এ কে এম শামসুদ্দিন
দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রথম প্রথম বড় কোনো দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে মানুষের ভেতর বেশ প্রতিক্রিয়া হতো; এখন ধারাবাহিক দুর্নীতির ঘটনার কথা শুনতে শুনতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভেবে কষ্ট লাগে, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ আজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আফসোস হয়, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতার হাতে গড়া যে রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসনামলেই বাংলাদেশ কিনা ধীরে ধীরে প্রতিকারবিহীন অপ্রতিরোধ্য একটি দুর্নীতিপ্রবণ দেশে পরিণত হয়েছে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই তা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে সমাজের চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিরা যখন পার পেয়ে যায়, সাধারণ মানুষের ভেতর তখন হতাশার সৃষ্টি হয়। এই হতাশা কিছুদিন মানুষকে পীড়া দেয়, তারপর একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সরকারকে অনেকেই অনেকভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহুবার হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। তাতে কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি কমেছে— এমন প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। প্রশ্ন জাগে, দুর্নীতিবাজ এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কি কেউ নেই?
সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তর আজ দুর্নীতির বিষক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত। দেশে সৎ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রাধান্য বেশি। যাঁরা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করেন, তাঁরা নানাভাবে দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে পরাস্ত হন। একজন দুর্নীতিবাজ বিত্তশালী সমাজে যে দম্ভের সঙ্গে চলেন, একজন সৎ ও সজ্জন মানুষ তা পারছেন না। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, অবৈধ উপায়ে দেশের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরও দেশের বেশ কিছু মুখচেনা দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সরকারকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এত কিছু করার পরও এই ব্যক্তিরা দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে ধরনের সম্মান পান, একজন সারা জীবন সততার সঙ্গে কাজ করে দেশের জন্য অবদান রাখার পরও দুর্নীতিবাজদের তুলনায় ন্যায্য সম্মানটুকুও পান না।
বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যটি ব্যক্তিগত। বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প ও মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত বাজেটের নামে বেশ কিছু দুর্নীতির ঘটনাকে যেভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দুর্নীতি ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ১০-১২ বছরে ব্যক্তিগত দুর্নীতির রেকর্ডও কম নয়। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ক্ষমতার বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের নামীদামি ব্যক্তিরা পিলে চমকানোর মতো দুর্নীতি করেও রেহাই পেয়ে গেছেন। যাঁদের কারসাজিতে শেয়ারবাজার ধ্বংস হয়েছে, যাঁরা লুটপাট করে ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন, সরকারি আমলাসহ বিশেষ একটি গোষ্ঠী যেভাবে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন; তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের নির্লিপ্ততা দুর্নীতিকে বরং উৎসাহিত করেছে। দেখা গেছে, এসব দুর্নীতির পেছনে কোনো না কোনো দায়িত্ববান ব্যক্তি কিংবা কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় আছে।
সংবাদপত্রের খবর, মন্ত্রী ও সচিবেরা জনগণের করের টাকায় নিজেদের মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। বর্তমান আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও সচিবেরা স্বজনদের নামে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান করতে সরকারের প্রায় ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়। এই ১৮ প্রকল্পের মধ্যে ১১টিই মন্ত্রী অথবা আমলারা তোদের মা-বাবা ও স্বজনদের নামে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বা করছেন। সাধারণত কোনো না কোনো এনজিও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুদানে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রশিক্ষণকেন্দ্র কিংবা এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং পরিচালনা করে থাকে। নীতিমালা বলে, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে শহর এলাকায় মোট ব্যয়ের ৬০ এবং গ্রাম্য এলাকায় ৮০ শতাংশ অর্থ সরকার দিয়ে থাকে। বাকি অর্থ এনজিও বহন করে। তবে, সরকারি অনুদান পেতে হলে সংশ্লিষ্ট খাতে এনজিওর অন্তত দুই বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু দেখা গেছে, মন্ত্রী ও সচিবেরাই এসব এনজিও নিজেদের স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেসব মন্ত্রী ও আমলার বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এর মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজ গ্রামে মায়ের নামে একটি ‘মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল’ নির্মাণ করছেন। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সমাজসেবা অধিদপ্তর আবার তাঁরই মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৯ কোটি টাকা দেওয়ার কথা মন্ত্রীর মায়ের নামে গঠিত এনজিওর। উল্লিখিত টাকা না দিয়ে এনজিওটি তাদের অংশ বাবদ মন্ত্রীর পরিবারের দেওয়া এক একর জমির মূল্য দেখিয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। বাকি সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাসপাতাল নির্মাণের হিসাবে অদ্যাবধি জমা দেয়নি। মন্ত্রী নুরুজ্জামান তাঁর মায়ের নামে যে এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটির প্রকল্প পাওয়ার আগপর্যন্ত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দুই বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। এর নির্মাণের কাজটিও আবার দেওয়া হয়েছে মন্ত্রীর ভাই শামসুজ্জামান আহমেদের প্রতিষ্ঠান দ্য বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডকে। সরকারের আরও আটজন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। এই আমলারা অবশ্য এরই মধ্যে অবসরে গেছেন।
মন্ত্রীর ভাই শামসুজ্জমান আহমেদের প্রসঙ্গ আসতেই বর্তমান সরকারের আরও একজন মন্ত্রীর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি হলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বড় ভাই জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদের কথা। দীপু মনির ভাইয়ের ঘটনা এবং মন্ত্রী নুরুজ্জামানের ঘটনা এক না হলেও উভয় ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মিল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার যে প্রভাব কাজ করেছে তা অস্বীকার করা যায় না। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের নামে সরকারের কাছ থেকে ৩৫৯ কোটি টাকা লোপাটের প্রক্রিয়ায় শিক্ষামন্ত্রীর ভাই ও কয়েকজন আত্মীয় জড়িত থাকার খবর প্রকাশিত হলে বেশ সমালোচনা হয়। জমির দাম অস্বাভাবিক হওয়ায় চাঁদপুরের ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ জমি কেনার প্রক্রিয়াটি আটকে দেন। এর জেরে তাঁকে অবশ্য অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়।
একই ধরনের অভিযোগ ওঠে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মানিকগঞ্জের জাগীর ইউনিয়নে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের কারখানার জন্য ৩১ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। ৩১ একরের মধ্যে ২০ একরের বেশি জমি কিনেছেন মন্ত্রী, তাঁর ছেলে ও মেয়ে। দেখা গেছে, প্রস্তাবিত জমির শ্রেণি কৃষি হলেও বালু ভরাট করে তা ভিটি শ্রেণি করা হয়। চাঁদপুরের মতো মানিকগঞ্জেও ডিসি বাধা হয়ে দাঁড়ান। মানিকগঞ্জের ডিসি মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ প্রস্তাবিত স্থানে জমি অধিগ্রহণ করা হলে সরকারের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারকে অবহিত করে চিঠি দেন।
সরকারের কোনো মন্ত্রী বা আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলে তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সরকারের উচিত তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই সোচ্চার হোন না কেন, সম্ভবত সরকারি কর্মকর্তা এবং দলের নেতা-কর্মীদের তা উজ্জীবিত করতে পারছে না। তা না হলে কিছুদিন পরপর দলের নেতা এবং আমলাদের দুর্নীতির যে কিচ্ছা-কাহিনি বেরিয়ে আসে, তা তাঁর জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বর্তমানে রাজনীতিতে যে অস্থির সময় চলছে, তাতে সত্যিকার অর্থেই যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হয়; তাহলে এর মাশুল ক্ষমতাসীনদেরই দিতে হবে। তবে বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের স্ট্র্যাটেজির মতো ক্ষমতাসীনদের নতুন কোনো স্ট্র্যাটেজি যদি থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। মনে রাখতে হবে, সবকিছুরই শেষ আছে, গণতন্ত্রে জনগণের কথাই শেষ কথা। সময় এলে জনগণ ঠিকই তাদের জবাব দিয়ে দেবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রথম প্রথম বড় কোনো দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে মানুষের ভেতর বেশ প্রতিক্রিয়া হতো; এখন ধারাবাহিক দুর্নীতির ঘটনার কথা শুনতে শুনতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভেবে কষ্ট লাগে, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ আজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আফসোস হয়, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতার হাতে গড়া যে রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসনামলেই বাংলাদেশ কিনা ধীরে ধীরে প্রতিকারবিহীন অপ্রতিরোধ্য একটি দুর্নীতিপ্রবণ দেশে পরিণত হয়েছে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই তা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে সমাজের চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিরা যখন পার পেয়ে যায়, সাধারণ মানুষের ভেতর তখন হতাশার সৃষ্টি হয়। এই হতাশা কিছুদিন মানুষকে পীড়া দেয়, তারপর একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সরকারকে অনেকেই অনেকভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহুবার হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। তাতে কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি কমেছে— এমন প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। প্রশ্ন জাগে, দুর্নীতিবাজ এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কি কেউ নেই?
সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তর আজ দুর্নীতির বিষক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত। দেশে সৎ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রাধান্য বেশি। যাঁরা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করেন, তাঁরা নানাভাবে দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে পরাস্ত হন। একজন দুর্নীতিবাজ বিত্তশালী সমাজে যে দম্ভের সঙ্গে চলেন, একজন সৎ ও সজ্জন মানুষ তা পারছেন না। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, অবৈধ উপায়ে দেশের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরও দেশের বেশ কিছু মুখচেনা দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সরকারকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এত কিছু করার পরও এই ব্যক্তিরা দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে ধরনের সম্মান পান, একজন সারা জীবন সততার সঙ্গে কাজ করে দেশের জন্য অবদান রাখার পরও দুর্নীতিবাজদের তুলনায় ন্যায্য সম্মানটুকুও পান না।
বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যটি ব্যক্তিগত। বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প ও মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত বাজেটের নামে বেশ কিছু দুর্নীতির ঘটনাকে যেভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দুর্নীতি ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ১০-১২ বছরে ব্যক্তিগত দুর্নীতির রেকর্ডও কম নয়। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ক্ষমতার বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের নামীদামি ব্যক্তিরা পিলে চমকানোর মতো দুর্নীতি করেও রেহাই পেয়ে গেছেন। যাঁদের কারসাজিতে শেয়ারবাজার ধ্বংস হয়েছে, যাঁরা লুটপাট করে ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন, সরকারি আমলাসহ বিশেষ একটি গোষ্ঠী যেভাবে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন; তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের নির্লিপ্ততা দুর্নীতিকে বরং উৎসাহিত করেছে। দেখা গেছে, এসব দুর্নীতির পেছনে কোনো না কোনো দায়িত্ববান ব্যক্তি কিংবা কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় আছে।
সংবাদপত্রের খবর, মন্ত্রী ও সচিবেরা জনগণের করের টাকায় নিজেদের মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। বর্তমান আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও সচিবেরা স্বজনদের নামে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান করতে সরকারের প্রায় ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়। এই ১৮ প্রকল্পের মধ্যে ১১টিই মন্ত্রী অথবা আমলারা তোদের মা-বাবা ও স্বজনদের নামে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বা করছেন। সাধারণত কোনো না কোনো এনজিও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুদানে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রশিক্ষণকেন্দ্র কিংবা এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং পরিচালনা করে থাকে। নীতিমালা বলে, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে শহর এলাকায় মোট ব্যয়ের ৬০ এবং গ্রাম্য এলাকায় ৮০ শতাংশ অর্থ সরকার দিয়ে থাকে। বাকি অর্থ এনজিও বহন করে। তবে, সরকারি অনুদান পেতে হলে সংশ্লিষ্ট খাতে এনজিওর অন্তত দুই বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু দেখা গেছে, মন্ত্রী ও সচিবেরাই এসব এনজিও নিজেদের স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেসব মন্ত্রী ও আমলার বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এর মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজ গ্রামে মায়ের নামে একটি ‘মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল’ নির্মাণ করছেন। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সমাজসেবা অধিদপ্তর আবার তাঁরই মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৯ কোটি টাকা দেওয়ার কথা মন্ত্রীর মায়ের নামে গঠিত এনজিওর। উল্লিখিত টাকা না দিয়ে এনজিওটি তাদের অংশ বাবদ মন্ত্রীর পরিবারের দেওয়া এক একর জমির মূল্য দেখিয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। বাকি সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাসপাতাল নির্মাণের হিসাবে অদ্যাবধি জমা দেয়নি। মন্ত্রী নুরুজ্জামান তাঁর মায়ের নামে যে এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটির প্রকল্প পাওয়ার আগপর্যন্ত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দুই বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। এর নির্মাণের কাজটিও আবার দেওয়া হয়েছে মন্ত্রীর ভাই শামসুজ্জামান আহমেদের প্রতিষ্ঠান দ্য বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডকে। সরকারের আরও আটজন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। এই আমলারা অবশ্য এরই মধ্যে অবসরে গেছেন।
মন্ত্রীর ভাই শামসুজ্জমান আহমেদের প্রসঙ্গ আসতেই বর্তমান সরকারের আরও একজন মন্ত্রীর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি হলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বড় ভাই জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদের কথা। দীপু মনির ভাইয়ের ঘটনা এবং মন্ত্রী নুরুজ্জামানের ঘটনা এক না হলেও উভয় ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মিল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার যে প্রভাব কাজ করেছে তা অস্বীকার করা যায় না। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের নামে সরকারের কাছ থেকে ৩৫৯ কোটি টাকা লোপাটের প্রক্রিয়ায় শিক্ষামন্ত্রীর ভাই ও কয়েকজন আত্মীয় জড়িত থাকার খবর প্রকাশিত হলে বেশ সমালোচনা হয়। জমির দাম অস্বাভাবিক হওয়ায় চাঁদপুরের ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ জমি কেনার প্রক্রিয়াটি আটকে দেন। এর জেরে তাঁকে অবশ্য অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়।
একই ধরনের অভিযোগ ওঠে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মানিকগঞ্জের জাগীর ইউনিয়নে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের কারখানার জন্য ৩১ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। ৩১ একরের মধ্যে ২০ একরের বেশি জমি কিনেছেন মন্ত্রী, তাঁর ছেলে ও মেয়ে। দেখা গেছে, প্রস্তাবিত জমির শ্রেণি কৃষি হলেও বালু ভরাট করে তা ভিটি শ্রেণি করা হয়। চাঁদপুরের মতো মানিকগঞ্জেও ডিসি বাধা হয়ে দাঁড়ান। মানিকগঞ্জের ডিসি মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ প্রস্তাবিত স্থানে জমি অধিগ্রহণ করা হলে সরকারের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারকে অবহিত করে চিঠি দেন।
সরকারের কোনো মন্ত্রী বা আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলে তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সরকারের উচিত তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই সোচ্চার হোন না কেন, সম্ভবত সরকারি কর্মকর্তা এবং দলের নেতা-কর্মীদের তা উজ্জীবিত করতে পারছে না। তা না হলে কিছুদিন পরপর দলের নেতা এবং আমলাদের দুর্নীতির যে কিচ্ছা-কাহিনি বেরিয়ে আসে, তা তাঁর জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বর্তমানে রাজনীতিতে যে অস্থির সময় চলছে, তাতে সত্যিকার অর্থেই যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হয়; তাহলে এর মাশুল ক্ষমতাসীনদেরই দিতে হবে। তবে বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের স্ট্র্যাটেজির মতো ক্ষমতাসীনদের নতুন কোনো স্ট্র্যাটেজি যদি থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। মনে রাখতে হবে, সবকিছুরই শেষ আছে, গণতন্ত্রে জনগণের কথাই শেষ কথা। সময় এলে জনগণ ঠিকই তাদের জবাব দিয়ে দেবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৩ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে