মন্ত্রী ও স্বজনদের হাতে কলঙ্কিত প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়

  • নামকাওয়াস্তে পাঠদান চললেও বিশেষ ক্ষমতায় এমপিওভুক্ত হয়
  • চাকরির নামে টাকা আদায় ও জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে
  • প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী এক শিক্ষক
খোরশেদ আলম সাগর, লালমনিরহাট
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯: ৫৭
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯: ৫৮
নুরুজ্জামান আহমেদ

বুদ্ধি, শারীরিক ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য গড়ে তোলা করিমপুর নুরজাহান সামছুন্নাহার প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের করিমপুরে নিজ গ্রামে এ বিদ্যালয় গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। মায়ের নামে করা এ বিদ্যালয়েও নুরুজ্জামান এবং তাঁর পরিবার দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে চাকরির নামে টাকা আদায়; এমনকি জমি লিখে নেওয়ারও অভিযোগ সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ওই প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। নামকাওয়াস্তে পাঠদান চললেও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিশেষ ক্ষমতায় দেশের একমাত্র প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় হিসেবে এটি এমপিওভুক্ত হয়।

প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়গুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে পরিচালিত হয়। এগুলো সাধারণত কোনো নিবন্ধিত সংস্থার ব্যানারে গড়ে ওঠা। এ জন্য নুরজাহান সামছুন্নাহার প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অর্থে গড়ে তোলা হয় নুরজাহান সামছুন্নাহার উন্নয়ন সংস্থা। ওই সংস্থার সভাপতি করা হয় সাবেক মন্ত্রীর ছোট ভাই শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টুকে। পদাধিকারবলে তিনিই বিদ্যালয়ের সভাপতি হন আর তাঁর স্ত্রী জেসমিন আখতার পলিকে করা হয় প্রধান শিক্ষক।

এদিকে প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা ও পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি গড়ে তুললেও এমপিও করানোর সময় চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় অনেককে বাদ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার টাকা দিয়ে কেউ বিদ্যালয়ে যোগদান না করেও তিন মাসের বেতন-ভাতা পেয়েছেন। এমন ঘটনার শিকার সহকারী শিক্ষক (শরীরচর্চা) মোহাইমুনুল হাসান প্রতিকার চেয়ে ৩ নভেম্বর জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

মোহাইমুনুল হাসান বলেন, বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে সভাপতি শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টু তাঁর (মোহাইমুনুল) বাবা আজিজুল ইসলামের কাছ থেকে ৫৪ শতাংশ জমি লিখে নেন। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর যোগদানপত্র নিয়ে নিয়মিত চাকরি করে আসছিলেন তিনি। কিন্তু এমপিওভুক্ত হলে তাঁর পদে রঞ্জু মিয়া নামের একজন নতুন শিক্ষকের নাম আসে। এমপিও প্রকাশের পরদিন থেকে ওই শিক্ষক বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। পরে টাকা ও জমি ফেরত চাইলে মোহাইমুনুলকে মেরে ফেলার হুমকি দেন সাবেক মন্ত্রীর ভাই ভুট্টু।

এ ছাড়া রবিউল ইসলাম, জপা রানী ও হাসিনা বেগম শিক্ষা সহায়ক পদে প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে চাকরি করলেও এমপিওতে তাঁদের নাম নেই। আবার অফিস সহকারী পদে চাকরি শুরু করা রেখা খাতুনকে করা হয় শিক্ষা সহায়ক (আয়া)। আর অফিস সহকারী পদে নাম আসে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা লিটন মিয়ার বোন হালিমা বেগমের। এমএ পাস হরিদাস সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেও এমপিওতে নাম আসে শিক্ষা সহায়ক (আয়া) পদে।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভুট্টুর স্ত্রী জেসমিন আখতার পলি ঢাকায় বসবাস করলেও নিয়মিত বিদ্যালয়ে হাজিরা দেখানো হচ্ছিল। তবে সরকার পতনের পর তিনি এখন এলাকায় থাকছেন। তা ছাড়া প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হলে প্রতিবন্ধী ধরন (বুদ্ধি, বাক্, দৃষ্টি) বিষয়ক ৬ মাসের বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ আবশ্যক হলেও কারও প্রশিক্ষণ সনদ নেই। তবে পটপরিবর্তন হওয়ায় সবাই প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন বলে বিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান জেসমিন আখতার পলির কাছে বিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবটাই জানতেন তাঁর স্বামী সভাপতি শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টু। সম্প্রতি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি রংপুর কারাগারে রয়েছেন।

প্রধান শিক্ষক পলি দাবি করেন, প্রতিষ্ঠার সময় ২০০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল; পরে কমে গেছে। তবে কাগজ-কলমে ২২৩ শিক্ষার্থীর পাঠদানে ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে।

এদিকে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালে সেই হোস্টেল দুটিও নির্মাণ করা হয় সাবেক মন্ত্রীর নিজ উপজেলা কালীগঞ্জে। বালক হোস্টেল ব্যবহার হচ্ছে সাবেক মন্ত্রীর মায়ের নামের বিদ্যালয়ের অফিস। বালিকা হোস্টেল ব্যবহার করছে তাঁর ভাইয়ের বিদ্যালয়। হোস্টেল নির্মাণ করা হলেও এর জনবল নিয়োগ দেননি সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী।

এ বিষয়ে লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ মতিয়ার রহমান কোনো তথ্য দিতে না পেরে বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য অফিসে এ-সংক্রান্ত কোনো ফাইল নেই। তবে শুনেছি, হোস্টেলের ফাইল মন্ত্রীর ছোট ভাই শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টুর কাছে। যিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টির কোনো নথি নেই অফিসে। মূলত বিগত সময়ে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরাই সব বলতে পারবেন।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত