এসি-ফ্রিজ লাগিয়ে আশ্রয়ণের ৬ ঘরে বিলাসী জীবন

­যশোর প্রতিনিধি
Thumbnail image
মনিরামপুরের মধুপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সামনে জমির দলিল হাতে আলতাফ হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

ভূমিহীন পরিচয়ে একজন বাগিয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ছয়টি ঘর। আরেকজন বাগিয়েছেন চারটি। আবার কেউ কেউ ঘর নিলেও থাকেন না সেখানে। এর মধ্যে একজন তো ঘটিয়েছেন অবাক কাণ্ড! নিজ কব্জায় রাখা ৬টি ঘরের তিনটিতে লাগিয়েছেন এসি। মেঝেতে করেছেন টাইলস। তাঁর দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে করছেন বিলাসী জীবনযাপন। ভূমিহীনদের ঘর বিতরণে এমন নজিরবিহীন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে যশোরের মনিরামপুরের একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে। অথচ গ্রামটিতে অনেকেই রয়েছেন গৃহহীন-ভূমিহীন।

জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, বরাদ্দে অনিয়ম হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে, সত্যতা পেলে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।

মনিরামপুর উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২২টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। সাদা রঙের ঘরগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম উত্তর প্রান্তের ৬টি ঘর। দুই বছর আগে গোলাপি রঙের ঘরগুলোর বারান্দা ঘেরা হয়েছে গ্রিল দিয়ে, মেঝে মোড়ানো হয়েছে টাইলসে, তিনটি ঘরে লাগানো হয়েছে দেড় টনের তিনটি এসি। ঘরে রয়েছে মূল্যবান আসবাবপত্র, টেলিভিশন ও ফ্রিজ। এমনকি উঠানটিও করা হয়েছে পাকা ঢালাই।

দুই স্ত্রী, সন্তান ও শ্যালিকাসহ ১২ সদস্যে নিয়ে এই ৬ ঘরে বসবাস করছেন আলতাফ হোসেন। অভিযোগ উঠেছে, ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব ঘর বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। এরপর নিজেদের মতো করে সাজিয়েছেন। কথিত ভূমিহীন এ পরিবারে বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে এলাকায় সমালোচনা চলছে।

আলতাফ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যে জমিতে এই এই আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হয়েছে, সেই জমিতেই ২০০৮ সাল থেকে এই জমিতে দুই স্ত্রীসহ ছেলে মেয়ে নিয়ে তিনি দুটি বাড়ি বানিয়ে থাকছিলেন। হঠাৎ ২০২১ সালে সরকার যখন উদ্যোগ নিল গৃহহীনদের বাড়ি নির্মাণের। তখন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার এই জমিতে এসে বলেন, এই খাস জমিতে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণ করা হবে। আমাকে এই বাড়ি ভাঙার নির্দেশনা দেন। তখন আমাকে ইউএনও স্যার বলেন আপনার যতগুলো পরিবার ততগুলো ঘর দেওয়া হবে। ইউএনও স্যার আমাকে ৬টি ঘরই দিয়েছে। সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকছি।’

মনিরামপুর উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামে ২২টি ঘরের আশ্রয়ণ প্রকল্প। ছবি: আজকের পত্রিকা
মনিরামপুর উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামে ২২টি ঘরের আশ্রয়ণ প্রকল্প। ছবি: আজকের পত্রিকা

দাবি প্রকৃত ভূমিহীন হিসেবেই তারা ঘর পেয়েছেন; স্বচ্ছতা ফেরায় শখ পূরণ করেছেন মাত্র দাবি করে বলেন, ‘আমরা দুই ছেলে ঢাকাতে চাকরি করেন। তারাই আমার ঘরগুলো সংস্কার করেছে। ঘরে টাইলস, ফ্রিজ, এসি লাগিয়েছে। এটা তো দোষের কিছু না।’

আলতাফের মতো স্থানীয় হরিহর নগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাকের আত্মীয় এজাজুল হক মধুও বাগিয়েছেন চারটি ঘর। এজাজুল চারটি ঘর নিলেও থাকেন না একটিতে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আধা কিলোমিটার দূরে তার নিজ বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। স্থানীয়রা জানান, চারটি ঘরের মধ্যে একটি ঘরে মাঝে মধ্যে আসেন তিনি। বাকিগুলো তালাবদ্ধ থাকে। জমির দলির ও বাড়ির কাগজপত্র বুঝিয়ে নিয়ে তাঁরা থাকেন অন্যত্র।

বিষয়টি স্বীকারও করেছেন এজাজুলও। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চারটি ঘরের মধ্যে একটিতে মাঝে মধ্যে থাকি। বাকি তিনটির মধ্যে একটি মেয়ে, ভাগনি ও ভাইপোকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ থাকেন না এখানে।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, বিগত সরকারের সময়ে প্রভাব খাঁটিয়ে যে যার মতো ঘর বাগিয়ে নিয়েছে। ঘর বরাদ্দের সময় সরকারি কর্মকর্তারা কারও কথা শোনেনি। তাঁরা যথেচ্ছাচার করেছেন।

হরিহরনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘পূর্বের চেয়ারম্যান এই ঘর বরাদ্দের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই অনিয়ম করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন।’

আশ্রয়ণের ঘরে এসি লাগিয়েছেন আলতাফ হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
আশ্রয়ণের ঘরে এসি লাগিয়েছেন আলতাফ হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেছেন, ‘বরাদ্দে অনিয়ম হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে, সত্যতা পেলে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের তথ্যমতে, ২০২১ সালে বরাদ্দ দেওয়া দুই শতক জমির ওপর নির্মিত আশ্রয়ণের প্রতিটি ঘরে দুটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর, একটি টয়লেট ও বারান্দা রয়েছে। একটি ঘর নির্মাণে সরকারের খরচ হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।

এলাকায় অনেকেই গৃহহীন-ভূমিহীন
মধুপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে এমন নজিরবিহীন অনিয়ম ঘটলেও এলাকায় রয়েছে ভিন্ন চিত্র। দেড় কিলোমিটার দূরে খাটুয়া গ্রাম। এই গ্রামের চার সদস্যে নিয়ে ডলি খাতুনের সংসার। তবে তাঁর একটুকু জমি নেই। পরের জায়গায় টিনের ছাউনি আর মাটির দেয়ালের দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরেই বসবাস করেন তিনি। সেটিও ভঙ্গুর দশা। মাটির দেয়ালও পড়েছে ভেঙে। স্বামী সন্তান, শাশুড়ির মতো নিজেও প্রতিবন্ধী। তারপরেও ঘুরেছেন জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে, তবুও মেলেনি একটি ঘর।

কাঁদো গলায় ডলি খাতুন বলেন, ‘আমরা সবাই অসহায়। সবাই প্রতিবন্ধী। লোকজন আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকি। সবাই প্রতিবন্ধী, তেমন কোনো কাজ পারে না। চার বছর বয়সী ছেলেটাও প্রতিবন্ধী; তারে সব সময় কোলে রাখতে হয়। ফলে আমিও সেভাবে কাজ করতে পারি না। কেউ যদি আমাদের একটা ঘর দিত; তাহলে খুব উপকৃত হতাম।’

স্থানীয় মজিবর রহমান নামে এক ইজিবাইক চালক বলেন, ‘ইউনিয়নের মধুপুর ও খাটুরি গ্রাম মিলে একই ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের ভূমিহীনদের মধুপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও বাড়ি দেওয়া কথা থাকলেও পায়নি অনেক ভূমিহীন পরিবার। নেতাদের প্রভাব খাঁটিয়ে যে যা পেরেছে; তাই করেছে। অথচ প্রতিবন্ধী ডলি খাতুন, গৃহহীন মফিজুররা ঘর পায়নি। পেয়েছে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীর লোকজন বা নেতাদের আত্মীয়স্বজনরা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত