জেরেমি করবিন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য
আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে আমি শেষবার গিয়েছিলাম ২০১৩ সালের প্রথম দিকে। গাজার উত্তরে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত শরণার্থীশিবিরটি ‘বিচ ক্যাম্প’ নামে পরিচিত ছিল। সেখানে ফল ব্যবসায়ীরা নানা রঙের ছাতার নিচে বসে ফল বিক্রি করতেন। বিড়ালগুলো সরু গলির মাঝখানে ঘুমাত। শিশুরা দড়িলাফসহ নানা ধরনের খেলাধুলা করত।
নাকবাতে সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর করে বাস্তুচ্যুত করার পর ১৯৪৮ সালে বিচ ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে শিবিরে প্রায় ২৩ হাজার শরণার্থীকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সাত দশকে এই সংখ্যা ৯০ হাজারে পৌঁছায়। মাত্র শূন্য দশমিক ২ বর্গমাইল জায়গার মধ্যে এত মানুষ থাকত।
গাজার জনগণ ১৬ বছর ধরে অবরোধের মধ্যে বসবাস করছে। ইসরায়েল দখলদারি বজায় রাখতে গাজার ভেতরে ও বাইরে যা আছে এর বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিচ ক্যাম্পও আলাদা কিছু ছিল না। সেখানকার লোকেরা বেঁচে থাকার জন্য ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সির সাহায্য এবং পরিষেবার ওপর নির্ভর করত। এসব পরিষেবার মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র এবং বেশ কয়েকটি স্কুল ভবন ছিল।
বিচ ক্যাম্পের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। আমাকে স্কুলটির ছাদে উঠতে দেওয়া হয়েছিল, যেখান থেকে আমি একপাশে ইসরায়েলের বেড়া দেখতে পেয়েছিলাম। সমুদ্রে বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি টহল নৌকা দেখেছিলাম। পরে জেনেছি, এসব নৌকা ফিলিস্তিনি জেলেদের ছয় নটিক্যাল মাইলের বেশি যেতে দিত না।
স্কুলটি চালাতেন কয়েকজন অনুপ্রেরণাদায়ী ও কঠোর পরিশ্রমী শিক্ষক, যাঁদের দর্শন ছিল আবিষ্কার, সংগীত, থিয়েটার এবং শিল্পের জন্য একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করা। কয়েকজন ছাত্র আমাকে তাদের কাজ দেখিয়েছিল। তাদের ড্রয়িং খাতায় অনেক বিমান, বেড়া ও বোমার ছবি আঁকা ছিল। তবে অন্যান্য জিনিসও তারা এঁকেছিল: তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন ও বন্ধুদের ছবি। স্পষ্টতই, সব শিশু ট্রমায় ভুগছিল, তবে তাদের শেখার, ভাগ করে নেওয়া এবং খেলার ইচ্ছাও ছিল।
দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলার দুই দিন পর গত ৯ অক্টোবর বিচ ক্যাম্পে ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর পাওয়া যায়। তবে বিচ ক্যাম্পে এটাই প্রথম হামলা ছিল না। ২০২১ সালের মে মাসে এই ক্যাম্পে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে আটজনই ছিল শিশু। শুধু ৯ অক্টোবরই নয়, তিন সপ্তাহে বিচ ক্যাম্পকে বারবার লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরায়েলি সেনারা।
যখন আমি গাজায় বোমা হামলার খবর শুনি, তখন বিচ ক্যাম্পের সেই স্কুলের কথা ভাবি। আমি জানি না এটি এখনো আছে কি না। আমি জানি না, ওই শিশু ও শিক্ষকেরা বেঁচে আছেন কি না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২৩ লাখ জনসংখ্যার এই ছোট্ট উপত্যকায় ২৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে। তারা বেসামরিক মৃত্যু এড়াতে চেষ্টা করছে তা কিন্তু নয়। গাজায় ইতিমধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার।
যারা বেঁচে আছে, তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক জিনিস—পানি, জ্বালানি, খাদ্য এবং চিকিৎসা সবই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার করছেন চিকিৎসকেরা। মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের বিদ্যুৎ ফুরিয়ে যাওয়া ইনকিউবেটরে বেঁচে থাকার লড়াই দেখছেন। মানুষ বাধ্য হচ্ছে সমুদ্রের পানি পান করতে। ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
তবে ইসরায়েলে চালানো হামাসের হামলারও নিন্দা জানানো উচিত। ওই হামলায় ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নিহত হন। একটি গানের কনসার্টে ওই হামলা চালানো হয়। যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা সবাই সেখানে গান শুনতে গিয়েছিলেন। তাঁরা জুয়েলারি ডিজাইনার। তাঁরা কারখানার শ্রমিক। তাঁরা শান্তির প্রচারক। তাঁদের পরিবার যে কষ্ট ও যন্ত্রণা অনুভব করছে তা চিরকাল থাকবে।
তবে এ ঘটনা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণকে ন্যায্যতা দিতে পারে না; যা তারা করেনি এমন জঘন্য অপরাধের জন্য শাস্তি পাচ্ছে। আমাদের শান্তির জন্য কণ্ঠস্বর দরকার। উল্টো বিশ্বব্যাপী রাজনীতিবিদেরা ইসরায়েলি সরকারকে আত্মরক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনগণকে অনাহারে রাখার ও হত্যা করার সবুজ সংকেত দিয়ে চলেছেন।
গাজার প্রতিটি মানুষের একটি নাম ও একটি মুখ আছে; আমরা ইনকিউবেটরে শিশুদের জন্য যেমন গভীরভাবে শোক করি, ঠিক তেমনি মধ্যবয়সী পুরুষদের জন্য শোক করি, যাঁরা রাস্তা পার হতে গিয়ে নিহত হন। যা-ই হোক না কেন, আমরা সুন্দর, সৃজনশীল জীবন চুরির শোক করছি। শিল্পী, যাঁদের আঁকা আমরা কোনো দিন দেখব না। গায়ক, যাঁদের গান আমরা কখনো আর শুনব না। লেখক, যাঁদের বই আমরা কখনোই পড়ব না। রাঁধুনি, যাঁদের বানানো কুনাফা আমরা কখনোই খাব না। শিক্ষক, যাঁদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষাই আমরা কখনো পাব না।
আমরা শুধু গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছি না। আমরা একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতি, একটি পরিচয় এবং একটি জাতিকে মুছে ফেলা দেখছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিভিন্ন মানদণ্ড অনুযায়ী গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করেন। গণহত্যা মানে শুধু গণহারে মানুষ হত্যা নয়। গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া বা জোর করে শিশুদের স্থানান্তর করাও গণহত্যা বলে বিবেচিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে, একটি নির্দিষ্ট জাতিকে বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
২ নভেম্বর জাতিসংঘের সাতজন বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, ‘তাঁরা নিশ্চিত যে ফিলিস্তিনি জনগণ গণহত্যার গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে।’ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অফিসের পরিচালক ক্রেগ মোখিবারের পদত্যাগের পর ওই সাতজন র্যাপোর্টিয়ার এ মন্তব্য করেন। ক্রেগ মোখিবার গাজার ভয়াবহতাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মোখিবার নিজের পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, আরব জাতি হওয়ায় ফিলিস্তিনি জনগণকে পাইকারি হারে হত্যা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পশ্চিম তীরে ক্রমাগত বাড়িঘর দখল করা হচ্ছে। তিনি ইসরায়েলি সরকার ও সেনাবাহিনীর নেতাদের উদ্দেশ্যের সুস্পষ্ট বিবৃতি তুলে ধরেন।
তবে ক্রেগ মোখিবার একটি বিষয় উল্লেখ করেননি। তিনি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের কথা উল্লেখ করতে পারতেন, যিনি পোস্ট করেছিলেন যে ‘যতক্ষণ হামাস তার হাতে জিম্মিদের মুক্তি না দেয়—তা হলে গাজায় একমাত্র জিনিস প্রবেশ করবে আর তা হলো, বিমানবাহিনী থেকে কয়েক শ টন বিস্ফোরক, এক আউন্স মানবিক সাহায্য তারা পাবে না।’ মোখিবার ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির একজন এমপি গ্যালিট ডিস্টেল অ্যাটবারিয়ানের কথা উল্লেখ করতে পারেন, যিনি গাজাকে ‘পৃথিবীর মুখ থেকে মুছে ফেলার’ আহ্বান জানিয়েছিলেন।
গণহত্যা একটি শব্দ, যা সাবধানে ব্যবহার করা উচিত। শব্দটির একটি আইনি সংজ্ঞা, একটি আইনি ভিত্তি এবং আইনি প্রভাব রয়েছে। সে জন্য, যখন এই ক্ষেত্রের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আমাদের গণহত্যা সম্পর্কে সতর্ক করেন, তখন আমাদের উঠে বসে শোনা উচিত। আর সে কারণেই আমাদের অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দরকার, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জরুরি তদন্তের পর।
আইসিসির উচিত শুধু গণহত্যার অপরাধে নয়, গত মাসে সব পক্ষের দ্বারা সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা। এই তদন্তের আহ্বান জানানোর ক্ষমতা ও দায়িত্ব যুক্তরাজ্য সরকারের রয়েছে। গাজায় ব্ল্যাকআউট সাময়িক হতে পারে, কিন্তু দায়মুক্তি স্থায়ী এবং আমাদের সরকার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অন্ধকারে তার অপরাধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়ে চলেছে।
যুদ্ধবিরতি আনতে যত দিন লাগবে আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাব, জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে, গাজা অবরোধ বন্ধ করতে, আর দখলদারির অবসান ঘটাতে। আমরা এই দাবিগুলো করি, কারণ আমরা জানি কী ঝুঁকিতে রয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণের কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও দয়া।
আমার মনে আছে, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমরা একটি খাদ্য-উৎপাদন প্রকল্প অতিক্রম করেছিলাম। প্রকল্পটি সাবেক ইসরায়েলি বসতির ৫০ হেক্টর জমি কিনেছিল। পরে তারা চলে গেছে। আর তাদের সব ভবন ধ্বংস করে গেছে। এই ধ্বংসাবশেষের ওপর ফিলিস্তিনিরা একটি সমবায় খামার তৈরি করেছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, শিগগির সেখানে জলপাই ও অন্যান্য ফল উৎপাদন করা হবে।
আমি এই জলপাই আর ফল জন্মানোর আশা ছেড়ে দেব না। গাজার মানুষ আমাকে তাদের আনন্দ, সহানুভূতি এবং মানবতা দেখিয়ে দিয়েছে। আশা করি, আমি একদিন তাদের সব ফিরিয়ে দিতে পারব—একটি মুক্ত ও স্বাধীন ফিলিস্তিনে।
(আল-জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
আল-শাতি শরণার্থীশিবিরে আমি শেষবার গিয়েছিলাম ২০১৩ সালের প্রথম দিকে। গাজার উত্তরে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত শরণার্থীশিবিরটি ‘বিচ ক্যাম্প’ নামে পরিচিত ছিল। সেখানে ফল ব্যবসায়ীরা নানা রঙের ছাতার নিচে বসে ফল বিক্রি করতেন। বিড়ালগুলো সরু গলির মাঝখানে ঘুমাত। শিশুরা দড়িলাফসহ নানা ধরনের খেলাধুলা করত।
নাকবাতে সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর করে বাস্তুচ্যুত করার পর ১৯৪৮ সালে বিচ ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে শিবিরে প্রায় ২৩ হাজার শরণার্থীকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সাত দশকে এই সংখ্যা ৯০ হাজারে পৌঁছায়। মাত্র শূন্য দশমিক ২ বর্গমাইল জায়গার মধ্যে এত মানুষ থাকত।
গাজার জনগণ ১৬ বছর ধরে অবরোধের মধ্যে বসবাস করছে। ইসরায়েল দখলদারি বজায় রাখতে গাজার ভেতরে ও বাইরে যা আছে এর বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিচ ক্যাম্পও আলাদা কিছু ছিল না। সেখানকার লোকেরা বেঁচে থাকার জন্য ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সির সাহায্য এবং পরিষেবার ওপর নির্ভর করত। এসব পরিষেবার মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র এবং বেশ কয়েকটি স্কুল ভবন ছিল।
বিচ ক্যাম্পের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। আমাকে স্কুলটির ছাদে উঠতে দেওয়া হয়েছিল, যেখান থেকে আমি একপাশে ইসরায়েলের বেড়া দেখতে পেয়েছিলাম। সমুদ্রে বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি টহল নৌকা দেখেছিলাম। পরে জেনেছি, এসব নৌকা ফিলিস্তিনি জেলেদের ছয় নটিক্যাল মাইলের বেশি যেতে দিত না।
স্কুলটি চালাতেন কয়েকজন অনুপ্রেরণাদায়ী ও কঠোর পরিশ্রমী শিক্ষক, যাঁদের দর্শন ছিল আবিষ্কার, সংগীত, থিয়েটার এবং শিল্পের জন্য একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করা। কয়েকজন ছাত্র আমাকে তাদের কাজ দেখিয়েছিল। তাদের ড্রয়িং খাতায় অনেক বিমান, বেড়া ও বোমার ছবি আঁকা ছিল। তবে অন্যান্য জিনিসও তারা এঁকেছিল: তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন ও বন্ধুদের ছবি। স্পষ্টতই, সব শিশু ট্রমায় ভুগছিল, তবে তাদের শেখার, ভাগ করে নেওয়া এবং খেলার ইচ্ছাও ছিল।
দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলার দুই দিন পর গত ৯ অক্টোবর বিচ ক্যাম্পে ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর পাওয়া যায়। তবে বিচ ক্যাম্পে এটাই প্রথম হামলা ছিল না। ২০২১ সালের মে মাসে এই ক্যাম্পে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে আটজনই ছিল শিশু। শুধু ৯ অক্টোবরই নয়, তিন সপ্তাহে বিচ ক্যাম্পকে বারবার লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরায়েলি সেনারা।
যখন আমি গাজায় বোমা হামলার খবর শুনি, তখন বিচ ক্যাম্পের সেই স্কুলের কথা ভাবি। আমি জানি না এটি এখনো আছে কি না। আমি জানি না, ওই শিশু ও শিক্ষকেরা বেঁচে আছেন কি না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২৩ লাখ জনসংখ্যার এই ছোট্ট উপত্যকায় ২৫ হাজার টন বোমা ফেলেছে। তারা বেসামরিক মৃত্যু এড়াতে চেষ্টা করছে তা কিন্তু নয়। গাজায় ইতিমধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার।
যারা বেঁচে আছে, তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক জিনিস—পানি, জ্বালানি, খাদ্য এবং চিকিৎসা সবই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার করছেন চিকিৎসকেরা। মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের বিদ্যুৎ ফুরিয়ে যাওয়া ইনকিউবেটরে বেঁচে থাকার লড়াই দেখছেন। মানুষ বাধ্য হচ্ছে সমুদ্রের পানি পান করতে। ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
তবে ইসরায়েলে চালানো হামাসের হামলারও নিন্দা জানানো উচিত। ওই হামলায় ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নিহত হন। একটি গানের কনসার্টে ওই হামলা চালানো হয়। যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা সবাই সেখানে গান শুনতে গিয়েছিলেন। তাঁরা জুয়েলারি ডিজাইনার। তাঁরা কারখানার শ্রমিক। তাঁরা শান্তির প্রচারক। তাঁদের পরিবার যে কষ্ট ও যন্ত্রণা অনুভব করছে তা চিরকাল থাকবে।
তবে এ ঘটনা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণকে ন্যায্যতা দিতে পারে না; যা তারা করেনি এমন জঘন্য অপরাধের জন্য শাস্তি পাচ্ছে। আমাদের শান্তির জন্য কণ্ঠস্বর দরকার। উল্টো বিশ্বব্যাপী রাজনীতিবিদেরা ইসরায়েলি সরকারকে আত্মরক্ষার নামে ফিলিস্তিনি জনগণকে অনাহারে রাখার ও হত্যা করার সবুজ সংকেত দিয়ে চলেছেন।
গাজার প্রতিটি মানুষের একটি নাম ও একটি মুখ আছে; আমরা ইনকিউবেটরে শিশুদের জন্য যেমন গভীরভাবে শোক করি, ঠিক তেমনি মধ্যবয়সী পুরুষদের জন্য শোক করি, যাঁরা রাস্তা পার হতে গিয়ে নিহত হন। যা-ই হোক না কেন, আমরা সুন্দর, সৃজনশীল জীবন চুরির শোক করছি। শিল্পী, যাঁদের আঁকা আমরা কোনো দিন দেখব না। গায়ক, যাঁদের গান আমরা কখনো আর শুনব না। লেখক, যাঁদের বই আমরা কখনোই পড়ব না। রাঁধুনি, যাঁদের বানানো কুনাফা আমরা কখনোই খাব না। শিক্ষক, যাঁদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষাই আমরা কখনো পাব না।
আমরা শুধু গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছি না। আমরা একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতি, একটি পরিচয় এবং একটি জাতিকে মুছে ফেলা দেখছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিভিন্ন মানদণ্ড অনুযায়ী গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করেন। গণহত্যা মানে শুধু গণহারে মানুষ হত্যা নয়। গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া বা জোর করে শিশুদের স্থানান্তর করাও গণহত্যা বলে বিবেচিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে, একটি নির্দিষ্ট জাতিকে বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
২ নভেম্বর জাতিসংঘের সাতজন বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার বলেছেন, ‘তাঁরা নিশ্চিত যে ফিলিস্তিনি জনগণ গণহত্যার গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে।’ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অফিসের পরিচালক ক্রেগ মোখিবারের পদত্যাগের পর ওই সাতজন র্যাপোর্টিয়ার এ মন্তব্য করেন। ক্রেগ মোখিবার গাজার ভয়াবহতাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মোখিবার নিজের পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, আরব জাতি হওয়ায় ফিলিস্তিনি জনগণকে পাইকারি হারে হত্যা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পশ্চিম তীরে ক্রমাগত বাড়িঘর দখল করা হচ্ছে। তিনি ইসরায়েলি সরকার ও সেনাবাহিনীর নেতাদের উদ্দেশ্যের সুস্পষ্ট বিবৃতি তুলে ধরেন।
তবে ক্রেগ মোখিবার একটি বিষয় উল্লেখ করেননি। তিনি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের কথা উল্লেখ করতে পারতেন, যিনি পোস্ট করেছিলেন যে ‘যতক্ষণ হামাস তার হাতে জিম্মিদের মুক্তি না দেয়—তা হলে গাজায় একমাত্র জিনিস প্রবেশ করবে আর তা হলো, বিমানবাহিনী থেকে কয়েক শ টন বিস্ফোরক, এক আউন্স মানবিক সাহায্য তারা পাবে না।’ মোখিবার ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির একজন এমপি গ্যালিট ডিস্টেল অ্যাটবারিয়ানের কথা উল্লেখ করতে পারেন, যিনি গাজাকে ‘পৃথিবীর মুখ থেকে মুছে ফেলার’ আহ্বান জানিয়েছিলেন।
গণহত্যা একটি শব্দ, যা সাবধানে ব্যবহার করা উচিত। শব্দটির একটি আইনি সংজ্ঞা, একটি আইনি ভিত্তি এবং আইনি প্রভাব রয়েছে। সে জন্য, যখন এই ক্ষেত্রের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আমাদের গণহত্যা সম্পর্কে সতর্ক করেন, তখন আমাদের উঠে বসে শোনা উচিত। আর সে কারণেই আমাদের অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দরকার, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জরুরি তদন্তের পর।
আইসিসির উচিত শুধু গণহত্যার অপরাধে নয়, গত মাসে সব পক্ষের দ্বারা সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা। এই তদন্তের আহ্বান জানানোর ক্ষমতা ও দায়িত্ব যুক্তরাজ্য সরকারের রয়েছে। গাজায় ব্ল্যাকআউট সাময়িক হতে পারে, কিন্তু দায়মুক্তি স্থায়ী এবং আমাদের সরকার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অন্ধকারে তার অপরাধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়ে চলেছে।
যুদ্ধবিরতি আনতে যত দিন লাগবে আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাব, জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে, গাজা অবরোধ বন্ধ করতে, আর দখলদারির অবসান ঘটাতে। আমরা এই দাবিগুলো করি, কারণ আমরা জানি কী ঝুঁকিতে রয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণের কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও দয়া।
আমার মনে আছে, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমরা একটি খাদ্য-উৎপাদন প্রকল্প অতিক্রম করেছিলাম। প্রকল্পটি সাবেক ইসরায়েলি বসতির ৫০ হেক্টর জমি কিনেছিল। পরে তারা চলে গেছে। আর তাদের সব ভবন ধ্বংস করে গেছে। এই ধ্বংসাবশেষের ওপর ফিলিস্তিনিরা একটি সমবায় খামার তৈরি করেছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, শিগগির সেখানে জলপাই ও অন্যান্য ফল উৎপাদন করা হবে।
আমি এই জলপাই আর ফল জন্মানোর আশা ছেড়ে দেব না। গাজার মানুষ আমাকে তাদের আনন্দ, সহানুভূতি এবং মানবতা দেখিয়ে দিয়েছে। আশা করি, আমি একদিন তাদের সব ফিরিয়ে দিতে পারব—একটি মুক্ত ও স্বাধীন ফিলিস্তিনে।
(আল-জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে