, তাসনিম পরকীয়া সম্পর্কে জড়িত থাকায় রাগান্বিত হয়ে তিনি নির্যাতন করেন। তাসনিম একাধিক বিয়ে করেছে বলেও অভিযোগ করেন। 

রনি দাবি করে বলেন, তাসনিম তার বাসা থেকে ২৫ থেকে ৩০ ভরি সোনা, ঘরের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তাসনিম। 

লাইভে রনি বলেন, তাসনিম ফেসবুকে মিথ্যা বলে মামলা দিয়ে তাঁকে ‘ভিলেন’ বানাবার চেষ্টা করছেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াকে প্রকাশ্যে এনে তাসনিম স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন। আইনিভাবেই তিনি জামিনে আছেন বলেও জানান। পরবর্তীতে তিনি লাইভ ভিডিওটি মুছে (ডিলিট) ফেলেন। 

এসব বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী এলিনা খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রথম কথা হলো, কোনো আইনই নির্যাতনকে সমর্থন করে না। স্ত্রী যদি পরকীয়া করে থাকেন, তাহলে স্বামী তাঁকে ডিভোর্স দিতে পারতেন। আমাদের দেশে কিছু ঘটলেই নারীর চরিত্রকে সামনে আনা হয়, পরকীয়ার কথা বলা হয়। লোকজনও মনে করে, মহিলাটা খারাপ কাজ করেছে, তাই শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু যে লোকটা অত্যাচার করেছে, তাঁকে খারাপ লোক হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। পরকীয়া করে থাকলে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়া যেত অথবা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ ছিল। কোনোটাই না করে স্ত্রীকে নির্যাতন করে সে বেআইনি কাজ করেছে। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত