মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আগামী উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাউকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন কিংবা প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ায় দলের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা নিজেদের পুত্র-কন্যা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দলের স্থানীয় নেতাদের অনেক ক্ষেত্রেই হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সব চেষ্টাই করেছেন। কেউ কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসার ব্যবস্থাও করেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যে হয়েছে, তা বোঝা গেছে দলের সাধারণ সম্পাদকের মুখ থেকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশ তথা ওই সব প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া থেকে। যাঁরা এটা করবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এই নির্দেশ খুব বেশি প্রতিপালিত হয়নি। দলীয় প্রধানের উদ্দেশ্য ছিল উপজেলা নির্বাচনটি প্রভাবমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত করা। এ জন্য মন্ত্রী, এমপি এবং প্রভাবশালী নেতাদের ওই নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই তাঁদের নিজস্ব কোনো প্রার্থী যেন এই নির্বাচনে না থাকে, তাঁরা যেন নির্বাচন থেকে বহু দূরে অবস্থান করেন। উপজেলা নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, বিরোধীরাও যেন আস্থার সঙ্গে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে, আওয়ামী লীগের যোগ্য নেতারা জনগণের রায় নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। কিন্তু দলীয় সভাপতির এমন নির্দেশ চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে প্রথম পর্বের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রেই। বাকি তিন পর্বের অবস্থা কী হয়, তা অল্প কয়েক দিন পরই দেখা যাবে। তবে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের মন্ত্রী, এমপি এবং প্রভাবশালী নেতারা যাঁর যাঁর এলাকায় নিজেদের রক্তের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এতটাই নাছোড় দেওয়ার অবস্থানে চলে গেছেন যে সেখানে অন্যদের হয় তাঁদের বশীভূত হয়ে থাকতে হবে, নতুবা রাজনীতি ছেড়ে অন্য কিছু করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বিষয়টি আওয়ামী লীগে ভবিষ্যৎ উপস্থিতির জন্য কতটা হুমকির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এখনই যদি রাশ টেনে না ধরা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে বা ঘটতে চলেছে, তা এককথায় বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবার বা রক্তের উত্তরাধিকার শুধু আওয়ামী লীগেই রয়েছে—এমনটি নয়, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিতেও একই ধারা দৃশ্যমান। এমনকি হালের নামসর্বস্ব এক নেতার এক দলের ক্ষেত্রেও সেটি দেখা যাচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়; ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলবে। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সংক্ষেপে এর ইতিবাচক, নেতিবাচক উদাহরণটি তুলে ধরছি। হাজার হাজার বছর আগে মানব ইতিহাসের আদিপর্বে গোত্রীয় সমাজ ছিল। গোত্রকে রক্ষা করার মতো দৈহিক এবং বুদ্ধিতে সক্ষম ব্যক্তিকেই গোত্রীয় প্রধান হিসেবে মানা হতো। তবে সেই গোত্রীয় প্রধানের সন্তানটি যে পরবর্তী প্রধান হতে পারতেন, তা কিন্তু নয়। কারণ প্রতিনিয়ত গোত্রকে অন্য গোত্রের আক্রমণ এবং খাদ্যসংকট থেকে রক্ষা করার জন্য যিনি এগিয়ে আসতেন এবং সক্ষম হতেন, তিনি সবার কাছে গোত্রপ্রধান বলে বিবেচিত হতেন। খ্রিষ্টপূর্ব তিন-চার হাজার বছর আগে নগরসভ্যতায় রাজশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রিস ছাড়া সর্বত্রই রাজার বংশপরম্পরা শাসন ছিল, যুদ্ধবিগ্রহ ছিল, রাজা এবং শক্তিশালী সম্রাটরা সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। কোনো রাজা এবং রাজবংশই চিরস্থায়ী ছিল না। রাজপুত্রদের অধিকাংশই রাজ্য রক্ষা করতে পারেনি। প্রাচীন যুগের ইতিহাসে বেশ কয়েকজন সম্রাটের নাম এখনো আমরা তাঁদের শৌর্যবীর্যের কারণে স্মরণ করি। মিসরে ফারাও রামসেস (খ্রিষ্টপূর্ব ১৪-১৩ শতক), মেসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার, ভারতের সম্রাট অশোক প্রমুখ। আরও অনেকেই ছিলেন কিন্তু সব দেশেই, সব অঞ্চলেই রাজবংশের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন—এমন রাজার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। মধ্য যুগে সামন্ত রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসংখ্য রাজবংশের রাজা কিংবা সম্রাট শাসন করে গেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে খুব কমই যোগ্য উত্তরাধিকার হতে পেরেছেন। ফরাসি দার্শনিক মহামতি ভলতেয়ার নিজ দেশ ফ্রান্সে বুরবো রাজবংশের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের শাসনকে সমালোচনা করে বলেছিলেন, লুই একাই ফ্রান্সের জন্য যা করেছেন তা পূর্ববর্তী ২০ জন লুইও করতে পারেননি। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশে দেশে মধ্যযুগে পরিবারতন্ত্রের শাসন ছিল। সব দেশেই দু-একজন রাজা বা সম্রাটের নাম ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতির তালিকায় রয়েছে। ভারতবর্ষেও অনেক রাজবংশের শাসক ছিলেন। কয়েকজনের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্রাট আকবর কেবল পেরেছেন মহামতি উপাধিতে ভূষিত হতে। আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়। সেখানেও লিজেন্ড বা কিংবদন্তি নেতা হিসেবে সব দেশেই কয়েকজন নেতার নাম সবাই স্মরণ করে। কিন্তু আধুনিক কালের রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র, আদর্শ, উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক কাঠামো, ইত্যাদি গণতান্ত্রিকভাবে সবার মতামতের ভিত্তিতে প্রণয়ন ও পরিমার্জন করা হয়ে থাকে। দলের নেতৃত্বও সেভাবেই নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলো এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সেখানে দলীয় প্রধান কিংবা আঞ্চলিক নেতৃত্ব সাংগঠনিকভাবেই নির্বাচিত হয়ে থাকে। তারপরও পারিবারিক পরিচয়ে কেউ কেউ পদপদবি পেয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
আমাদের দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির যাত্রা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হলেও গণতন্ত্রের ধারণা এবং চর্চায় এখনো যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে। সমাজব্যবস্থার মধ্যে সামন্ত জমিদার পরিবার, ধর্মীয় পীর তান্ত্রিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করার মনোভাব এখনো ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আধুনিক শিক্ষার যেমন অভাব রয়েছে, মানুষের বিশ্বাসের মধ্যেও যুক্তিবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপক ঘাটতি নিয়েই আমাদের এই অঞ্চলের দেশগুলোয় চলতে হচ্ছে। ভারত শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চর্চা করলেও রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এখনো পুরোনো বোধ, বিশ্বাস এবং সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সে কারণেই সেখানেও রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের মোহমুক্তি ঘটেনি। কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবস্থান দেখা যায়। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এর থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি। তবে রক্তের সম্পর্কের কেউ রাজনীতিতে হাল ধরলেই যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, তেমনটি সব সময় সঠিক না-ও হতে পারে। বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কখনো তাঁর সন্তানদের কাউকে আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার হিসেবে ভাবেননি। কিন্তু পঁচাত্তরের পর যে রাজনৈতিক আরোপিত শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা পাঁচ বছরেও চেষ্টা করে এক মোহনায় যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনাকে দলের প্রধানের দায়িত্বে সর্বসম্মতভাবে আনা হয়। তিনি প্রবাসে অনেকটা নির্বাসিত থেকে দেশে এসে দলের হাল ধরলেন। তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতা পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সাহচর্য, ছাত্ররাজনীতি, বিদেশে বসে দেশকে দেখাশোনা এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির খোঁজখবর রাখার অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। রাজনীতি সচেতন শেখ হাসিনা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুধু দলকেই নয়, জনগণকেও তৈরি করার ক্ষেত্রে নিরন্তর লড়াই করেছেন। তারপরও তাঁর রাজনীতির পথচলা, হাল ধরা, নেতৃত্ব দেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। সে কারণে তাঁকে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রোডাক্ট হিসেবে মোটেও অভিহিত করা যায় না। তিনি প্রায় ২০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তাঁর রাজনীতির উত্তরাধিকারের ব্যাপারেও পিতার মতোই নীরবতা পালন করছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে দলের হাল ধরতে দেখে বিএনপির একটি অংশ খালেদা জিয়াকে ১৯৮২ সালে দলের রাজনীতিতে যুক্ত করলেও ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়ার কোনো ধরনের পূর্ব রাজনৈতিক সংযুক্তি ছিল না। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি রাজনীতিতে এলেন এবং ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চমকও দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বড় পুত্র তারেক রহমান দলের প্রভাব বিস্তারকারী পদে অধিষ্ঠিত হন, হাওয়া ভবন খুলে সমান্তরাল সরকার পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সাল থেকে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে বিদেশে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় পার্টিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পর তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জি এম কাদেরের সঙ্গে দলের ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, সম্প্রতি সেই দ্বন্দ্বে দল বিভক্ত হয়ে যায়। কত দিন এই দল টিকে থাকবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এর মূলে রয়েছে নিরেট পারিবারিক উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আগমন যে শূন্যতা পূরণ করেছে, তাতে ছিল আদর্শের রাজনীতিকে বহন করা। তিনি দেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, সেখানে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ক্যারিশমা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মানসিকতা। এটি অন্যদের ক্ষেত্রে একেবারেই তুলনাযোগ্য নয়। এখন যাঁরা আওয়ামী লীগেই পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাঁদের কজন দলের দুর্দিনে থাকবেন, সেটা বলা মুশকিল। রাজনীতিতে মহৎ আদর্শকে ধারণ করে বেড়ে উঠতে হয়, যোগ্যতার প্রমাণও দিতে হয়। তাহলেই কেবল রক্ত ও আদর্শের যথার্থ উত্তরাধিকার হওয়া যায়। কৃত্রিমভাবে কেউ আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের নেতা হলে আওয়ামী লীগই তাঁদের ভারে মহা সংকটে পড়তে বাধ্য হবে।
আগামী উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাউকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন কিংবা প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ায় দলের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা নিজেদের পুত্র-কন্যা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দলের স্থানীয় নেতাদের অনেক ক্ষেত্রেই হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সব চেষ্টাই করেছেন। কেউ কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসার ব্যবস্থাও করেছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যে হয়েছে, তা বোঝা গেছে দলের সাধারণ সম্পাদকের মুখ থেকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশ তথা ওই সব প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া থেকে। যাঁরা এটা করবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এই নির্দেশ খুব বেশি প্রতিপালিত হয়নি। দলীয় প্রধানের উদ্দেশ্য ছিল উপজেলা নির্বাচনটি প্রভাবমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত করা। এ জন্য মন্ত্রী, এমপি এবং প্রভাবশালী নেতাদের ওই নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই তাঁদের নিজস্ব কোনো প্রার্থী যেন এই নির্বাচনে না থাকে, তাঁরা যেন নির্বাচন থেকে বহু দূরে অবস্থান করেন। উপজেলা নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, বিরোধীরাও যেন আস্থার সঙ্গে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে, আওয়ামী লীগের যোগ্য নেতারা জনগণের রায় নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। কিন্তু দলীয় সভাপতির এমন নির্দেশ চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে প্রথম পর্বের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রেই। বাকি তিন পর্বের অবস্থা কী হয়, তা অল্প কয়েক দিন পরই দেখা যাবে। তবে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের মন্ত্রী, এমপি এবং প্রভাবশালী নেতারা যাঁর যাঁর এলাকায় নিজেদের রক্তের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এতটাই নাছোড় দেওয়ার অবস্থানে চলে গেছেন যে সেখানে অন্যদের হয় তাঁদের বশীভূত হয়ে থাকতে হবে, নতুবা রাজনীতি ছেড়ে অন্য কিছু করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বিষয়টি আওয়ামী লীগে ভবিষ্যৎ উপস্থিতির জন্য কতটা হুমকির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এখনই যদি রাশ টেনে না ধরা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে বা ঘটতে চলেছে, তা এককথায় বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবার বা রক্তের উত্তরাধিকার শুধু আওয়ামী লীগেই রয়েছে—এমনটি নয়, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিতেও একই ধারা দৃশ্যমান। এমনকি হালের নামসর্বস্ব এক নেতার এক দলের ক্ষেত্রেও সেটি দেখা যাচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়; ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলবে। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সংক্ষেপে এর ইতিবাচক, নেতিবাচক উদাহরণটি তুলে ধরছি। হাজার হাজার বছর আগে মানব ইতিহাসের আদিপর্বে গোত্রীয় সমাজ ছিল। গোত্রকে রক্ষা করার মতো দৈহিক এবং বুদ্ধিতে সক্ষম ব্যক্তিকেই গোত্রীয় প্রধান হিসেবে মানা হতো। তবে সেই গোত্রীয় প্রধানের সন্তানটি যে পরবর্তী প্রধান হতে পারতেন, তা কিন্তু নয়। কারণ প্রতিনিয়ত গোত্রকে অন্য গোত্রের আক্রমণ এবং খাদ্যসংকট থেকে রক্ষা করার জন্য যিনি এগিয়ে আসতেন এবং সক্ষম হতেন, তিনি সবার কাছে গোত্রপ্রধান বলে বিবেচিত হতেন। খ্রিষ্টপূর্ব তিন-চার হাজার বছর আগে নগরসভ্যতায় রাজশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রিস ছাড়া সর্বত্রই রাজার বংশপরম্পরা শাসন ছিল, যুদ্ধবিগ্রহ ছিল, রাজা এবং শক্তিশালী সম্রাটরা সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। কোনো রাজা এবং রাজবংশই চিরস্থায়ী ছিল না। রাজপুত্রদের অধিকাংশই রাজ্য রক্ষা করতে পারেনি। প্রাচীন যুগের ইতিহাসে বেশ কয়েকজন সম্রাটের নাম এখনো আমরা তাঁদের শৌর্যবীর্যের কারণে স্মরণ করি। মিসরে ফারাও রামসেস (খ্রিষ্টপূর্ব ১৪-১৩ শতক), মেসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার, ভারতের সম্রাট অশোক প্রমুখ। আরও অনেকেই ছিলেন কিন্তু সব দেশেই, সব অঞ্চলেই রাজবংশের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন—এমন রাজার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। মধ্য যুগে সামন্ত রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসংখ্য রাজবংশের রাজা কিংবা সম্রাট শাসন করে গেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে খুব কমই যোগ্য উত্তরাধিকার হতে পেরেছেন। ফরাসি দার্শনিক মহামতি ভলতেয়ার নিজ দেশ ফ্রান্সে বুরবো রাজবংশের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের শাসনকে সমালোচনা করে বলেছিলেন, লুই একাই ফ্রান্সের জন্য যা করেছেন তা পূর্ববর্তী ২০ জন লুইও করতে পারেননি। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশে দেশে মধ্যযুগে পরিবারতন্ত্রের শাসন ছিল। সব দেশেই দু-একজন রাজা বা সম্রাটের নাম ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতির তালিকায় রয়েছে। ভারতবর্ষেও অনেক রাজবংশের শাসক ছিলেন। কয়েকজনের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্রাট আকবর কেবল পেরেছেন মহামতি উপাধিতে ভূষিত হতে। আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়। সেখানেও লিজেন্ড বা কিংবদন্তি নেতা হিসেবে সব দেশেই কয়েকজন নেতার নাম সবাই স্মরণ করে। কিন্তু আধুনিক কালের রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র, আদর্শ, উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক কাঠামো, ইত্যাদি গণতান্ত্রিকভাবে সবার মতামতের ভিত্তিতে প্রণয়ন ও পরিমার্জন করা হয়ে থাকে। দলের নেতৃত্বও সেভাবেই নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলো এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সেখানে দলীয় প্রধান কিংবা আঞ্চলিক নেতৃত্ব সাংগঠনিকভাবেই নির্বাচিত হয়ে থাকে। তারপরও পারিবারিক পরিচয়ে কেউ কেউ পদপদবি পেয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
আমাদের দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির যাত্রা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হলেও গণতন্ত্রের ধারণা এবং চর্চায় এখনো যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে। সমাজব্যবস্থার মধ্যে সামন্ত জমিদার পরিবার, ধর্মীয় পীর তান্ত্রিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করার মনোভাব এখনো ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আধুনিক শিক্ষার যেমন অভাব রয়েছে, মানুষের বিশ্বাসের মধ্যেও যুক্তিবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপক ঘাটতি নিয়েই আমাদের এই অঞ্চলের দেশগুলোয় চলতে হচ্ছে। ভারত শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চর্চা করলেও রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এখনো পুরোনো বোধ, বিশ্বাস এবং সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সে কারণেই সেখানেও রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের মোহমুক্তি ঘটেনি। কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবস্থান দেখা যায়। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এর থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি। তবে রক্তের সম্পর্কের কেউ রাজনীতিতে হাল ধরলেই যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, তেমনটি সব সময় সঠিক না-ও হতে পারে। বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কখনো তাঁর সন্তানদের কাউকে আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার হিসেবে ভাবেননি। কিন্তু পঁচাত্তরের পর যে রাজনৈতিক আরোপিত শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা পাঁচ বছরেও চেষ্টা করে এক মোহনায় যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনাকে দলের প্রধানের দায়িত্বে সর্বসম্মতভাবে আনা হয়। তিনি প্রবাসে অনেকটা নির্বাসিত থেকে দেশে এসে দলের হাল ধরলেন। তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতা পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সাহচর্য, ছাত্ররাজনীতি, বিদেশে বসে দেশকে দেখাশোনা এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির খোঁজখবর রাখার অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। রাজনীতি সচেতন শেখ হাসিনা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুধু দলকেই নয়, জনগণকেও তৈরি করার ক্ষেত্রে নিরন্তর লড়াই করেছেন। তারপরও তাঁর রাজনীতির পথচলা, হাল ধরা, নেতৃত্ব দেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। সে কারণে তাঁকে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রোডাক্ট হিসেবে মোটেও অভিহিত করা যায় না। তিনি প্রায় ২০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তাঁর রাজনীতির উত্তরাধিকারের ব্যাপারেও পিতার মতোই নীরবতা পালন করছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে দলের হাল ধরতে দেখে বিএনপির একটি অংশ খালেদা জিয়াকে ১৯৮২ সালে দলের রাজনীতিতে যুক্ত করলেও ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়ার কোনো ধরনের পূর্ব রাজনৈতিক সংযুক্তি ছিল না। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি রাজনীতিতে এলেন এবং ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চমকও দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বড় পুত্র তারেক রহমান দলের প্রভাব বিস্তারকারী পদে অধিষ্ঠিত হন, হাওয়া ভবন খুলে সমান্তরাল সরকার পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সাল থেকে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে বিদেশে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় পার্টিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পর তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জি এম কাদেরের সঙ্গে দলের ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, সম্প্রতি সেই দ্বন্দ্বে দল বিভক্ত হয়ে যায়। কত দিন এই দল টিকে থাকবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এর মূলে রয়েছে নিরেট পারিবারিক উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আগমন যে শূন্যতা পূরণ করেছে, তাতে ছিল আদর্শের রাজনীতিকে বহন করা। তিনি দেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, সেখানে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ক্যারিশমা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মানসিকতা। এটি অন্যদের ক্ষেত্রে একেবারেই তুলনাযোগ্য নয়। এখন যাঁরা আওয়ামী লীগেই পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাঁদের কজন দলের দুর্দিনে থাকবেন, সেটা বলা মুশকিল। রাজনীতিতে মহৎ আদর্শকে ধারণ করে বেড়ে উঠতে হয়, যোগ্যতার প্রমাণও দিতে হয়। তাহলেই কেবল রক্ত ও আদর্শের যথার্থ উত্তরাধিকার হওয়া যায়। কৃত্রিমভাবে কেউ আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের নেতা হলে আওয়ামী লীগই তাঁদের ভারে মহা সংকটে পড়তে বাধ্য হবে।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৩ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৭ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৭ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৭ দিন আগে