বিভুরঞ্জন সরকার
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে, এই তথ্য পাকিস্তানিদের কাছে থাকলে নির্বাচনটি নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের যথেষ্ট কারণ আছে। আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অনীহার বিষয়টি রাজনীতিসচেতন মহলে খুব অস্পষ্ট ছিল বলে
মনে হয় না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ভালো করবে কিন্তু সেটা যে সরকার গঠনের মতো ভালো হবে, সেটা বুঝতে পারলে নির্বাচন ভণ্ডুল করার ব্যবস্থা হয়তো করা হতো।
আমরা যারা তখন ছাত্র আন্দোলনের তরুণ কর্মী, কিন্তু আওয়ামী লীগ করিনি, তারা তো দূরের কথা, আমাদের অনেক নেতার কাছেও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়ের বিষয়টি খুব বিবেচনায় ছিল বলে আমার অন্তত মনে হয়নি। যাঁরা আওয়ামী লীগ করতেন, তাঁরা হয়তো জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, তবে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে মাত্র দুটি আসন ছাড়া বাকি সব আসন আওয়ামী লীগের দখলে যাবে, এতটা হয়তো তাঁরাও আশা করেননি। প্রসঙ্গত, কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলা যেতে পারে। আমার নিজের নির্বাচনী এলাকা পঞ্চগড়ে আওয়ামী লীগ ছাড়াও একাধিক প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে অন্য প্রার্থীরা হয়তো অধিক যোগ্যতরও ছিলেন। আমরা ছিলাম ন্যাপের প্রার্থী অ্যাডভোকেট গোলাম রহমানের পক্ষে। তিনি ছিলেন একজন ঝানু আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। সে জন্য স্বাভাবিকভাবে আমাদের কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। আমরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে বলিনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থাও আমাদের এলাকায় ন্যাপের চেয়ে ভালো ছিল না। তবে নির্বাচনী প্রচারের সময়ই আমরা টের পেয়েছিলাম
যে নৌকার পক্ষে একটি স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ার তৈরি হয়েছে। মানুষ প্রার্থী দেখে নয়, মার্কা দেখে ভোট দিতে প্রস্তুত হয়েছে।
এখন আমার মনে হয়, কীভাবে সেই সময় এটা সম্ভব হয়েছিল? প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের মানুষ কীভাবে, কার আহ্বানে অমন করে নৌকার পেছনে কাতারবন্দী হয়েছিল? তখন তো এখনকার মতো আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। আমরা ন্যাপের পক্ষ থেকে কত পরিকল্পিতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। উঠোন বৈঠক, পাড়া বৈঠক, হাটসভা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা ন্যাপের বক্তব্য মানুষকে জানানোর চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগ এসবের কিছুই করেনি। তারপরও মানুষ ন্যাপের দিকে না ঝুঁকে আওয়ামী লীগের দিকেই ঝুঁকেছে।
এত বছর পরে সত্তরের নির্বাচনের ফল নিয়ে ভাবতে বসে মনে হচ্ছে, আমরা আওয়ামী লীগ না করলেও মনে মনে হয়তো আওয়ামী লীগের জয়ই প্রত্যাশা করেছিলাম। সে জন্যই আমাদের প্রার্থীর পরাজয় এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় আমাদের অনেককেই অখুশি না করে উৎফুল্ল করেছিল। আমরা যেন মনে মনে চাইছিলাম, আমাদের এলাকায় আমাদের প্রার্থী জিতুক আর সারা দেশে জিতুক আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমাদের প্রার্থীর ছোট ভাই মোহাম্মদ সুলতান, যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির কট্টর সমালোচক এবং ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের প্রতিও যাঁর বীতরাগ গোপন ছিল না, তিনিও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছিলেন এই বলে যে শেখ মুজিব যদি ক্ষমতায় গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, তাহলে কমিউনিস্টরা মুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। কমিউনিস্ট বলতে তিনি তখন মস্কো এবং পিকিংপন্থী—দুই গ্রুপকেই বুঝিয়েছিলেন কি না, সে প্রশ্ন তখন অবশ্য করা হয়নি। তবে তিনি ছিলেন পিকিংপন্থী এবং মস্কো লাইনের ঘোরতর বিরোধী।
মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি। বায়ান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখেই জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের। এ দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পাশাপাশি বাম-প্রগতিশীল চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান একক সংগঠন হিসেবে সবচেয়ে বেশি। মোহাম্মদ সুলতানের আরেকটি বড় কীর্তি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রকাশক ছিলেন তিনি। এই সংকলনের রাজনৈতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম। সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে, বিশেষ করে চীনপন্থার অনুসারী হয়ে মোহাম্মদ সুলতান তাঁর মেধার অপচয় ঘটিয়েছেন কি? প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হলেও সাধারণ মানুষের মন-মেজাজ বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল বলেই কি তিনি রাজনীতির মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছিলেন?
সত্তরের নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মোহাম্মদ সুলতানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি একটু চিন্তিত হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব যতটুকু বুঝি, তাতে এটা জোর দিয়েই বলতে পারি যে তারা আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা ছাড়বে না। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টো খুব খারাপ মানুষ। ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিলে তিনি শেষ পর্যন্ত কী করবেন বুঝতে পারছি না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় যেতে হলে সশস্ত্র পথেই যেতে হবে।
মোহাম্মদ সুলতানের কথা তখন আমার খুব পছন্দ হয়নি। ভোটে জেতা দলকে আবার ক্ষমতার বাইরে রাখা যায় নাকি? মোহাম্মদ সুলতান নিজে সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতির পক্ষে বলেই হয়তো তাঁর মাথায় সশস্ত্র উপায়ের কথা ঘুরছে। কিন্তু তিন মাস যেতে না-যেতেই নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমাদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পথে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন, যার যা আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন, তবুও এটা এখন স্বীকার করতেই হবে যে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার প্রস্তুতি আসলে কারোরই ছিল না—না রাজনৈতিক নেতৃত্বের, না জনসাধারণের। সত্তরের নির্বাচনে যাঁরা আওয়ামী লীগকে, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন তাঁরাও সবাই নিশ্চয়ই পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে ছিলেন না। থাকলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু বিজয়ের ধারায় থাকতে পারিনি। এর বড় কারণ হয়তো এটাই, স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক এবং মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটা আমাদের ছিল না।
দেশে আবারও একটি নির্বাচন আসছে। ওই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেও বিএনপি আছে এক দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য সরকারের ওপর আমেরিকাসহ কিছু পশ্চিমা দেশের চাপ থাকলেও নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো চাপের কথা শোনা যায় না। সেই জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও আওয়ামী লীগের চাওয়া একই—অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
অন্যদিকে বিদেশি দূতাবাসে ঘন ঘন যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হঠাৎ সেদিন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারত কী বলল, এটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমাদের দরকার, আমাদের মানুষ কী বলে। মানুষ খুব পরিষ্কার করে বলছে, বিদায় হও। আর সময় নেই। যেতে হবে। এই সরকারকে যেতেই হবে।’
সরকারকে যে যেতেই হবে, মানুষের এই বার্তা মির্জা ফখরুল কীভাবে পেয়েছেন? রাজপথে বিএনপির যে আন্দোলনের ভাব দেখা যাচ্ছে, তা কি খুব উৎসাহিত হওয়ার মতো? শুধু এক বা একাধিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে কখনো গণ-অভ্যুত্থান হয় না। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা ছাড়া গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার নজির নেই। গণ-অভ্যুত্থানের আকাশকুসুম কল্পনা বাদ নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারায় সবার আস্থা স্থাপনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ পক্ষে না থাকলে ভোট কারচুপি করে পার পাওয়া সহজ হয় না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে, এই তথ্য পাকিস্তানিদের কাছে থাকলে নির্বাচনটি নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের যথেষ্ট কারণ আছে। আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অনীহার বিষয়টি রাজনীতিসচেতন মহলে খুব অস্পষ্ট ছিল বলে
মনে হয় না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ভালো করবে কিন্তু সেটা যে সরকার গঠনের মতো ভালো হবে, সেটা বুঝতে পারলে নির্বাচন ভণ্ডুল করার ব্যবস্থা হয়তো করা হতো।
আমরা যারা তখন ছাত্র আন্দোলনের তরুণ কর্মী, কিন্তু আওয়ামী লীগ করিনি, তারা তো দূরের কথা, আমাদের অনেক নেতার কাছেও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়ের বিষয়টি খুব বিবেচনায় ছিল বলে আমার অন্তত মনে হয়নি। যাঁরা আওয়ামী লীগ করতেন, তাঁরা হয়তো জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, তবে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে মাত্র দুটি আসন ছাড়া বাকি সব আসন আওয়ামী লীগের দখলে যাবে, এতটা হয়তো তাঁরাও আশা করেননি। প্রসঙ্গত, কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলা যেতে পারে। আমার নিজের নির্বাচনী এলাকা পঞ্চগড়ে আওয়ামী লীগ ছাড়াও একাধিক প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে অন্য প্রার্থীরা হয়তো অধিক যোগ্যতরও ছিলেন। আমরা ছিলাম ন্যাপের প্রার্থী অ্যাডভোকেট গোলাম রহমানের পক্ষে। তিনি ছিলেন একজন ঝানু আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। সে জন্য স্বাভাবিকভাবে আমাদের কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। আমরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিতে বলিনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থাও আমাদের এলাকায় ন্যাপের চেয়ে ভালো ছিল না। তবে নির্বাচনী প্রচারের সময়ই আমরা টের পেয়েছিলাম
যে নৌকার পক্ষে একটি স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ার তৈরি হয়েছে। মানুষ প্রার্থী দেখে নয়, মার্কা দেখে ভোট দিতে প্রস্তুত হয়েছে।
এখন আমার মনে হয়, কীভাবে সেই সময় এটা সম্ভব হয়েছিল? প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের মানুষ কীভাবে, কার আহ্বানে অমন করে নৌকার পেছনে কাতারবন্দী হয়েছিল? তখন তো এখনকার মতো আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। আমরা ন্যাপের পক্ষ থেকে কত পরিকল্পিতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। উঠোন বৈঠক, পাড়া বৈঠক, হাটসভা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা ন্যাপের বক্তব্য মানুষকে জানানোর চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগ এসবের কিছুই করেনি। তারপরও মানুষ ন্যাপের দিকে না ঝুঁকে আওয়ামী লীগের দিকেই ঝুঁকেছে।
এত বছর পরে সত্তরের নির্বাচনের ফল নিয়ে ভাবতে বসে মনে হচ্ছে, আমরা আওয়ামী লীগ না করলেও মনে মনে হয়তো আওয়ামী লীগের জয়ই প্রত্যাশা করেছিলাম। সে জন্যই আমাদের প্রার্থীর পরাজয় এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় আমাদের অনেককেই অখুশি না করে উৎফুল্ল করেছিল। আমরা যেন মনে মনে চাইছিলাম, আমাদের এলাকায় আমাদের প্রার্থী জিতুক আর সারা দেশে জিতুক আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমাদের প্রার্থীর ছোট ভাই মোহাম্মদ সুলতান, যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির কট্টর সমালোচক এবং ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের প্রতিও যাঁর বীতরাগ গোপন ছিল না, তিনিও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছিলেন এই বলে যে শেখ মুজিব যদি ক্ষমতায় গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, তাহলে কমিউনিস্টরা মুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। কমিউনিস্ট বলতে তিনি তখন মস্কো এবং পিকিংপন্থী—দুই গ্রুপকেই বুঝিয়েছিলেন কি না, সে প্রশ্ন তখন অবশ্য করা হয়নি। তবে তিনি ছিলেন পিকিংপন্থী এবং মস্কো লাইনের ঘোরতর বিরোধী।
মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি। বায়ান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখেই জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের। এ দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পাশাপাশি বাম-প্রগতিশীল চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান একক সংগঠন হিসেবে সবচেয়ে বেশি। মোহাম্মদ সুলতানের আরেকটি বড় কীর্তি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রকাশক ছিলেন তিনি। এই সংকলনের রাজনৈতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক গুরুত্ব এককথায় অপরিসীম। সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে, বিশেষ করে চীনপন্থার অনুসারী হয়ে মোহাম্মদ সুলতান তাঁর মেধার অপচয় ঘটিয়েছেন কি? প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হলেও সাধারণ মানুষের মন-মেজাজ বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল বলেই কি তিনি রাজনীতির মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছিলেন?
সত্তরের নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মোহাম্মদ সুলতানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি একটু চিন্তিত হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব যতটুকু বুঝি, তাতে এটা জোর দিয়েই বলতে পারি যে তারা আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা ছাড়বে না। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টো খুব খারাপ মানুষ। ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিলে তিনি শেষ পর্যন্ত কী করবেন বুঝতে পারছি না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় যেতে হলে সশস্ত্র পথেই যেতে হবে।
মোহাম্মদ সুলতানের কথা তখন আমার খুব পছন্দ হয়নি। ভোটে জেতা দলকে আবার ক্ষমতার বাইরে রাখা যায় নাকি? মোহাম্মদ সুলতান নিজে সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতির পক্ষে বলেই হয়তো তাঁর মাথায় সশস্ত্র উপায়ের কথা ঘুরছে। কিন্তু তিন মাস যেতে না-যেতেই নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমাদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পথে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন, যার যা আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন, তবুও এটা এখন স্বীকার করতেই হবে যে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার প্রস্তুতি আসলে কারোরই ছিল না—না রাজনৈতিক নেতৃত্বের, না জনসাধারণের। সত্তরের নির্বাচনে যাঁরা আওয়ামী লীগকে, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন তাঁরাও সবাই নিশ্চয়ই পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে ছিলেন না। থাকলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু বিজয়ের ধারায় থাকতে পারিনি। এর বড় কারণ হয়তো এটাই, স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক এবং মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেটা আমাদের ছিল না।
দেশে আবারও একটি নির্বাচন আসছে। ওই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেও বিএনপি আছে এক দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য সরকারের ওপর আমেরিকাসহ কিছু পশ্চিমা দেশের চাপ থাকলেও নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো চাপের কথা শোনা যায় না। সেই জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও আওয়ামী লীগের চাওয়া একই—অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
অন্যদিকে বিদেশি দূতাবাসে ঘন ঘন যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হঠাৎ সেদিন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারত কী বলল, এটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমাদের দরকার, আমাদের মানুষ কী বলে। মানুষ খুব পরিষ্কার করে বলছে, বিদায় হও। আর সময় নেই। যেতে হবে। এই সরকারকে যেতেই হবে।’
সরকারকে যে যেতেই হবে, মানুষের এই বার্তা মির্জা ফখরুল কীভাবে পেয়েছেন? রাজপথে বিএনপির যে আন্দোলনের ভাব দেখা যাচ্ছে, তা কি খুব উৎসাহিত হওয়ার মতো? শুধু এক বা একাধিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে কখনো গণ-অভ্যুত্থান হয় না। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা ছাড়া গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার নজির নেই। গণ-অভ্যুত্থানের আকাশকুসুম কল্পনা বাদ নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারায় সবার আস্থা স্থাপনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ পক্ষে না থাকলে ভোট কারচুপি করে পার পাওয়া সহজ হয় না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে