মোজাম্মেল হোসেন
সংবাদমাধ্যমে যখন প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, সংঘর্ষে মানুষ হতাহত হওয়ার খবর থাকে, তখন কিছু লোকের হামলায় এক ব্যক্তির আহত-লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পর্যায়ে। বিস্ময়কর বৈকি! এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আশরাফুল হোসেন আলম।
‘হিরো আলম’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি। প্রচলিত গানের সঙ্গে মডেল হয়ে ও অন্য মডেল নিয়ে অতি সাধারণ মানুষের জন্য বিনোদনমূলক ডিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন। তবে দেশের ভদ্র সমাজ তথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের অগ্রসর, সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিমান বিবেচিত মানুষের একটি বড় অংশ তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও উপহাস করে, যা সামাজিক যোগাযোগের ভাষায় ট্রল বা মিম। এহেন ২৮ বছরের যুবক হিরো আলম গত কয়েক মাসে জাতীয় সংসদের বগুড়ায় দুটি ও ঢাকার একটি আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তুলনামূলক ভালো ভোট পেয়ে এখন রীতিমতো পাদপ্রদীপের আলোয়।
গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে একতারা প্রতীক নিয়ে দাঁড়ানো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমকে ভোটের দিন ১৭ জুলাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী কর্মীরা ভোটকেন্দ্রের কাছে ন্যক্কারজনকভাবে রাস্তায় ফেলে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে আহত করেন। স্বভাবতই দেশে এ ঘটনার নিন্দা হয়েছে। তবে ত্বরিত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়।
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস উদ্বেগ প্রকাশসহ এই মর্মে দাপ্তরিক টুইট বার্তা দেন যে, ‘সহিংসতামুক্ত থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রত্যেকের যে মৌলিক মানবাধিকার, তা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করতে হবে।’
হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ঢাকার ১২টি দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন। ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রাত্যহিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই।’ তিনি মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় উৎসাহ দেওয়ার কথা জানান।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ ইতিমধ্যে ছবি দেখে শনাক্ত করে হামলায় জড়িত সাতজনকে আটক করে তদন্ত শুরু করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মঙ্গলবার একই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় হামলাটি আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে ‘একটি আতঙ্কের বার্তা দিচ্ছে’ বলে উল্লেখ করেছে।
বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে হিরো আলম একজন অতি সাধারণ ব্যক্তি, তাঁর হেনস্তায় এত বড় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কারণ দুটি শব্দে ব্যাখ্যা করা যায়। তা হচ্ছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। এ দুটি বিষয় মানবসভ্যতার বর্তমান স্তরে অনেক উচ্চ ভাবাদর্শ, ইতিহাস, অনুশীলন এবং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার আইনি পরিকাঠামো নির্দেশ করে। আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি না। আর বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন ও আসন্ন নির্বাচনের পটভূমিতে এ দুটি বিষয়ে বাংলাদেশের ওপরে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি এখন প্রখর।
২. একটু পেছনে যাওয়া যাক। গত মে মাসে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে সরকারি ও প্রধান বিরোধীদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে থাকে। তখন রবীন্দ্রনাথের গভীর ভাবসমৃদ্ধ ছোট্ট একটি কবিতা মনে পড়ে যায়। ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভক্তিভাজন’: ‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।/ পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,/ মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।’
ভিসা নীতির মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যারা গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে, সেই সব ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা দেওয়া হবে না। বিএনপির নেতারা বলতে থাকেন, এই নীতি শেখ হাসিনার সরকারকে লক্ষ্য করে।কারণ তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মহা কারচুপি করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
সরকারি নেতারা বলতে থাকেন, এই ভিসা নীতি বিএনপিকে লক্ষ্য করে। কারণ তারা নির্বাচন বর্জন ও ভন্ডুল করার সহিংস তৎপরতা চালায়। সে রকম আন্দোলন তারা আর করতে পারবে না।
আমেরিকার একাধিক কর্মকর্তা মুচকি হেসে জানান, কোনো দল বা পক্ষ তাদের চিন্তায় নেই। যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি নিয়েছে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নকে সাহায্য করার জন্য।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়া রোধ করতে আমেরিকার সরকার সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছিল তারও আগে। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর ওই দেশের রাজস্ব বিভাগ ও পররাষ্ট্র দপ্তর আমাদের র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো, ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধ করতে এবং বিদেশে থাকা সম্পত্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
এর দেড় বছর পরে এল মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটার পরে জড়িত থাকার সন্দেহের অধীন সুনির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে। ভিসা নীতি তার চেয়ে ব্যাপক। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি ও কারচুপির ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার জন্য নয়, বরং নজিরবিহীনভাবে আগাম সতর্কীকরণ। যিনি ঘটাবেন, তাঁর ওপরই প্রযোজ্য।
অত্যন্ত স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমেরিকার সরকার ধারাবাহিকভাবে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের পরে দুটি সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে। গত দুই বছরে ওয়াশিংটন ও ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও একাধিক কর্মকর্তা পর্যায়ে অনেক আলোচনা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার নেতৃত্বে চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ১১-১৪ জুলাই ঢাকা সফর করে গেলেন। নির্বাচনের ছয় মাস আগে এটি গুরুত্বপূর্ণ সফর, যার প্রতি সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের নিবিড় নজর ছিল। দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও একাধিক পৃথক ও যৌথ বৈঠক করেছে।
সংবাদমাধ্যম সক্রিয় থাকায় অনেক খবর বেরিয়েছে, উভয় পক্ষের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা অনেক কথাই বলেছেন, যা খবর পড়ার মাধ্যমে সবাই জানেন। আজরা জেয়া সংবাদ ব্রিফিংয়ে, টুইটারে, সাক্ষাৎকারে যা কিছু বলেছেন, তার সারকথা হলো—বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা পরিহার করে সুষ্ঠু, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বিরোধীয় বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এটা বাংলাদেশি দলগুলো সংলাপে বসে ফয়সালা করবে বলে তারা আশা করে। তিনি বলেছেন, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই।’
এ রকম স্পষ্ট বক্তব্যের পরেও এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়ে যাওয়ার পরে নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। এটা স্বাভাবিক। তবে আমরা আবার দেখতে পাচ্ছি সেই ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি’র মতো প্রতিক্রিয়া। সরকারি নেতারা বলছেন, সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেরই ব্যবস্থা করছে, যা আমেরিকা চায়। তাই কোনো সমস্যা নেই। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন, কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, এখন ব্যবধান দূর হয়েছে।
আর বিএনপির নেতারা বলছেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকারের ওপর আমেরিকানদেরও বিশ্বাস নেই বলেই তাঁরা এখানে এসেছেন। এ কথা বলেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
আজরা জেয়ার টিম বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেনি। বিএনপি রাস্তার আন্দোলনে থাকলেও তাদের রাষ্ট্রীয় কোনো অবস্থান নেই। কী বুঝে গেলেন আজরা জেয়া? প্রকাশ্য কথাবার্তার বাইরে বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে কূটনৈতিকভাবে বিশেষ কোনো বার্তা তিনি যদি দিয়ে থাকেন, তা আমাদের জানার উপায় নেই, ভবিষ্যতে পরিষ্কার হবে। বিদেশিদের সব আকাঙ্ক্ষা, চাপ, কারও কারও ভাষায় হস্তক্ষেপ বা নাক গলানোর ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিকার ও আমাদের জবাব হলো অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাস্তবায়ন করা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সংবাদমাধ্যমে যখন প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, সংঘর্ষে মানুষ হতাহত হওয়ার খবর থাকে, তখন কিছু লোকের হামলায় এক ব্যক্তির আহত-লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পর্যায়ে। বিস্ময়কর বৈকি! এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আশরাফুল হোসেন আলম।
‘হিরো আলম’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি। প্রচলিত গানের সঙ্গে মডেল হয়ে ও অন্য মডেল নিয়ে অতি সাধারণ মানুষের জন্য বিনোদনমূলক ডিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন। তবে দেশের ভদ্র সমাজ তথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের অগ্রসর, সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিমান বিবেচিত মানুষের একটি বড় অংশ তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও উপহাস করে, যা সামাজিক যোগাযোগের ভাষায় ট্রল বা মিম। এহেন ২৮ বছরের যুবক হিরো আলম গত কয়েক মাসে জাতীয় সংসদের বগুড়ায় দুটি ও ঢাকার একটি আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তুলনামূলক ভালো ভোট পেয়ে এখন রীতিমতো পাদপ্রদীপের আলোয়।
গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে একতারা প্রতীক নিয়ে দাঁড়ানো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমকে ভোটের দিন ১৭ জুলাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী কর্মীরা ভোটকেন্দ্রের কাছে ন্যক্কারজনকভাবে রাস্তায় ফেলে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে আহত করেন। স্বভাবতই দেশে এ ঘটনার নিন্দা হয়েছে। তবে ত্বরিত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়।
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস উদ্বেগ প্রকাশসহ এই মর্মে দাপ্তরিক টুইট বার্তা দেন যে, ‘সহিংসতামুক্ত থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রত্যেকের যে মৌলিক মানবাধিকার, তা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করতে হবে।’
হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ঢাকার ১২টি দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন। ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রাত্যহিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই।’ তিনি মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় উৎসাহ দেওয়ার কথা জানান।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ ইতিমধ্যে ছবি দেখে শনাক্ত করে হামলায় জড়িত সাতজনকে আটক করে তদন্ত শুরু করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মঙ্গলবার একই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় হামলাটি আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে ‘একটি আতঙ্কের বার্তা দিচ্ছে’ বলে উল্লেখ করেছে।
বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে হিরো আলম একজন অতি সাধারণ ব্যক্তি, তাঁর হেনস্তায় এত বড় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কারণ দুটি শব্দে ব্যাখ্যা করা যায়। তা হচ্ছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। এ দুটি বিষয় মানবসভ্যতার বর্তমান স্তরে অনেক উচ্চ ভাবাদর্শ, ইতিহাস, অনুশীলন এবং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার আইনি পরিকাঠামো নির্দেশ করে। আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি না। আর বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন ও আসন্ন নির্বাচনের পটভূমিতে এ দুটি বিষয়ে বাংলাদেশের ওপরে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি এখন প্রখর।
২. একটু পেছনে যাওয়া যাক। গত মে মাসে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে সরকারি ও প্রধান বিরোধীদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে থাকে। তখন রবীন্দ্রনাথের গভীর ভাবসমৃদ্ধ ছোট্ট একটি কবিতা মনে পড়ে যায়। ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভক্তিভাজন’: ‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।/ পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,/ মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।’
ভিসা নীতির মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যারা গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে, সেই সব ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা দেওয়া হবে না। বিএনপির নেতারা বলতে থাকেন, এই নীতি শেখ হাসিনার সরকারকে লক্ষ্য করে।কারণ তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মহা কারচুপি করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
সরকারি নেতারা বলতে থাকেন, এই ভিসা নীতি বিএনপিকে লক্ষ্য করে। কারণ তারা নির্বাচন বর্জন ও ভন্ডুল করার সহিংস তৎপরতা চালায়। সে রকম আন্দোলন তারা আর করতে পারবে না।
আমেরিকার একাধিক কর্মকর্তা মুচকি হেসে জানান, কোনো দল বা পক্ষ তাদের চিন্তায় নেই। যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি নিয়েছে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নকে সাহায্য করার জন্য।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়া রোধ করতে আমেরিকার সরকার সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছিল তারও আগে। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর ওই দেশের রাজস্ব বিভাগ ও পররাষ্ট্র দপ্তর আমাদের র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো, ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধ করতে এবং বিদেশে থাকা সম্পত্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
এর দেড় বছর পরে এল মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতি। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটার পরে জড়িত থাকার সন্দেহের অধীন সুনির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে। ভিসা নীতি তার চেয়ে ব্যাপক। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি ও কারচুপির ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার জন্য নয়, বরং নজিরবিহীনভাবে আগাম সতর্কীকরণ। যিনি ঘটাবেন, তাঁর ওপরই প্রযোজ্য।
অত্যন্ত স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমেরিকার সরকার ধারাবাহিকভাবে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের পরে দুটি সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে। গত দুই বছরে ওয়াশিংটন ও ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও একাধিক কর্মকর্তা পর্যায়ে অনেক আলোচনা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার নেতৃত্বে চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ১১-১৪ জুলাই ঢাকা সফর করে গেলেন। নির্বাচনের ছয় মাস আগে এটি গুরুত্বপূর্ণ সফর, যার প্রতি সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের নিবিড় নজর ছিল। দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও একাধিক পৃথক ও যৌথ বৈঠক করেছে।
সংবাদমাধ্যম সক্রিয় থাকায় অনেক খবর বেরিয়েছে, উভয় পক্ষের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা অনেক কথাই বলেছেন, যা খবর পড়ার মাধ্যমে সবাই জানেন। আজরা জেয়া সংবাদ ব্রিফিংয়ে, টুইটারে, সাক্ষাৎকারে যা কিছু বলেছেন, তার সারকথা হলো—বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা পরিহার করে সুষ্ঠু, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বিরোধীয় বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এটা বাংলাদেশি দলগুলো সংলাপে বসে ফয়সালা করবে বলে তারা আশা করে। তিনি বলেছেন, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই।’
এ রকম স্পষ্ট বক্তব্যের পরেও এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়ে যাওয়ার পরে নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। এটা স্বাভাবিক। তবে আমরা আবার দেখতে পাচ্ছি সেই ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি’র মতো প্রতিক্রিয়া। সরকারি নেতারা বলছেন, সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেরই ব্যবস্থা করছে, যা আমেরিকা চায়। তাই কোনো সমস্যা নেই। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন, কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, এখন ব্যবধান দূর হয়েছে।
আর বিএনপির নেতারা বলছেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকারের ওপর আমেরিকানদেরও বিশ্বাস নেই বলেই তাঁরা এখানে এসেছেন। এ কথা বলেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
আজরা জেয়ার টিম বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেনি। বিএনপি রাস্তার আন্দোলনে থাকলেও তাদের রাষ্ট্রীয় কোনো অবস্থান নেই। কী বুঝে গেলেন আজরা জেয়া? প্রকাশ্য কথাবার্তার বাইরে বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে কূটনৈতিকভাবে বিশেষ কোনো বার্তা তিনি যদি দিয়ে থাকেন, তা আমাদের জানার উপায় নেই, ভবিষ্যতে পরিষ্কার হবে। বিদেশিদের সব আকাঙ্ক্ষা, চাপ, কারও কারও ভাষায় হস্তক্ষেপ বা নাক গলানোর ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিকার ও আমাদের জবাব হলো অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাস্তবায়ন করা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে