নীতির প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতার নিষ্ঠুরতা

আফরিদা সামিহা নাবিলাহ্
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৭: ৫০

দরিদ্র ঘরে জন্ম নেওয়া আসমা। মায়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে রাজধানীর ভাষানটেক বস্তিতে। একদিন এলাকার পরিচিত বাড়ির কর্ত্রী আসমার মাকে বলেন, তাঁর বাড়ির কাজকর্মে সাহায্যের জন্য একজন কম বয়সী মেয়ের প্রয়োজন। অভাবের তাড়নায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে অপারগ মা, সংসারে কিছু আয় হওয়ার কথা ভেবে মেয়ে আসমাকে কাজে পাঠাতে রাজি হন। মাত্র ১১ বছরের আসমা নিজ বাসা ছেড়ে, অন্যের বাড়ির সব কাজ করতে শুরু করে।

কাজ শুরুর কিছুদিন পর থেকেই আসমা গৃহকর্তার আচরণে অনিরাপদ ও ভয় অনুভব করত। আসমা ঘুমিয়ে থাকলে গৃহকর্তা গায়ে হাত দেওয়ার মতো নানা রকম যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করতেন। স্বামীর আচরণ সম্পর্কে গৃহকর্ত্রীকে জানানো হলে তিনি আসমাকে চুপ থাকার নির্দেশ দেন। তবে গৃহকর্তার বাজে আচরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে, আসমা তার মাকে জানায়। আসমার মা গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি আসমাকে তার বাড়িতে আর কাজে রাখবেন না বলে জানিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে তিনি মেয়েকে নিয়ে আসেন। জীবিকার তাড়নায় আসমার মা এরূপ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মেয়ের যত্ন নিতে পারেননি; বরং অল্প কিছুদিনের মাথায় পুনরায় অন্য বাড়িতে কাজে পাঠিয়ে দেন।

আসমা ১৬ বছর বয়সে মায়ের ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করে নেন। তবে বিয়ের বিষয়ে তার মতামত কেউ জানতে চাননি। বছরখানেকের মধ্যে আসমা অন্তঃসত্ত্বা হয় এবং তখনো গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত ছিল। সন্তান প্রসবের কাছাকাছি সময়ে আসমা ভারী কাজ করতে অস্বস্তি অনুভব করার কারণে সপ্তাহখানেকের ছুটি চায়। তবে তার গৃহকর্ত্রী ছুটি নেওয়ার অনুমতি দেননি এবং ছুটি নিলে কাজ হারানোর আশঙ্কা আছে বলেন। এতে ভয় পেয়ে আসমা ছুটি ছাড়াই কাজ চালিয়ে যায়।

একদিন কাজের ফাঁকে আসমার মনে পড়ে সে এই বাড়িতে কাজ শুরু করার পর শুনেছে গৃহকর্ত্রী তার কর্মস্থল থেকে চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন। আসমা তখন ভাবে, কেবল অফিসে চাকরি করলেই এমন ছুটি পাওয়া যায়, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এ রকম ছুটি নিয়ে কেউ ভাবে না। কিন্তু আসমা জানে না যে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান [অনুচ্ছেদ ২৭] এবং সকল জবরদস্তি শ্রমও দণ্ডনীয় অপরাধ [অনুচ্ছেদ ৩৪]। 

উদ্বেগের বিষয় এই, গৃহকর্মীদের সমস্যার সমাধান, সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের দেশে কোনো বিশেষ আইন নেই। এমনকি, দেশের শ্রম আইনেও তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯৬১ সালে প্রণীত গৃহকর্মী নিবন্ধন অর্ডিন্যান্সে বাসায় কাজ করা কর্মীদের নিবন্ধনের কথা বলা হলেও, বাস্তবে এই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। ২০১৫ সালে প্রণীত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’ কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহান আরা হকের যৌথ রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট ওই নীতিকে ‘অসম্পূর্ণ’ ও ‘অস্পষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আসমার ঘটনার বিশ্লেষণ এই নীতিমালার অসম্পূর্ণতা উন্মোচিত করে। ১১ বছর বয়সে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করা আসমা নীতিমালায় নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের (হালকা কাজের ক্ষেত্রে ১২ বছর) চেয়ে কম। কিন্তু নীতিমালায় কম বয়সী শিশুদের নিয়োগের বৈধতা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। শ্রম আইনে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুদের নিয়োগকে শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য করা হলেও, গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কেন ১২ বছরকে সর্বনিম্ন বয়স ধরা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।

আসমার মতো বহু গৃহকর্মী প্রতিনিয়ত কাজের সময় নানা সহিংসতার শিকার হন। নীতিমালা অনুসারে, নিয়োগকর্তার কাছে যৌন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরা প্রচলিত আইনানুযায়ী বিচার পাবেন এবং সরকার তাঁদের মামলার খরচ বহন করবে। তবে এই অভিযোগ কোথায় করবেন, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশিকা নেই। শুধু একটি মনিটরিং সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে গৃহকর্মীরা টেলিফোন, মৌখিক বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন।

ওই মনিটরিং সেলের গঠন এবং কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের বক্তব্যে জানা যায়, কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল নীতিমালা বাস্তবায়ন তদারকির জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা উচিত এবং কমিটির পরিদর্শন টিমের কর্মতৎপরতাও নিশ্চিত করা উচিত। কেননা, নিষ্ক্রিয় সেল এবং টিমের ক্ষেত্রে নির্যাতিত গৃহকর্মীদের অভিযোগ দাখিল করা এবং বিচার পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া গৃহকর্মীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার কারণে তাঁদের পক্ষে প্রচলিত আইনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে বিচার চাওয়া অনেকটাই দুষ্কর। নীতিমালায় তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আদালত কিংবা সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া উল্লেখ থাকা জরুরি ছিল।

গৃহকর্ত্রী আসমাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জন্য কাজ থেকে বের করে দেন। নীতিমালা অনুসারে, গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে অপসারণের এক মাস আগে নোটিশ দিতে হবে এবং তাৎক্ষণিক বরখাস্তের ক্ষেত্রে এক মাসের অগ্রিম মজুরি দিতে হবে, যা আসমা পায়নি। তবে এই বিধি লঙ্ঘন করলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। 

নীতিমালায় উল্লেখ আছে, গৃহকর্মীরা বেতনের সুবিধাসহ ১৬ সপ্তাহের (প্রসবের আগে ৪ সপ্তাহ, পরে ১২ সপ্তাহ অথবা গৃহকর্মীর সুবিধা অনুসারে) প্রসূতিকালীন ছুটি পাবেন। এ ক্ষেত্রে আসমা এরূপ ছুটির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে নীতিমালায় এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া গৃহকর্মী কোন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানাবেন, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেওয়া নেই।

নীতিমালাটির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ—গৃহকর্মীদের ন্যূনতম মজুরি, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ও পদ্ধতি এবং তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। একই সঙ্গে নীতিমালার অবশিষ্ট বিধি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সরকারপক্ষ থেকে তৎপরতার অভাব লক্ষণীয়। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ-এর দায়ের করা জনস্বার্থ মামলায়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ মাসের মধ্যে নীতিমালা অনুযায়ী সারা দেশে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন মহামান্য হাইকোর্ট। এই নির্দেশনার অনুসরণ করে ওই সেল গঠনের মাধ্যমে কমিটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হলে তা গৃহকর্মীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষার জন্য আইনের দাবি বহুদিনের। আসমা দেশের অসংখ্য গৃহকর্মীর বর্তমান দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। হাইকোর্টের নির্দেশের আলোকে, নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। নীতিমালার অসম্পূর্ণতা দূর করে এটিকে আইনে রূপান্তরিত করাও জরুরি। গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং গৃহকর্মকে একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সময়ের দাবি। 

লেখক: আফরিদা সামিহা নাবিলাহ্, সহকারী গবেষক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ লেখায় উল্লিখিত আসমা চরিত্রটি কাল্পনিক।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত