আগুন নিয়ে খেলা

চিররঞ্জন সরকার
Thumbnail image

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন, ‘বাজার থেকে বঙ্গবাজার—সবখানেই আগুন। এই আগুন শোষকদের ঘরে কবে লাগবে?’ রাজধানীর বঙ্গবাজার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছে।

এখানে কেন বারবার আগুন লাগে, কারা লাগায়, আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কেন এত সীমাবদ্ধতা, রাজধানীতে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে খুন করা হয়েছে কেন, ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না কেন, এমনি নানা প্রশ্ন মানুষের মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ভয়াবহ আগুনে পুড়ে পুরো বঙ্গবাজার ছাই হয়ে গিয়েছিল। সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১৮ সালেও আরেকবার আগুন লেগেছিল। তখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল কম।

১৯৯৫ সালে আগুন লাগার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, আর এবার করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের। তদন্ত কমিটি গঠন ও রিপোর্ট নিয়ে কী হয়, তা নিয়ে আলোচনা না করাই মঙ্গল।

আমাদের দেশে অফিস, মার্কেট, কারখানায় আগুন লাগবে, কিছুদিন কোলাহল হবে, কিছু মানুষ সরব হবেন, তারপর নতুন বিষয়ের ছাইয়ে পুরোনো আগুন চাপা পড়ে যাবে—এমনটাই যেন নিয়ম। একেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তারপরই দেশবাসী নিয়ম করে শোনেন সুরক্ষার আশ্বাস। প্রতিবার জানানো হয়, বস্তি, মার্কেট, গুদাম, বাসভবন, বহুতল এবং বড় দপ্তর, বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর নজরদারি হবে; বিধি না মানলে হবে জরিমানা। কিন্তু পরবর্তী অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়, এসব অঙ্গীকারের কোনোটাই পালিত হয়নি। এ যেন আগুন নিয়ে খেলা!

আগুনের আলোচনাও খুব একটা সুখকর নয়। কারণ, আগুন সর্বনাশা, ভয়াবহ। কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, ‘আগুন আর কতটুকু পোড়ে? সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ, মানুষের মতো আর অত নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস। আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে কিছু থাকে, হোক না তা ধূসর শ্যামল রং ছাই, মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না কিচ্ছু থাকে না, খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই’। আর ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার লিখেছেন, ‘ছাইটা হলো স্মৃতি আর আগুনটা বর্তমান’। আমরা আপাতত আগুন ও ছাই দুটো নিয়েই আছি। অগ্নি, আগুন, বহ্নি, অনল, পাবক, দাহন। একই জিনিসের ভিন্ন নাম। মানুষের জীবনে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্মার মতো অগ্নি সর্বভূতে বিরাজমান। আধুনিক যুগেও খাবার তৈরি, তাপ ও আলো দেওয়ার পাশাপাশি আগুন কখনো মোমবাতি বা মশাল প্রতিবাদের প্রতীক, আবার কখনো ফানুস বা আতশবাজিতে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের আজকের মানুষে পরিণত হওয়ায় আগুনের ভূমিকা অপরিসীম।

একসময় আমাদের এই উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা চালু ছিল। স্বামী মরে গেলে স্ত্রীকেও চিতায় উঠতে হতো। রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মহামহিম ব্যক্তির কল্যাণে সমাজ থেকে সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা উঠে গেছে। তবে যুগের পরিবর্তনে ‘পতিহারা সতী নারী’ নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্ছেদের নামে আগুন দেওয়া হয় গরিবের আবাস বস্তিতে। সতীদাহ হতো প্রকাশ্যে। আর বস্তিদাহ করা হয় গোপনে। তবে শুধু বস্তিতেই আগুন দেওয়া হয় না, বিভিন্নজনের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি অফিসেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুন এখন স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। ক্ষোভ প্রকাশ, ষড়যন্ত্র নথিপত্র গায়েব করার জন্য আগুন ধরিয়ে দেওয়া একটি লাগসই ‘প্রযুক্তি’ হয়ে উঠেছে। তবে এখন আগুন বস্তি ছেড়ে বড় বড় অট্টালিকাকেও টার্গেট করেছে। আগুন যে সব সময় লাগানো হয়, তা নয়। অনেক সময় আগুন লেগেও যায়। বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে থাকে ‘শর্টসার্কিট’।

যদিও আগুন নিয়ে রসিকতা, আলোচনা, মত-মন্তব্য সবকিছুই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, আগুন বড়ই মারাত্মক। আগুন জ্বলে। জ্বালায়। আগুন লাগে। আবার লাগানোও হয়। কোনটা যে লাগে আর কোনটা যে লাগানো হয়—এই রহস্যঘেরা দেশে এটা বেশির ভাগ সময়ই জানা যায় না।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা রকম আগুনের দেখা পাই। চুলার আগুন। চিতার আগুন। বনের আগুন, মনের আগুন, ক্ষোভের আগুন, লোভের আগুন, দেহের আগুন, চোখের আগুন। জ্ঞাত আগুন, অজ্ঞাত আগুন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন। এই ‘শর্টসার্কিটের আগুন’ খুবই অভিনব ও রহস্যময়। আগুন লাগার পর যদি তার উৎস সম্পর্কে কোনো রকম কূল-কিনারা করা না যায়—তখনই বলা হয়, এটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন! আমাদের দেশে অনেক সময় শ্বশুরবাড়িতে মেয়েদের মেরে-পিটিয়ে হত্যা করে যেমন ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানো হয়, আগুন লাগানোর বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে ‘শর্টসার্কিট’ হিসেবে দেখানো হয়! বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন সত্যিই অনেক ধন্বন্তরি। বহু ষড়যন্ত্রকারীর পিঠের চামড়া বাঁচাতে তা যুগে যুগে ভূমিকা পালন করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগুনকে যে ভয় পায়, সে আগুনকে ব্যবহার করতে পারে না।’ কথাটা খুবই সত্যি। আমরা আগুনের যথাযথ ব্যবহার শিখিনি। শিখিনি আগুনের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। তাই আগুনকে ভয় পাওয়া শুরু করেছি। পুরো ঢাকা শহরেই চলছে আগুন-আতঙ্ক। গত কয়েক বছরে বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও শতাধিক লোকের প্রাণহানির ঘটনার পর এই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বড় বড় বিল্ডিং, ঘরবাড়ি, মার্কেটের এই আগুন মানুষের মনের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছে। এক ভদ্রলোক তো ঢাকাইয়া ভাষায় এক গণমাধ্যমে বিশাল ক্ষোভ ঝেড়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘হগলে মিল্লা আমরা পুরান ঢাকার কথা কই, নতুন ঢাকার কথা কইব কেডায়। পুরান ঢাকায় বাড়ির ভেতরে গোডাউন, কেমিক্যালের গোডাউন। একেকটা বাড়ি একেকটা বোমা...বাড়িমালিকেরা মানুষ না, সব টেকার কুমির, সব খাচ্চর। চিকন চিকন গলি, গাড়ি যাওনের রাস্তা নাই। হাডনের জায়গা নাই।

মাইনসে সংসার করে বউ পোলাপাইন লইয়া না, বোমা লইয়া...আগুন লাগলে সব পুইড়া মরে। কারণ ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওনের রাস্তা নাই, পানি দেওনের পানি নাই। মাইনষে খালি মরে আর মরে। হগলে মিল্লা পুরান ঢাকা লইয়া কথা কইছেন, নতুন ঢাকা লইয়া কথা নাই। নতুন ঢাকায় বিল্ডিং আসমান ছুঁইতেছে।

বিল্ডিংয়ের তলা গুনতে গুনতে ঘাড়ে বিষ করে, চোক্ষে ঝাপসা লাগে। নয়া নয়া বিল্ডিং চকচক, ঝকঝক করতাছে। বড় লোকের বিরাট কারবার। বছর দুই আগে একবার সরকার চাইছিল নতুন ঢাকার সব বাড়িত থেইক্কা সব দোহানপাট তুইল্যা দিব, পারে নাই। পুরান ঢাহার মানুষ মরে পুইড়া, নতুন ঢাহায় মানুষ মরে লাফাইয়া পইড়া। মরার ধরনে খালি তফাত। মোডের ওপরে কথা হইল মানুষ মরতাছে। আর হগলে ঢাকায় মরতাছে।’

আগুনের ব্যাপারে আমাদের আসলে আরও সাবধানি হওয়া উচিত। আগুন, যার একটাই গুণ—কেবল জ্বালাতেই জানে। এই আগুনের ক্ষুধা এতটাই একপক্ষীয় ঘটনা যে জান-মালসহ কিছুই আর অবশিষ্ট রাখে না। আগুন আর লোভ বাড়তে দিলে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে দুটোই। কাজেই আগুন যেন না লাগে, তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করতে হবে এখনই। তা না হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই একদিন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে!

পুনশ্চ: একদিন সকালে এক লোকের ঘুম ভাঙল খুবই বাজে একটা স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে: সে স্বপ্ন দেখেছে তার ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে। দাউ দাউ করে তার ফ্ল্যাটটা জ্বলছে।

নাশতা করতে করতে সে ভাবল, কোনো কারণে তার ফ্ল্যাটে সত্যিই যদি আগুন লাগে, তাহলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে সবকিছু। জিনিসপত্র, আসবাব, জমির দলিল, তার যাবতীয় সহায় সম্পদ!…

‘একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলবে, সবকিছু পুড়ে ছাই হবে’—ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবল সে। অফিসে খুবই অসুস্থ সময় কাটল তার। সারাক্ষণ মনে হতে থাকল: ‘নিশ্চয়ই এখন ফ্ল্যাটটা পুড়ছে।

আগুন লাগার খবর পেলে লোকে যেভাবে ছোটে, সেই গতিতে সে ফিরল বাসায়। ‘এরই মধ্যে নির্ঘাত পুড়ে গেছে আমার ফ্ল্যাট!’—ফিরতে ফিরতে মনে হয়েছিল তার। যখন সে ঘরে ঢুকল, আগুনের কোনো চিহ্নও ছিল না সেখানে।

তখন সে নিজেই আগুন ধরাল ঘরে। তারপর প্রতিবেশীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল: আমি ঠিকই জানতাম, এভাবে দাউ দাউ করে জ্বলবে, সবকিছু পুড়ে ছাই হবে!

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত