জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও আমার রুশ-জীবনের গল্প

জাহীদ রেজা নূর
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২২, ১০: ০৫
আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২২, ১০: ৪৩

মন্ত্রীরা বেশ ভালো বোঝেন। ছুটির দিন কয়েকজন সাংবাদিককে ডেকে তিনি জানিয়ে দিতে পারেন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। এরপর যা হয়। সে খবর প্রকাশ পেলেই ফিলিং স্টেশনে হুড়োহুড়ি। অনেক ফিলিং স্টেশনের কর্মচারীরাই নির্বিকার। আপাতত তেল সরবরাহ করা হবে না। আদেশ হয়েছে, রাত ১২টার পর বাড়বে তেলের দাম; অর্থাৎ মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা অপেক্ষা করলেই যে দামে তেল কেনা হয়েছে, তা থেকে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা যাবে। এটাকে প্যারাডক্স বলব কি না, জানি না—কম দামে তেল কেনার জন্য ফিলিং স্টেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছে হাইব্রিড গাড়ি, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিসের মতো গাড়িগুলোও।

পরিবহন সেক্টরের মানুষেরা খেপে উঠেছেন তাতে। অবশ্য সেটা সাময়িক। তাঁরা সে রাতেই ধর্মঘটের মতো কিছু একটা করেছেন। আজিমপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত বাস ছিল বন্ধ। মধ্যরাতে রাস্তায় যানজট। জনগণ পরিবহনশ্রমিকদের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। পরিবহন সেক্টরের এই ধর্মঘট সাধারণ মানুষের স্বার্থে নয়। পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে কীভাবে জনগণের গলা কাটা যায়, তা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তারা এই তেজ দেখায়। তারপর যাত্রীদের কাছ থেকে সেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। গ্যাসের দাম বাড়লে তেলে চলা গাড়ি যেমন যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করে, তেমনি তেলের দাম বাড়লে গ্যাসচালিত বাসও বেশি ভাড়া কাটে। এগুলো দেখার কেউ নেই।

রাতের ঘুম দিয়ে সকালে উঠে কৃষকের মাথায় হাত। কখনোই তিনি তাঁর ফলানো ফসলের ন্যায্য দাম পান না। কিন্তু এবার তাঁর করণীয় কী, সেটা বুঝে উঠতে সময় লাগবে। সেচের জন্য ডিজেল প্রয়োজন তাঁর। সারের দাম বেড়েছে, এখন ডিজেলের দাম যেভাবে বাড়ল, তাতে উৎপাদন খরচ সামলে লাভের মুখ দেখা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

এ কথা আমাকে নতুন করে বলতে হবে না যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সবচেয়ে বড় শিকার হবে গরিব মানুষ। আমাদের দেশ উন্নয়নের মূল সড়কে উঠে সাঁই সাঁই করে সামনে এগিয়ে চলেছে বটে, কিন্তু সেই উন্নয়নের কতটা বহিরঙ্গের উন্নয়ন, কতটা সত্যিকারের উন্নয়ন, সে ভাবনা এখন অনেকের মনেই ঘুরতে শুরু করেছে। উন্নয়নের অর্থনীতিতে চুইয়ে পড়া অর্থনীতির সংযোগ আছে বলে ফাঁকটা চোখে পড়ে কম। নানা উন্নয়ন প্রকল্পে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ লাভবান হয়। আমাদের দেশে যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিকতা থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের একটা বৃহৎ অংশ যে আত্মসাৎ হয়ে যায়, এ রকম কথাও তো আমরা শুনি। আজ যার কিছুই ছিল না, কাল সে কোটিপতি কী করে হয়, সে অঙ্ক মেলাতে গিয়ে ধাঁধায় পড়ে যায় মানুষ। এই স্বল্পসংখ্যক কোটিপতির ভিড়ে দেশের কোটি কোটি কৃষক কোনোভাবে টিকে থাকেন। উন্নয়নের গল্প শোনেন।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অসহায় শিকার হবে মধ্যবিত্ত। সেই মধ্যবিত্ত, যে ধনী ও গরিবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীতিকথা আওড়ায়। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ উঠে আসেন যাদের মধ্য থেকে। যদিও বুদ্ধিজীবী কারা এবং এখনো বুদ্ধিজীবী আছেন কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে; প্রশ্ন উঠেছে দলীয় বুদ্ধিজীবীর বাইরে সত্যিই কি কেউ আছেন এখন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে যদি আমরা সাধারণ মধ্যবিত্তকে দেখি, তাহলে বুঝতে পারব, এই শ্রেণির টিকে থাকা খুবই মুশকিল হয়ে যাবে।

সংকটে পড়বেন চাকরিজীবীরা। যাঁরা স্বল্প বেতনে চাকরি করেন, তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলে সঞ্চয় তো দূরের কথা, খেয়ে-পরে বাঁচার চিন্তাটাই তো হারাম হয়ে যাবে। চাকরিদাতারা চেষ্টা করবেন চাকরিজীবীদের সমস্যাগুলো আলোচনায় না আনতে। আমাদের এখানে চাকরির সুযোগ এত কম যে কেউ একজন চাকরি ছাড়লে অন্যরা হাভাতের মতো সেই চাকরির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে চাকরিদাতার হাতেই থাকে সার্কাসের রিংটি। তিনিই খেলা দেখান। অন্যরা বাঁদর নাচ নাচতে বাধ্য হয়।

এই দুদিন বিভিন্ন পত্রিকায় অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞদের অনেক পরামর্শ পড়লাম। আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার বোধ হয় এমন পদক্ষেপ নিয়েছে—এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অনেকেই বলেছেন, এক লাফে যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা উচিত হয়নি। আমি বিশেষজ্ঞ নই। এ ব্যাপারে নিজের মতামত জানালে তা পাঠকের উপকারে লাগবে না। আমি শুধু আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছি। যদিও আমি মনে করি না, এ রকম কোনো দুর্বিষহ অবস্থা আমাদের হতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতাটা শোনা থাকলে সতর্ক হতে পারে মানুষ। আমি শ্রীলঙ্কা-প্রসঙ্গ এখানে টানছি না। বলছি সোভিয়েত ইউনিয়নে কাটিয়ে আসা শেষ দিনগুলোর কথা এবং গণতান্ত্রিক রাশিয়ায় বসবাসের ঘটনাগুলো।

জাহীদ রেজা নূরদুই
আশির দশকের মাঝামাঝি মিখাইল গরবাচেভের পিরিস্ত্রোইকা ও গ্লাসনোস্ত বিষয়ে সবাই জানেন। কিন্তু তাঁরই পথ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বরিস ইয়েলৎসিনের উত্থান, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের জন্ম, সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি হিসেবে রাশিয়ার আবির্ভাব ইত্যাদি ইতিহাসও পাঠকের অজানা নয়। তাই ফলাফলটা নিয়েই কথা বলা জরুরি। 
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রের হাতেই ছিল সর্বময় ক্ষমতা। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করত রাষ্ট্র। পরিবহন, জ্বালানি, যন্ত্রপাতির সরবরাহ থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল রাষ্ট্রের অধিকারে। সেখানেই নেমেছিল ধস। রাষ্ট্র তার অভিভাবকত্ব ধীরে ধীরে ছেড়ে দিতে শুরু করল। ওখানে মুদ্রাস্ফীতির যে বিশাল উল্লম্ফন ছিল, তা ছিল বহুদিনের বদ্ধ একটি সমাজের পরিবর্তন ও তার প্রতিক্রিয়ার। সেটা আমাদের মতো দেশে হয়তো ঘটবে না। কিন্তু তা শুনে রাখা দরকার।

বেড়ে গেল ডলারের দাম। রুবল হয়ে গেল কাগজের মতো। যাঁরা ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন, তাঁদের সেই টাকার অর্থমূল্য গেল কমে। সাড়ে তিন রুবল দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কেনা যেত ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৫ সালে এক কেজি গরুর মাংসের দাম দাঁড়িয়েছিল ১৮ হাজার রুবলে!

পড়াশোনার জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে যে বরাদ্দ ছিল, তা এতটাই কম ছিল যে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে শুধু মাস্টারি করে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ফেলে দেওয়া মদের বোতল কুড়িয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। সেই বোতলগুলো বিক্রি করে হয়তো সেদিনের রুটির ব্যবস্থা করতে পারবেন।

হঠাৎ করেই বাজার থেকে পণ্য হাওয়া হয়ে যেতে শুরু করল। চোরাবাজারে পাঁচ গুণ-দশ গুণ দামে তা বিক্রি হতে লাগল। সেখানে কি ক্রেতা নেই? আছে। কারা তারা? আর যা-ই হোক, প্রলেতারিয়েত বা বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণি নয়।

গরিব আর মধ্যবিত্তের জীবনে অশনিসংকেত এসে গ্রাস করল তাদের জীবনীশক্তি। কী করে তারা বাঁচবে, তার কূল-কিনারা পেল না। কেউ কেউ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গেল বেশি দামে কিছু বিক্রি করতে, উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করল যারা, তাদের মাথার ওপর আশীর্বাদ না থাকলে তাদের আম ও ছালা দুই-ই হারিয়ে গেল। যারা সেই আশীর্বাদ পেল, তারা কোনোভাবে বেঁচেবর্তে থাকল। আর বেশি আশকারা পেল যারা, তারা সঞ্চিত করল অর্থ। হয়ে উঠল পুঁজিপতি।

অন্যদিকে ছোট্ট একটি শ্রেণি জন্ম নিল, যারা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল অর্থনীতি। তারা সিঙ্গাপুর থেকে কম্পিউটার এনে বিক্রি করা শুরু করল। চীন ও তুরস্ক থেকে কাপড় এনে বিক্রি করতে লাগল। চামড়ার জ্যাকেট আর স্পোর্টস কস্টিউম কেনার হিড়িক পড়ে গেল একশ্রেণির মানুষের মধ্যে। অস্ত্র ব্যবসায়ী হয়ে উঠল কেউ কেউ। এরা কোথা থেকে টাকা জোগাড় করছে, তা সব সময় বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, কোথাও কোথাও টাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই তা ধরতে পারছে না।

বাজার নিয়ন্ত্রক শ্রেণির মধ্যেও জন্ম নিল আরেকটি শ্রেণি, যাদের আমাদের দেশের ভাষায় ‘মাস্তান’ বলা হয়। ওরা বলত ‘ক্রিশা’, মানে ছাদ। আপনি ব্যবসা করবেন, করুন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার মাথায় যদি ছাদ হয়ে মাফিয়া না থাকে, তাহলে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে। অতএব বেশি চালাকি করবেন না। অন্য কোনো মাফিয়া দল আপনার কাছে বখরা চাইতে এলে আপনি আপনার ‘ছাদ’-এর নাম উল্লেখ করুন। আপনাকে কেউ ছোঁবে না। মাফিয়া-মাফিয়া নিজেদের মধ্যে আলাপ করে নেবে।

তিন
আরও অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু অল্প কথায় মুদ্রাস্ফীতির ফলে যে ঘটনাগুলো ঘটতে পারে, তার আংশিক বর্ণনা করলাম। রাশিয়ায় তখন দুটো পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছিল তরুণ-তরুণীরা। মাস্তান হচ্ছিল ছেলেরা, শরীর বিক্রি করে বাঁচার উপায় খুঁজে বের করছিল মেয়েরা। সে দেশের বাস্তবতায় সেটা ছিল বেঁচে থাকার দাবি। এ নিয়ে অন্যদিন লেখা যাবে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন, কৃষি, বাজারসহ যে যে জায়গায় তার আঘাত এসে পড়বে, তাতে কিন্তু অসাধু মানুষের তৎপরতাও বেড়ে যেতে পারে। বাজার থেকে যদি কোনো পণ্য উধাও হয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, বেশি দামে সেগুলো বিক্রি হওয়া শুরু হলেই আবার বাজার ছেয়ে যাবে পণ্যে। সেটা তো আমরা পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদি পণ্যের ক্ষেত্রে আগেও দেখেছি। 
আরেকটি সংগত প্রশ্নও তোলা যায়। আমাদের নাগরিক সমাজের বা সেলিব্রিটি মহলের কারও মুখ থেকে কি এখন পর্যন্ত  তেমন কিছু শুনেছেন, যাতে মনে হয় গরিবের পাশে আছেন তাঁরা? আমি যে মাফিয়ার কথা উল্লেখ করলাম, তার বিস্তার কিন্তু সাংস্কৃতিক মহলেও ছিল। রাজনীতি ও সংস্কৃতি যখন একশ্রেণির পেশিবহুল মানুষের আয়ত্তে থাকে, তখন যে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে, তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। সে আলোচনা হবে ভিন্ন কোথাও। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়তেই পারে। কিন্তু দামের এতটা উল্লম্ফন গরিব আর মধ্যবিত্তের পেটে 
যে কত বড় লাথি মারতে পারে, তা কি কেউ বুঝতে পারে?

বেশি কিছু বলব না। আগামী সপ্তাহের ছুটির দিনটিতে শুধু ধানমন্ডির রেস্তোরাঁগুলোয় ঢুঁ মেরে দেখুন, সেখানে বসার জায়গা পান কি না। ফাস্ট ফুড হোক কিংবা হোক তা বুফে খাবার, রেস্তোরাঁ উপচে পড়বে খাবারের সম্ভারে। লিফটে না উঠে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করুন, দেখবেন ফেলে দেওয়া খাবারের দুর্গন্ধে আপনার নাড়িও উল্টে আসবে।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত