ড. মইনুল ইসলাম
গত ১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে দেশের অর্থনীতি এখন সংকট কাটিয়ে উঠছে। তিনি একটু আগেভাগে এই দাবি করে ফেলেছেন মনে হচ্ছে। তাঁর এই দাবি অনেকের কাছে স্বস্তিকর মনে হলেও দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো এখনো বেশ জটিল রয়ে গেছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে রয়েছে, সেগুলো হলো:
১. আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ বিলিয়ন ডলারে এবং নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা এখনো থামাতে পারেনি সরকার।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দুই বছরে ডলারের দাম হুহু করে বেড়ে ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে এক ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১০-১১২ টাকা। এর মানে, এ দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ২৮ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হওয়া। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের বছরের তুলনীয় মাসগুলোর চাইতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও ২০২৪ সালের মার্চে ঈদুল ফিতর সামনে রেখে আবার রেমিট্যান্স কমে গেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।
৪. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে গিয়ে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য, রপ্তানি আয়ের প্রবাহে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কিছুটা স্বস্তি মিলছে। ২০২৪ সালের মার্চে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
৫. আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এই চার প্রধান অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোতে ‘বেগমপাড়া’ এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯.৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি।
ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সমস্যাগুলো এখনো অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানো, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল, সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ব্যাংকের প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইতিমধ্যে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণে পরিণত হলেও রাঘববোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নানা রকম অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার সুবন্দোবস্ত করে চলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যার ফলে দেশের সুপরিচিত বড় বড় ঋণখেলাপি প্রায় সবাই এখন ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। অথচ গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে বিন্দুমাত্র কোনো সফলতা অর্জিত হয়নি। দ্বিতীয় যে নজির উল্লেখ করা যায় সেটি হলো, ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচারকৃত পুঁজি দেশে ফেরত নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা সাবেক অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন, তার মাধ্যমে পরবর্তী অর্থবছরে একটি কানাকড়িও দেশে ফেরত আসেনি। অথচ তার জন্য সাবেক অর্থমন্ত্রী জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার প্রয়োজন বোধ করেননি।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে ২৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, তার পরিবর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমান অর্থবছরে ৫.৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ ঘোষণা করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয় বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য গিনি সহগ (বা জিনি সহগ) সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত পরিমাপক। কোনো অর্থনীতির গিনি সহগ যখন বেড়ে ০.৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে, তখন ওই দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে। নতুন অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী ভাবছেন?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
গত ১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে দেশের অর্থনীতি এখন সংকট কাটিয়ে উঠছে। তিনি একটু আগেভাগে এই দাবি করে ফেলেছেন মনে হচ্ছে। তাঁর এই দাবি অনেকের কাছে স্বস্তিকর মনে হলেও দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো এখনো বেশ জটিল রয়ে গেছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মারাত্মক সংকটে রয়েছে, সেগুলো হলো:
১. আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ বিলিয়ন ডলারে এবং নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের যে ধারা আমাদের অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা এখনো থামাতে পারেনি সরকার।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে এক ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। গত দুই বছরে ডলারের দাম হুহু করে বেড়ে ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারে এক ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১০-১১২ টাকা। এর মানে, এ দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ২৮ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হওয়া। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের বছরের তুলনীয় মাসগুলোর চাইতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও ২০২৪ সালের মার্চে ঈদুল ফিতর সামনে রেখে আবার রেমিট্যান্স কমে গেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।
৪. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে গিয়ে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য, রপ্তানি আয়ের প্রবাহে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কিছুটা স্বস্তি মিলছে। ২০২৪ সালের মার্চে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
৫. আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এই চার প্রধান অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোতে ‘বেগমপাড়া’ এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯.৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি।
ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সমস্যাগুলো এখনো অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানো, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল, সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, ব্যাংকের প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ইতিমধ্যে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণে পরিণত হলেও রাঘববোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নানা রকম অযৌক্তিক ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার সুবন্দোবস্ত করে চলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যার ফলে দেশের সুপরিচিত বড় বড় ঋণখেলাপি প্রায় সবাই এখন ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। অথচ গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে বিন্দুমাত্র কোনো সফলতা অর্জিত হয়নি। দ্বিতীয় যে নজির উল্লেখ করা যায় সেটি হলো, ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচারকৃত পুঁজি দেশে ফেরত নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা সাবেক অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন, তার মাধ্যমে পরবর্তী অর্থবছরে একটি কানাকড়িও দেশে ফেরত আসেনি। অথচ তার জন্য সাবেক অর্থমন্ত্রী জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার প্রয়োজন বোধ করেননি।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে ২৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, তার পরিবর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমান অর্থবছরে ৫.৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ ঘোষণা করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয় বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য গিনি সহগ (বা জিনি সহগ) সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত পরিমাপক। কোনো অর্থনীতির গিনি সহগ যখন বেড়ে ০.৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে, তখন ওই দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে। নতুন অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী ভাবছেন?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে