রঙিন মাছের কারিগর

শাইখ সিরাজ
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২২, ১১: ১৭

ইতিহাস বলে রঙিন মাছ বা অ্যাকোরিয়াম ফিশের বাণিজ্যিক চাষের শুরুটা অনেক আগে, চীন দেশে। সেই ৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে চীনের ‘সং ডিনেস্টি’ পিরিয়ডে ধনীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রঙিন মাছ। যার পরিপ্রেক্ষিতে চীনে ৯৬৮-৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রঙিন মাছ খাওয়ার ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১১৩৬ সালে সম্রাট হিয়াউ সাং গোল্ডফিশের ব্রিডিং শুরু করেন। ১৫১০ সালের দিকে রঙিন মাছের এই শৌখিনতা শুধু ধনীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সাধারণ মানুষও অ্যাকোরিয়ামে রঙিন মাছ রাখতে শুরু করে। এরপর এই শৌখিনতা ছড়িয়ে পড়ে জাপানে। ইউরোপের দেশ হিসেবে প্রথম পর্তুগালে রঙিন মাছের চাহিদা দেখা যায় ১৬৯১ সালে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে।

একটা জার্নালে মৎস্য অধিদপ্তরের বরাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রঙিন মাছ বা অ্যাকোরিয়াম ফিশের যাত্রা শুরু ১৯৫৩ সালে। কিন্তু এ দেশে রঙিন মাছ জনপ্রিয় হতে শুরু করে স্বাধীনতার পরে। আগে বড় বড় হোটেলে অ্যাকোরিয়ামে রঙিন মাছ রাখা হতো। তবে গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্তরাও প্রেমে পড়ে শৌখিন মাছের। মনে আছে ১৯৮৫ সালের দিকে বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে শৌখিন মাছ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। তখন থেকেই ধীরে ধীরে রাজধানীর কাঁটাবনে গড়ে উঠছিল শৌখিন মাছের বিশাল বাজার। তারপর সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ থাকেনি রঙিন মাছের চাহিদা। মধ্যবিত্তের ঘরেও ঢুকে যায় কাচের পাত্রে রাখা সোনালি মাছের বিলাস। তবে এই বিলাসের রসদ ছিল সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। যাঁদের হাত ধরে এ দেশে রঙিন মাছের উৎপাদন শুরু, তাঁদের একজন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবঙ্গ গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী।

২০১৮ সালের মার্চে সাইফুল্লাহ গাজীর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি সাইফুল্লাহ গাজীকে বলি ‘রঙিন মাছের কারিগর’। একেবারে সাদাসিধে একজন মানুষ। অথচ কত রঙিন স্বপ্ন বুকের ভেতর লালন করে শুরু করেছেন বর্ণিল এক বিপ্লব!

সাইফুল্লাহ গাজীর জীবনের গল্পটা যেন সিনেমার মতো। ১৯৯৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগেই অভাবের তাড়নায় ভাগ্যের সন্ধানে নামতে হয় তাঁকে। চলে যান ভারতে। সেখানে এক তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। একদিন ছুটির দিনে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পান একটা এলাকায় ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইন। কৌতূহল জন্মে তাঁর। কেন সেখানে প্রবেশ করা যাবে না? কী হয় সেখানে? কৌতূহল থেকেই সেখানকার একজনের সঙ্গে গড়ে তোলেন বন্ধুত্ব। তারপর ভেতরে গিয়ে অবাক বনে যান, সে তো রঙিন মাছের ভুবন! ধীরে ধীরে সেই বন্ধুর কাছ থেকেই শিখে নেন কীভাবে রঙিন মাছ ব্রিড করতে হয়। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে ভারত থেকে ফিরে আসেন দেশে। অভাব তখনো তাড়া করে ফিরছে। ঢাকায় এসে কাজ শুরু করলেন তৈরি পোশাক কারখানায়। অল্প বেতনের চাকরিতে সংসার চালানো কঠিন। তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদে চালিয়ে যেতে থাকলেন জীবিকার সংগ্রাম। কারখানায় যেতে-আসতে চোখে পড়ে একটি রঙিন মাছের দোকান। শাইখ সিরাজরঙিন মাছের নেশা তাঁর মগজে তখনো প্রোথিত। খেয়াল করলেন প্রায়ই দোকানটা বন্ধ থাকে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, মাছ আসে দেশের বাইরে থেকে। মাছ আসতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই মাছ না এলে দোকান বন্ধ থাকে। সাইফুল্লাহ তখন জানালেন, তিনি জানেন রঙিন মাছ থেকে কীভাবে বাচ্চা ফোটায়, জানেন এর প্রজনন-প্রক্রিয়া। ২০০৪ সালের কথা। ৬২৫ টাকা পুঁজি করে নেমে গেলেন রঙিন মাছের ভুবনে। গ্রামে ফিরে একটা চৌবাচ্চায় শুরু করলেন রঙিন মাছের ব্রিডিং। সেই রঙিন মাছই রাঙিয়ে দিল তাঁর জীবন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এক দশকে ৬২৫ টাকার রঙিন মাছ সংসার খরচ বাদে গিয়ে দাঁড়াল অর্ধকোটিতে। যেন এক সোনার ডিমপাড়া হাঁসের গল্প। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। রঙিন মাছ সাইফুল্লাহ গাজীর কাছে সোনার ডিমপাড়া হাঁস।

সাইফুল্লাহ গাজীর শৌখিন মাছের প্রজনন কার্যক্রম আর চৌবাচ্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কার্যক্রম পৌঁছে গেছে ২০টি পুকুরে এবং ৮৮টি হাউসে ২৬ প্রজাতির মাছ উৎপাদনে। বড় বড় পুকুরে জাল ফেলছে আর সেই জালে রুই, কাতলা, মৃগেলের পরিবর্তে উঠছে শৌখিন রঙিন সব মাছ। বড় মনোরম সে দৃশ্য! বলা যায়, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সাইফুল্লাহ। খাওয়ার মাছের মতোই লালনপালন করছেন শৌখিন মাছ। যেগুলো খাওয়ার মাছের চেয়ে বহুগুণ দামি।

সাইফুল্লাহ গাজী গড়ে তুলেছেন মাছের হ্যাচারিও। সাইফুল্লাহ চান তাঁর মতোই ভাগ্য বদলে যাক সব প্রান্তিক মানুষের। তাই শুধু শৌখিন মাছ লালনপালন করে তিনি রেণু পোনা তৈরিই করছেন না, জাত নিয়েও চলছে তাঁর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা; বিশেষ করে মাছের রং ও কিছু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতেও চালিয়েছেন নানামুখী চেষ্টা। সাইফুল্লাহ গাজী আজ এলাকার মানুষের কাছে সাফল্যের এক উদাহরণ। শৌখিন মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এলাকার মানুষের মুখে মুখে জেগেছে নতুন সাড়া। শুধু নিজের ভাগ্যই পরিবর্তন করেননি সাইফুল্লাহ, তাঁর এখানে কাজ করছেন অর্ধশত শ্রমিক।

রঙিন মাছের আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের একটা প্রতিবেদন থেকে। তারা বলছে, এই সময়ে সারা বিশ্বে রঙিন মাছের বাজার ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০৩০ সালের মধ্যে রঙিন মাছের বাজারের আকার বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বের কথা রেখে দেশের কথাই যদি বলি, বর্তমানে রঙিন মাছের দেশের বাজার হচ্ছে ৬০০ কোটি টাকার। এই বাজারের অর্ধেকও আমরা নিজেদের উৎপাদিত মাছ দিয়ে পূরণ করতে পারছি না। দেশের বাইরে থেকে মাছ এনে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। ফলে এ খাত এখনো যথেষ্ট সম্ভাবনাময়।

বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। সামগ্রিকভাবে কৃষির এমন কোনো চর্চা নেই, যা এ দেশে সম্ভব নয়। একটু বুদ্ধি করে যেখানে হাত দেওয়া যায়, সেখানেই সোনা ফলে। শুধু পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার অপেক্ষা। সাফল্য যেন সবখানেই হাতছানি দিচ্ছে। সাতক্ষীরার সাইফুল্লাহ গাজী অ্যাকোরিয়াম ফিশ বা শৌখিন মাছ উৎপাদনে যে বিস্ময়কর সাফল্যের নজির সৃষ্টি করেছেন, তা প্রচলিত কিছু নয়, একেবারেই অপ্রচলিত ও উদ্ভাবনী এক উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে অনুসরণ করে দেশের বহু বেকার তরুণ খুঁজে নিতে পারেন নতুন এক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। কারণ, বাড়ির আঙিনায় ছোট্ট পরিসরেই একটি হাউস তৈরি করে শৌখিন মাছের খামার গড়ে তোলা সম্ভব। আর এখান থেকেই তা বিস্তৃত করা সম্ভব বড় পুকুরে। শৌখিন মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল সাফল্যের দিকে। এই শিল্পের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হলে অল্প দিনেই বাইরে থেকে শৌখিন মাছ আর আনার প্রয়োজন পড়বে না, একইভাবে সম্ভব হবে বিদেশে রপ্তানি করাও।

লেখক: শাইখ সিরাজ, রিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত