ড. আর এম দেবনাথ
প্রথম ধাক্কা, দ্বিতীয় ধাক্কা, অর্থনীতি এখন তৃতীয় ধাক্কার মুখোমুখি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়ে কাজকর্ম শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী, তা দেশের মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট বলে মনে হয় না। তবে ২০২০ সালে ‘কোভিড-১৯’ যে ধাক্কা আমাদের দিয়েছিল, যে বিপদে ফেলেছিল, তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ ওই ধাক্কা আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে করে দেয়। আমাদের ‘স্ট্রাগল’ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হওয়ার। ২০১১-১২ থেকে অবিরাম উচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল অর্থনীতিতে। চারদিকে প্রশংসা। রিজার্ভ বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, ব্যয়বহুল বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে বড় আকারের মধ্যবিত্ত। এক-দেড় কোটি লোক দেশের বাইরে। মাসে দেড়-দুই বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায়। দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। সাক্ষরতার হার বাড়ছে। মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে।
শিশুমৃত্যুর হার কমছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমছে। অর্থনীতি এবং সামাজিক সূচকগুলো চকচকে। আমরা উড়ছি আকাশে। কেউ ভাবিনি হঠাৎ চীন থেকে এক অজানা-অচেনা ‘ভাইরাস’ এসে আমাদের থামিয়ে দেবে। ঘরে ঘরে আর্তনাদ, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। চিকিৎসা নেই, হাসপাতাল ভর্তি রোগীতে। অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। মিল-কারখানা বন্ধ। মানুষে মানুষে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ। উন্নয়ন তো দূরের কথা, ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা।
হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এক বিখ্যাত শিল্পপতি সিঙ্গাপুর, চীন থেকে ডাক্তার এনেও মৃত্যুবরণ করলেন ‘কোভিড-১৯’-এর কাছে। মৃত্যুর আগে বললেন, ‘ডাক্তার, তোমরা আমাকে বাঁচাও। আমি আমার সব সম্পদ তোমাদের লিখে দেব।’ বোঝা যাচ্ছে কী বিপদ গেছে, কী ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা। হয়ে পড়েছিলাম তিন-চার দশক আগের উন্নত এক শ্রীলঙ্কার মতো। ভীষণ গর্বের ব্যাপার। না, বিধাতা আমাদের এই অগ্রগতি সহ্য করলেন না। ২০১৮-১৯-এর ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ হারের প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অথচ টানা সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রেকর্ড আমরা গড়েছিলাম।
করোনা গেল। লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি দিয়ে কোনোমতে অর্থনীতি ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছুটা ‘রিকভারি’ করলাম আমরা। কিন্তু দুই নম্বর মারাত্মক ধাক্কা এবার এল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে। ১৯৭২-৭৫ সালের মতো জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দেড়-দুই গুণ। ডলার রিজার্ভ অর্ধেক। ডলারের দাম ৮৫-৮৬ থেকে এখন ১২০-১২৫ টাকা। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে আমাদের বারোটা বেজে গেল। রপ্তানির হিসাব এখন মেলে না। যত বলেছি, তার চেয়ে অনেক কম আসল রপ্তানি। আমদানি হচ্ছে প্রচুর। এক বছর তো আমদানি হয়ে গেল ৮৫-৯০ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান শতকোটি) ডলারের পণ্য।
কী আমদানি হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে আমদানি? আসলে হচ্ছে অর্থ পাচার। খুব দুর্নীতি বেড়ে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আয়ের হিসাবও ঠিক নয়। ২০২৩-২৪-এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধন করে হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
‘এনবিআর’ বলছে, আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রধান হিসাবরক্ষক অফিস থেকে বলছে, তারা পেয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। নেই ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এই যে লুকোচুরির ফল কী? ফল হচ্ছে সরকারি ঋণ বাড়ছে। সুদের পরিমাণ বাড়ছে। সরকার বাজার থেকে সমানে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। বেসরকারি খাত ঋণের জন্য চিৎকার করছে। কাঁচামালের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব, মধ্যবর্তী পণ্যের অভাব। কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। দারিদ্র্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি তুঙ্গে।
বন্যা, খরা ইত্যাদি কারণ, সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ইত্যাদি জিনিসপত্রের দামকে আকাশে তুলেছে। মানুষ পড়েছে ভীষণ কষ্টে। অথচ দেশে তৈরি হয়েছে বেনজীর ও মতিউরের মতো বড় বড় চোর। সরকার সব বুঝেশুনে মূল্যস্ফীতি রোধে ঘোষণা করেছে অনেক নীতি। মুদ্রানীতি ‘টাইট’ করা হয়েছে। রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন এনে ২০-২৫টি নিত্যপণ্য আমদানিতে হ্রাস করা হয়েছে কাস্টমস ডিউটি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘টিসিবি’র মাধ্যমে ভোগ্যপণ্য বিতরণ করা হচ্ছে। ১ কোটি গরিবকে খাওয়াতে গিয়ে খরচ করেছে বিপুল টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কোনোক্রমে থামানো যাচ্ছে না।
এই প্রেক্ষাপটে ঘটে যায় সরকারের পতন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেছেন। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাঁরা শপথ নিয়েছেন ৮ আগস্ট। সম্পূর্ণ নতুন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি। দৃশ্যত গভীরভাবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ব্যাংকে ব্যাংকে অসন্তোষ। মিল-কারখানা সব এখনো চালু হয়নি। পুলিশের সব সদস্য এখনো কাজে নামেনি। রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রছাত্রীরা। রপ্তানি বাণিজ্য বিঘ্নিত, পাইকারি-খুচরা বাজারের চেইন বিঘ্নিত—এসব অবশ্যই অপ্রত্যাশিত। অর্থনৈতিক ধাক্কা। এটা ‘তৃতীয় ধাক্কা’, যা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। আগের দুটো ধাক্কা ছিল শুধুই অর্থনৈতিক। এই অর্থে এবারের ধাক্কা সুদূরপ্রসারী। কী থেকে কী হয়ে গেল, কেউ এখনো বুঝতে পারছে না। তবে এটা বোঝা যায়, পূর্বতন সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল, অসন্তোষ ছিল। এরই প্রেক্ষাপটে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তার সামনে অনেক কাজ। মূল্যস্ফীতি রোধ, ঘুষ-দুর্নীতি রোধ, অর্থ পাচার বন্ধ করা, ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে অনেক কাজ।
বহুল আলোচিত সমস্যা। সব জমা হয়েছে গত ১০-১৫ বছরে। কার্পেটের নিচে ময়লা জমেছে। দুর্গন্ধময় ময়লা। মানুষ সহ্য করতে পারছে না। মানুষ বাজারের অত্যাচার থেকে মুক্তি চায়। ব্যবসায়ী-আমলা ‘কাম’ রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত ‘অ্যালায়েন্সের’ শাসন চায় বলে মনে হয় না। এটা আসলে ‘বণিকের’ অত্যাচারী শাসন। অসহ্য এই শাসন।
অতএব এবারের এই ধাক্কা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকও। আগের দুটো ছিল সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। এবার রাজনীতি যোগ হয়েছে। অথচ আমাদের সামনে ছিল কত কাজ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। ইতিমধ্যেই অর্থনীতিতে আমরা বিশ্বের ৩৫তম। নিম্নমধ্য আয়ে উত্তরণ ঘটবে ২০২৬ সালে। নতুন বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গড়ে ওঠা অর্থ, মুদ্রা, ব্যবসায়িক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। গাজা-ইসরায়েল সংঘাত চলছে। ইরানে পরিবর্তন এসেছে। শ্রীলঙ্কা শান্ত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অস্থিতিশীল। বিশ্বের সব দেশ এক চরম দুর্দশার মধ্যে। অস্থিতিশীলতা, বেকারত্ব, সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ, বৈষম্য ইত্যাদি বাড়ছে। বিশ্বের উগ্রমূর্তি দেখা যাচ্ছে ভারতের ধনী পরিবারে। আমাদের ধনীদের মধ্যেও এই একই প্রবণতা। বড়, খুবই বড় সংকট। কথা উঠেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এখন কি তাহলে তলে পড়ে যাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান?
শুধু দুর্নীতি দমন নয়, অনেক সমস্যা। উন্নয়নের পাশাপাশি এসবও জমা হয়েছে। ঋণগ্রস্ত দেশ, সুদে-আসলে দেনা সহ্যসীমার বাইরে। রপ্তানিতে ভাটা। রেমিট্যান্স আগের মতো নেই। রিজার্ভ পরিস্থিতি খারাপ। কাঁচামালের অভাব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব সমস্যা মোকাবিলা করবে, নাকি অতিসত্বর নির্বাচন দিয়ে তারা ঘরে ফিরে যাবে? কিন্তু মনে হচ্ছে সরকারের অ্যাজেন্ডা অনেক বড়।
ছাত্ররা রাষ্ট্রীয় সংস্কার চায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার চায়। মনে হয় সংবিধান পরিবর্তনও চায়। এসব তো দীর্ঘমেয়াদি কাজ। অল্প সময়ে কি তা সম্ভব? এসব প্রশ্ন বিবেচনায় নিলে এবারের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ধাক্কাটি আমাদের জাতীয় জীবনে মাইলফলক হয়ে থাকবে। অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা নাকি শান্তি ও উন্নয়ন—এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা। অতীতে এমন পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ফলাফল বলা যায় শূন্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা কী চেয়েছিলাম, এখন কী অবস্থা? বড় বড় প্রশ্ন। সমাধানের স্থায়ী রূপ কি দিতে পারবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার?
ড. আর এম দেবনাথ, সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক
প্রথম ধাক্কা, দ্বিতীয় ধাক্কা, অর্থনীতি এখন তৃতীয় ধাক্কার মুখোমুখি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়ে কাজকর্ম শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী, তা দেশের মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট বলে মনে হয় না। তবে ২০২০ সালে ‘কোভিড-১৯’ যে ধাক্কা আমাদের দিয়েছিল, যে বিপদে ফেলেছিল, তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ ওই ধাক্কা আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে করে দেয়। আমাদের ‘স্ট্রাগল’ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হওয়ার। ২০১১-১২ থেকে অবিরাম উচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল অর্থনীতিতে। চারদিকে প্রশংসা। রিজার্ভ বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, ব্যয়বহুল বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে বড় আকারের মধ্যবিত্ত। এক-দেড় কোটি লোক দেশের বাইরে। মাসে দেড়-দুই বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায়। দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। সাক্ষরতার হার বাড়ছে। মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে।
শিশুমৃত্যুর হার কমছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমছে। অর্থনীতি এবং সামাজিক সূচকগুলো চকচকে। আমরা উড়ছি আকাশে। কেউ ভাবিনি হঠাৎ চীন থেকে এক অজানা-অচেনা ‘ভাইরাস’ এসে আমাদের থামিয়ে দেবে। ঘরে ঘরে আর্তনাদ, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। চিকিৎসা নেই, হাসপাতাল ভর্তি রোগীতে। অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। মিল-কারখানা বন্ধ। মানুষে মানুষে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ। উন্নয়ন তো দূরের কথা, ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা।
হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এক বিখ্যাত শিল্পপতি সিঙ্গাপুর, চীন থেকে ডাক্তার এনেও মৃত্যুবরণ করলেন ‘কোভিড-১৯’-এর কাছে। মৃত্যুর আগে বললেন, ‘ডাক্তার, তোমরা আমাকে বাঁচাও। আমি আমার সব সম্পদ তোমাদের লিখে দেব।’ বোঝা যাচ্ছে কী বিপদ গেছে, কী ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা। হয়ে পড়েছিলাম তিন-চার দশক আগের উন্নত এক শ্রীলঙ্কার মতো। ভীষণ গর্বের ব্যাপার। না, বিধাতা আমাদের এই অগ্রগতি সহ্য করলেন না। ২০১৮-১৯-এর ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ হারের প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অথচ টানা সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রেকর্ড আমরা গড়েছিলাম।
করোনা গেল। লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি দিয়ে কোনোমতে অর্থনীতি ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছুটা ‘রিকভারি’ করলাম আমরা। কিন্তু দুই নম্বর মারাত্মক ধাক্কা এবার এল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে। ১৯৭২-৭৫ সালের মতো জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দেড়-দুই গুণ। ডলার রিজার্ভ অর্ধেক। ডলারের দাম ৮৫-৮৬ থেকে এখন ১২০-১২৫ টাকা। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে আমাদের বারোটা বেজে গেল। রপ্তানির হিসাব এখন মেলে না। যত বলেছি, তার চেয়ে অনেক কম আসল রপ্তানি। আমদানি হচ্ছে প্রচুর। এক বছর তো আমদানি হয়ে গেল ৮৫-৯০ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন সমান শতকোটি) ডলারের পণ্য।
কী আমদানি হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে আমদানি? আসলে হচ্ছে অর্থ পাচার। খুব দুর্নীতি বেড়ে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আয়ের হিসাবও ঠিক নয়। ২০২৩-২৪-এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধন করে হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
‘এনবিআর’ বলছে, আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রধান হিসাবরক্ষক অফিস থেকে বলছে, তারা পেয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। নেই ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এই যে লুকোচুরির ফল কী? ফল হচ্ছে সরকারি ঋণ বাড়ছে। সুদের পরিমাণ বাড়ছে। সরকার বাজার থেকে সমানে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। বেসরকারি খাত ঋণের জন্য চিৎকার করছে। কাঁচামালের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব, মধ্যবর্তী পণ্যের অভাব। কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। দারিদ্র্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি তুঙ্গে।
বন্যা, খরা ইত্যাদি কারণ, সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ইত্যাদি জিনিসপত্রের দামকে আকাশে তুলেছে। মানুষ পড়েছে ভীষণ কষ্টে। অথচ দেশে তৈরি হয়েছে বেনজীর ও মতিউরের মতো বড় বড় চোর। সরকার সব বুঝেশুনে মূল্যস্ফীতি রোধে ঘোষণা করেছে অনেক নীতি। মুদ্রানীতি ‘টাইট’ করা হয়েছে। রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন এনে ২০-২৫টি নিত্যপণ্য আমদানিতে হ্রাস করা হয়েছে কাস্টমস ডিউটি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘টিসিবি’র মাধ্যমে ভোগ্যপণ্য বিতরণ করা হচ্ছে। ১ কোটি গরিবকে খাওয়াতে গিয়ে খরচ করেছে বিপুল টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কোনোক্রমে থামানো যাচ্ছে না।
এই প্রেক্ষাপটে ঘটে যায় সরকারের পতন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেছেন। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাঁরা শপথ নিয়েছেন ৮ আগস্ট। সম্পূর্ণ নতুন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি। দৃশ্যত গভীরভাবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ব্যাংকে ব্যাংকে অসন্তোষ। মিল-কারখানা সব এখনো চালু হয়নি। পুলিশের সব সদস্য এখনো কাজে নামেনি। রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রছাত্রীরা। রপ্তানি বাণিজ্য বিঘ্নিত, পাইকারি-খুচরা বাজারের চেইন বিঘ্নিত—এসব অবশ্যই অপ্রত্যাশিত। অর্থনৈতিক ধাক্কা। এটা ‘তৃতীয় ধাক্কা’, যা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। আগের দুটো ধাক্কা ছিল শুধুই অর্থনৈতিক। এই অর্থে এবারের ধাক্কা সুদূরপ্রসারী। কী থেকে কী হয়ে গেল, কেউ এখনো বুঝতে পারছে না। তবে এটা বোঝা যায়, পূর্বতন সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল, অসন্তোষ ছিল। এরই প্রেক্ষাপটে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তার সামনে অনেক কাজ। মূল্যস্ফীতি রোধ, ঘুষ-দুর্নীতি রোধ, অর্থ পাচার বন্ধ করা, ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে অনেক কাজ।
বহুল আলোচিত সমস্যা। সব জমা হয়েছে গত ১০-১৫ বছরে। কার্পেটের নিচে ময়লা জমেছে। দুর্গন্ধময় ময়লা। মানুষ সহ্য করতে পারছে না। মানুষ বাজারের অত্যাচার থেকে মুক্তি চায়। ব্যবসায়ী-আমলা ‘কাম’ রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত ‘অ্যালায়েন্সের’ শাসন চায় বলে মনে হয় না। এটা আসলে ‘বণিকের’ অত্যাচারী শাসন। অসহ্য এই শাসন।
অতএব এবারের এই ধাক্কা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকও। আগের দুটো ছিল সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। এবার রাজনীতি যোগ হয়েছে। অথচ আমাদের সামনে ছিল কত কাজ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। ইতিমধ্যেই অর্থনীতিতে আমরা বিশ্বের ৩৫তম। নিম্নমধ্য আয়ে উত্তরণ ঘটবে ২০২৬ সালে। নতুন বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গড়ে ওঠা অর্থ, মুদ্রা, ব্যবসায়িক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। গাজা-ইসরায়েল সংঘাত চলছে। ইরানে পরিবর্তন এসেছে। শ্রীলঙ্কা শান্ত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অস্থিতিশীল। বিশ্বের সব দেশ এক চরম দুর্দশার মধ্যে। অস্থিতিশীলতা, বেকারত্ব, সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ, বৈষম্য ইত্যাদি বাড়ছে। বিশ্বের উগ্রমূর্তি দেখা যাচ্ছে ভারতের ধনী পরিবারে। আমাদের ধনীদের মধ্যেও এই একই প্রবণতা। বড়, খুবই বড় সংকট। কথা উঠেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এখন কি তাহলে তলে পড়ে যাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান?
শুধু দুর্নীতি দমন নয়, অনেক সমস্যা। উন্নয়নের পাশাপাশি এসবও জমা হয়েছে। ঋণগ্রস্ত দেশ, সুদে-আসলে দেনা সহ্যসীমার বাইরে। রপ্তানিতে ভাটা। রেমিট্যান্স আগের মতো নেই। রিজার্ভ পরিস্থিতি খারাপ। কাঁচামালের অভাব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব সমস্যা মোকাবিলা করবে, নাকি অতিসত্বর নির্বাচন দিয়ে তারা ঘরে ফিরে যাবে? কিন্তু মনে হচ্ছে সরকারের অ্যাজেন্ডা অনেক বড়।
ছাত্ররা রাষ্ট্রীয় সংস্কার চায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার চায়। মনে হয় সংবিধান পরিবর্তনও চায়। এসব তো দীর্ঘমেয়াদি কাজ। অল্প সময়ে কি তা সম্ভব? এসব প্রশ্ন বিবেচনায় নিলে এবারের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ধাক্কাটি আমাদের জাতীয় জীবনে মাইলফলক হয়ে থাকবে। অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা নাকি শান্তি ও উন্নয়ন—এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা। অতীতে এমন পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ফলাফল বলা যায় শূন্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা কী চেয়েছিলাম, এখন কী অবস্থা? বড় বড় প্রশ্ন। সমাধানের স্থায়ী রূপ কি দিতে পারবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার?
ড. আর এম দেবনাথ, সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে