অর্ণব সান্যাল
সাহিত্যের বিচারে আমরা কিছুটা এগিয়েছি বটে। আমাদের নিজস্ব প্রকাশনাশিল্প সৃষ্টি হয়েছে, যদিও তা রুগ্ণ বেশ। লেখক তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু তার কতটুকু ‘কালজয়ী’ বা ‘দেশজয়ী’, তা নিয়ে সন্দেহ ভালোমতোই আছে। আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহিদুল জহিরদের মতো অনেককে দেশবাসী সময়মতো চিনতেই পারছে না। কারণ অবশ্যই পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসম বিকাশ। সেই বিকাশ সমাজ ও অর্থনীতির পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও অসমভাবেই হয়েছে।
আমাদের সাহিত্য পুরস্কারগুলো দিনকে দিন স্বজন ও রাজনীতিপ্রীতির চূড়ান্ত প্রদর্শনীর জায়গা হচ্ছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষিত হওয়ার পরই এ নিয়ে গুঞ্জন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে, সেলফ সেন্সরশিপে কলম (বা কি-বোর্ড) বেঁধে না রেখে কয়জনই বা সাহিত্যচর্চা করেন? ফলে আকালের দিনে আমরা পুষ্পশোভিত সকালের ছবি দেখি, পেটে ক্ষুধা নিয়ে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের গল্প শুনি।
অন্যদিকে এমন ধারার সাহিত্যকর্ম সংখ্যায় বেশি হওয়ায়, ব্যতিক্রমগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। আবার অনুবাদ সাহিত্যে দখলের প্রমাণ শক্তিশালী না হওয়ার দরুন একদিকে আমরা যেমন বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকছি না, ঠিক তেমনি বাকি বিশ্বও আমাদের সংখ্যার বিচারে কিঞ্চিৎ মানসম্পন্ন সাহিত্য সম্পর্কেও অবগত হচ্ছে না। এ দেশে বেশ কয়েক দশক ধরেই নতুন সাহিত্যকর্মের বিচার হচ্ছে বাজারে বিকিকিনির পরিমাণে, বইমেলা থেকে করা ফেসবুক লাইভের ওয়াচিং লিস্টের সমাগমে। সেসবের মান নিয়ে উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা করছে না কেউ বৃত্তচ্যুত হওয়ার ভয়েই। দেশের বিভিন্ন বিষয়ের মতো শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও আমরা পছন্দের বৃত্ত রচনার এক অবিনাশী ‘কালচার’ চালু করেছি। এসব ভাঙা দূরের কথা; বরং এর শনৈঃশনৈ বৃদ্ধিতে এই ‘আমাদের’ অবদান দিনকে দিন বাড়ছেই!
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নামক রচনায় এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন আহমদ ছফা। তিনি আঙুল তুলেছিলেন কলকাতার পত্রপত্রিকার দিকে এবং জোর দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে ‘নানা বিষয়ে অনেকগুলো সাময়িকপত্রের আত্মপ্রকাশের’ ওপর। ছফার ভাষায়, ‘কিন্তু তা হচ্ছে না, বিনিময়ে কোলকাতার পত্রপত্রিকা এসে আমাদের বাজার ছেয়ে ফেলছে।’ ছফা একদিকে বলেছেন, তিনি কলকাতার পত্রপত্রিকা আসার বিরোধী নন। আবার অন্যদিকে বলেছেন, ‘ওই দেশের সব পত্রপত্রিকা ব্যাপক হারে আমাদের দেশে আসতে থাকলে আমাদের দেশে সাময়িকপত্রের জন্ম এবং বিকাশ অনেক কারণে বিঘ্নিত হবে।’
তাঁর মূল আপত্তি ছিল, এ দেশে কলকাতার পত্রপত্রিকার একাধিপত্য সৃষ্টির বিষয়টিতে। অন্যতম অভিযোগ ছিল, কলকাতার পত্রপত্রিকা ‘কাটতি’ভিত্তিক। এক অর্থে এ দেশে পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা আসার বিরোধী ছিলেন ছফা। বাহাত্তরের পরও তিনি বইমেলাকে কেন্দ্র করেও এমন বিরোধিতা করেছিলেন বলে সুবিদিত আছে। এ অনেকটা মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো। এই একই ধরনের প্রতিবাদ আমরা পরবর্তী সময়ে এ দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনেও দেখতে পেয়েছি, যখন বিদেশি চলচ্চিত্র (বিশেষ করে ভারতীয় চলচ্চিত্র) প্রদর্শনের বিরোধিতা করে আন্দোলন হয়। ছফা যেভাবে এ দেশের সাহিত্য অঙ্গনকে রক্ষার জন্য সংরক্ষণবাদী হতে চেয়েছিলেন, সেভাবে আদৌ কিছু সংরক্ষণ করা যায়? সেই যুক্তিতে তো এক অর্থে বিশ্বসাহিত্য থেকেও দূরে থাকা যায়! কারণ তাতেও যে আমাদের নিজেদের সাহিত্য ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়!
এ দেশে অসংখ্য সাময়িকপত্রের যে প্রয়োজন ছিল এবং এখনো আছে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এখানে বিভিন্ন সময় সেই চেষ্টা হয়েছেও বটে। কিন্তু বরাবরই তা থমকে গেছে ওই কাটতির বিচারেই, স্থূলভাবে বললে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এবং কিছু ক্ষেত্রে আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের পরস্পরের পিঠ চুলকানো ও একে-অপরের পেছনে লাগার নীতির কারণে। বুদ্ধিজীবী মহলে এই দুই নীতিই একটি সাধারণ বিষয়। অন্যান্য দেশেও এমনটা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মতো সাহিত্যচর্চা মানেই এ দুটিকেই ‘মূল’ ভেবে নেওয়া কবি-সাহিত্যিক সমাজ একাধিক পাওয়া ভার। বর্তমানে এই লক্ষণ আরও প্রকট হয়েছে।
আহমদ ছফার এই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের এ দেশে সঞ্চালনের ঘোরতর বিরোধিতা কি দেশভাগের আগের তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের ফলাফল? হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। পশ্চিমবঙ্গের বাবু কালচারের সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সের অন্যতম প্রধান শিকার পূর্ববঙ্গ হয়েছিল, সাহিত্য-রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই। হয়তো সেটিই ছফার মনে গেড়ে বসেছিল। নইলে তিনি হয়তো মান দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে চাইতেন, খালি মাঠে গোল দিতে নয়।
আর যা-ই হোক, দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রম বা বিভ্রম বা সত্য—কোনোটাই রোখার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।সংরক্ষণনীতি গ্রহণের এই প্ররোচনা হয়তো আহমদ ছফা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম অক্ষশক্তি সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া থেকেই পেয়েছিলেন। পাওয়াটা স্বাভাবিকও। তবে এ দেশের সমাজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সেটি কতটুকু যুক্তিসংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বের পণ্য ও নীতির প্রতি একধরনের অন্ধ বিরোধিতা এবং নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। সেই সংরক্ষণবাদী ব্যবস্থায় সোভিয়েত রাশিয়ার কিঞ্চিৎ উপকার বাদে অপকারিতাই হয়েছে বেশি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হলো নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ। এই মানবচরিত্রকে অস্বীকার করে কোনো ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যই সফল হওয়ার নয়।
তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মতো তুর্কি দেশে কামাল আতাতুর্কের আনা সমাজবিপ্লবের প্রতিও অকুণ্ঠ প্রশংসা ধরা পড়ে আহমদ ছফার লেখায়। এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার বারবার উল্লেখপূর্বক এ দেশে তেমনি নতুন ঘরানার বিপ্লব আনার প্রয়োজনীয়তার কথা ছফা তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই দুই ঘটনার সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র আসলে কতটুকু? এ দেশের জন্ম কোনো জার বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হয়নি; বরং একটি শোষণমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হয়েছে। ফলে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সমস্যা হলো, এ দেশে যেকোনো বিপ্লব প্রচেষ্টা বা পরিবর্তন-প্রক্রিয়াই অন্যের ‘কপি ক্যাট’ দোষে দুষ্ট। ফলে কখনোই নিজস্ব কোনো দর্শন আমরা তৈরি করতে পারিনি এবং এই অক্ষমতার কারণেই আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ইতিহাস অনেকাংশেই অনুকরণের ইতিহাস। তাতে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তাও বেশ কম তাই অনুমিতভাবেই। এই একই কথা অবশ্য ছফাও স্বীকার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করছি। আমাদের সব দিকে উদ্ভাবনীশক্তির উদ্বোধনের বদলে আমরা অপরের অনুকরণ করে আত্মপ্রবঞ্চনা করছি। ভালো জিনিস অনুকরণ করার মধ্যে দোষের কিছু নেই, কিন্তু অন্ধ অনুকরণটা কি কখনো ভালো?’
এককথায় তবে বর্তমানে এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসটি কেমন? নিজেকে জড়িয়েই উদাহরণ দিই। ১৯৭২ সালে লেখা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ ছফা সদ্য জন্ম নেওয়া একটি দেশে কী ধরনের ধর্মীয় সংস্কার প্রয়োজন, তা নিয়েও বিস্তর কথা বলেছিলেন। তাঁর অন্যতম মন্তব্য ছিল, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, তার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। এখন সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে বাংলাদেশের ধর্মের বদ্ধমতগুলো উড়িয়ে দিতে পারলে মানুষে মানুষে অন্তরের মিলনটা সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।’ ছফা মনে করেছিলেন, মানুষ শুধু মানুষ—এই পরিচয়ে চিহ্নিত করার সর্বাঙ্গীণ প্রয়াস ও প্রক্রিয়াটি দেশে শুরু হয়েছিল।
কিন্তু ঠিক ৫০ বছর পরে এসে এই আমি ছফার বাহাত্তরে লেখা ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কারবিষয়ক আলোচনায় ঢুকতে গেলে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনিরাপদ বোধ করতে বাধ্য হই। এই ৫০ বছরের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাকে প্রবলভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ‘ওসব নিয়ে কথা বোলো না, বিপদ আছে!’ আমাকে হামলা দেখানো হয়েছে, রক্ত দেখানো হয়েছে, বইমেলায় ঘুরতে গিয়ে লাশ হয়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে এবং মনের গহিনে এই গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে—‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!’
এবার আপনারাই নাহয় ঠিক করুন, মানুষ শুধু মানুষ—এই প্রক্রিয়ায় আমরা এগিয়েছি নাকি ব্যাপক পিছিয়ে ফিরে গেছি, অসহনশীল সেই নিষ্ঠুর পুরোনো অযৌক্তিক বাস্তবতায়?
এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে আমাদের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসের প্রকৃত রূপ।
বাহাত্তরের বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ও বর্তমান: ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সাহিত্যের বিচারে আমরা কিছুটা এগিয়েছি বটে। আমাদের নিজস্ব প্রকাশনাশিল্প সৃষ্টি হয়েছে, যদিও তা রুগ্ণ বেশ। লেখক তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু তার কতটুকু ‘কালজয়ী’ বা ‘দেশজয়ী’, তা নিয়ে সন্দেহ ভালোমতোই আছে। আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহিদুল জহিরদের মতো অনেককে দেশবাসী সময়মতো চিনতেই পারছে না। কারণ অবশ্যই পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসম বিকাশ। সেই বিকাশ সমাজ ও অর্থনীতির পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও অসমভাবেই হয়েছে।
আমাদের সাহিত্য পুরস্কারগুলো দিনকে দিন স্বজন ও রাজনীতিপ্রীতির চূড়ান্ত প্রদর্শনীর জায়গা হচ্ছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষিত হওয়ার পরই এ নিয়ে গুঞ্জন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে, সেলফ সেন্সরশিপে কলম (বা কি-বোর্ড) বেঁধে না রেখে কয়জনই বা সাহিত্যচর্চা করেন? ফলে আকালের দিনে আমরা পুষ্পশোভিত সকালের ছবি দেখি, পেটে ক্ষুধা নিয়ে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের গল্প শুনি।
অন্যদিকে এমন ধারার সাহিত্যকর্ম সংখ্যায় বেশি হওয়ায়, ব্যতিক্রমগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। আবার অনুবাদ সাহিত্যে দখলের প্রমাণ শক্তিশালী না হওয়ার দরুন একদিকে আমরা যেমন বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকছি না, ঠিক তেমনি বাকি বিশ্বও আমাদের সংখ্যার বিচারে কিঞ্চিৎ মানসম্পন্ন সাহিত্য সম্পর্কেও অবগত হচ্ছে না। এ দেশে বেশ কয়েক দশক ধরেই নতুন সাহিত্যকর্মের বিচার হচ্ছে বাজারে বিকিকিনির পরিমাণে, বইমেলা থেকে করা ফেসবুক লাইভের ওয়াচিং লিস্টের সমাগমে। সেসবের মান নিয়ে উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা করছে না কেউ বৃত্তচ্যুত হওয়ার ভয়েই। দেশের বিভিন্ন বিষয়ের মতো শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও আমরা পছন্দের বৃত্ত রচনার এক অবিনাশী ‘কালচার’ চালু করেছি। এসব ভাঙা দূরের কথা; বরং এর শনৈঃশনৈ বৃদ্ধিতে এই ‘আমাদের’ অবদান দিনকে দিন বাড়ছেই!
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নামক রচনায় এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন আহমদ ছফা। তিনি আঙুল তুলেছিলেন কলকাতার পত্রপত্রিকার দিকে এবং জোর দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে ‘নানা বিষয়ে অনেকগুলো সাময়িকপত্রের আত্মপ্রকাশের’ ওপর। ছফার ভাষায়, ‘কিন্তু তা হচ্ছে না, বিনিময়ে কোলকাতার পত্রপত্রিকা এসে আমাদের বাজার ছেয়ে ফেলছে।’ ছফা একদিকে বলেছেন, তিনি কলকাতার পত্রপত্রিকা আসার বিরোধী নন। আবার অন্যদিকে বলেছেন, ‘ওই দেশের সব পত্রপত্রিকা ব্যাপক হারে আমাদের দেশে আসতে থাকলে আমাদের দেশে সাময়িকপত্রের জন্ম এবং বিকাশ অনেক কারণে বিঘ্নিত হবে।’
তাঁর মূল আপত্তি ছিল, এ দেশে কলকাতার পত্রপত্রিকার একাধিপত্য সৃষ্টির বিষয়টিতে। অন্যতম অভিযোগ ছিল, কলকাতার পত্রপত্রিকা ‘কাটতি’ভিত্তিক। এক অর্থে এ দেশে পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা আসার বিরোধী ছিলেন ছফা। বাহাত্তরের পরও তিনি বইমেলাকে কেন্দ্র করেও এমন বিরোধিতা করেছিলেন বলে সুবিদিত আছে। এ অনেকটা মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো। এই একই ধরনের প্রতিবাদ আমরা পরবর্তী সময়ে এ দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনেও দেখতে পেয়েছি, যখন বিদেশি চলচ্চিত্র (বিশেষ করে ভারতীয় চলচ্চিত্র) প্রদর্শনের বিরোধিতা করে আন্দোলন হয়। ছফা যেভাবে এ দেশের সাহিত্য অঙ্গনকে রক্ষার জন্য সংরক্ষণবাদী হতে চেয়েছিলেন, সেভাবে আদৌ কিছু সংরক্ষণ করা যায়? সেই যুক্তিতে তো এক অর্থে বিশ্বসাহিত্য থেকেও দূরে থাকা যায়! কারণ তাতেও যে আমাদের নিজেদের সাহিত্য ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়!
এ দেশে অসংখ্য সাময়িকপত্রের যে প্রয়োজন ছিল এবং এখনো আছে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এখানে বিভিন্ন সময় সেই চেষ্টা হয়েছেও বটে। কিন্তু বরাবরই তা থমকে গেছে ওই কাটতির বিচারেই, স্থূলভাবে বললে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এবং কিছু ক্ষেত্রে আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের পরস্পরের পিঠ চুলকানো ও একে-অপরের পেছনে লাগার নীতির কারণে। বুদ্ধিজীবী মহলে এই দুই নীতিই একটি সাধারণ বিষয়। অন্যান্য দেশেও এমনটা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মতো সাহিত্যচর্চা মানেই এ দুটিকেই ‘মূল’ ভেবে নেওয়া কবি-সাহিত্যিক সমাজ একাধিক পাওয়া ভার। বর্তমানে এই লক্ষণ আরও প্রকট হয়েছে।
আহমদ ছফার এই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের এ দেশে সঞ্চালনের ঘোরতর বিরোধিতা কি দেশভাগের আগের তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের ফলাফল? হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। পশ্চিমবঙ্গের বাবু কালচারের সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সের অন্যতম প্রধান শিকার পূর্ববঙ্গ হয়েছিল, সাহিত্য-রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই। হয়তো সেটিই ছফার মনে গেড়ে বসেছিল। নইলে তিনি হয়তো মান দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে চাইতেন, খালি মাঠে গোল দিতে নয়।
আর যা-ই হোক, দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রম বা বিভ্রম বা সত্য—কোনোটাই রোখার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।সংরক্ষণনীতি গ্রহণের এই প্ররোচনা হয়তো আহমদ ছফা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম অক্ষশক্তি সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া থেকেই পেয়েছিলেন। পাওয়াটা স্বাভাবিকও। তবে এ দেশের সমাজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সেটি কতটুকু যুক্তিসংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বের পণ্য ও নীতির প্রতি একধরনের অন্ধ বিরোধিতা এবং নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। সেই সংরক্ষণবাদী ব্যবস্থায় সোভিয়েত রাশিয়ার কিঞ্চিৎ উপকার বাদে অপকারিতাই হয়েছে বেশি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হলো নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ। এই মানবচরিত্রকে অস্বীকার করে কোনো ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যই সফল হওয়ার নয়।
তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মতো তুর্কি দেশে কামাল আতাতুর্কের আনা সমাজবিপ্লবের প্রতিও অকুণ্ঠ প্রশংসা ধরা পড়ে আহমদ ছফার লেখায়। এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার বারবার উল্লেখপূর্বক এ দেশে তেমনি নতুন ঘরানার বিপ্লব আনার প্রয়োজনীয়তার কথা ছফা তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই দুই ঘটনার সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র আসলে কতটুকু? এ দেশের জন্ম কোনো জার বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হয়নি; বরং একটি শোষণমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হয়েছে। ফলে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সমস্যা হলো, এ দেশে যেকোনো বিপ্লব প্রচেষ্টা বা পরিবর্তন-প্রক্রিয়াই অন্যের ‘কপি ক্যাট’ দোষে দুষ্ট। ফলে কখনোই নিজস্ব কোনো দর্শন আমরা তৈরি করতে পারিনি এবং এই অক্ষমতার কারণেই আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ইতিহাস অনেকাংশেই অনুকরণের ইতিহাস। তাতে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তাও বেশ কম তাই অনুমিতভাবেই। এই একই কথা অবশ্য ছফাও স্বীকার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করছি। আমাদের সব দিকে উদ্ভাবনীশক্তির উদ্বোধনের বদলে আমরা অপরের অনুকরণ করে আত্মপ্রবঞ্চনা করছি। ভালো জিনিস অনুকরণ করার মধ্যে দোষের কিছু নেই, কিন্তু অন্ধ অনুকরণটা কি কখনো ভালো?’
এককথায় তবে বর্তমানে এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসটি কেমন? নিজেকে জড়িয়েই উদাহরণ দিই। ১৯৭২ সালে লেখা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ ছফা সদ্য জন্ম নেওয়া একটি দেশে কী ধরনের ধর্মীয় সংস্কার প্রয়োজন, তা নিয়েও বিস্তর কথা বলেছিলেন। তাঁর অন্যতম মন্তব্য ছিল, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, তার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। এখন সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে বাংলাদেশের ধর্মের বদ্ধমতগুলো উড়িয়ে দিতে পারলে মানুষে মানুষে অন্তরের মিলনটা সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।’ ছফা মনে করেছিলেন, মানুষ শুধু মানুষ—এই পরিচয়ে চিহ্নিত করার সর্বাঙ্গীণ প্রয়াস ও প্রক্রিয়াটি দেশে শুরু হয়েছিল।
কিন্তু ঠিক ৫০ বছর পরে এসে এই আমি ছফার বাহাত্তরে লেখা ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কারবিষয়ক আলোচনায় ঢুকতে গেলে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনিরাপদ বোধ করতে বাধ্য হই। এই ৫০ বছরের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাকে প্রবলভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ‘ওসব নিয়ে কথা বোলো না, বিপদ আছে!’ আমাকে হামলা দেখানো হয়েছে, রক্ত দেখানো হয়েছে, বইমেলায় ঘুরতে গিয়ে লাশ হয়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে এবং মনের গহিনে এই গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে—‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!’
এবার আপনারাই নাহয় ঠিক করুন, মানুষ শুধু মানুষ—এই প্রক্রিয়ায় আমরা এগিয়েছি নাকি ব্যাপক পিছিয়ে ফিরে গেছি, অসহনশীল সেই নিষ্ঠুর পুরোনো অযৌক্তিক বাস্তবতায়?
এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে আমাদের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসের প্রকৃত রূপ।
বাহাত্তরের বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ও বর্তমান: ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে