ফারুক মেহেদী ও আবু সাইম, ঢাকা
তিন বছরের করোনা মহামারি। এতে লন্ডভন্ড বাইরের বিশ্ব, বাংলাদেশ। বেঁচে থাকার সঙ্গে অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের লড়াইটাও কঠিন হয়ে যায় বহু মানুষের জন্য। মাজা সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরুর আগেই বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। বিশ্ব মানচিত্রের এক কোণে রাশিয়া-ইউক্রেনের সেই যুদ্ধে আবার টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। বাইরের মতো বাংলাদেশেও হু হু করে বেড়ে গেল জিনিসপত্রের দাম। এর মধ্যে পড়ে মানুষ যখন খাবি খাচ্ছে, তখন ঘোষণা করা হলো নতুন বাজেট।
সুন্দর কথামালায় জড়িয়ে রূপকথার গল্পের মতো ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাস্তবায়ন যা-ই হোক; টাকার অঙ্কে প্রতিবছর নিজের রেকর্ড ভাঙা স্বপ্নবিলাসী অর্থমন্ত্রী ২০৪১ সালে ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে নিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালেন। অথচ দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখন নিত্য দিনযাপনের রসদ জোগাতে প্রায় দিশেহারা। তিনি এমন সময়ে দারিদ্র্য ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা শোনালেন, যখন একটি বিরাট শ্রেণি দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙতে পারছে না। তিনি এমন সময়ে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা দেখাচ্ছেন, যখন তা ১০ শতাংশের কাছাকাছি। কর-জিডিপি অনুপাত ২০ শতাংশে উন্নীত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, অথচ তা এখনো সাড়ে ৭ শতাংশের ঘরে আটকে রয়েছে। তিনি বলেছেন, সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে স্বাস্থ্যসেবা। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। আর গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ।
অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় এভাবেই মানুষকে স্বপ্নের ঘোরে ডোবালেন। অথচ রাত পোহালেই তাঁরা মুখোমুখি হবেন নতুন বাস্তবতায়; যখন জানবেন তাঁদের কারও আয় না থাকলেও শুধু করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর থাকলেই দিতে হবে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর।
অর্থমন্ত্রী ঠিকই স্বপ্ন দেখালেন, অথচ নির্বাচনের বছরেও হাঁটলেন অজনপ্রিয় পথে। বড় বাজেটের খরচ মেটানোর জন্য তিনি আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে এমনভাবে করের জাল বিছালেন, ভোক্তাদের বাজারে গেলেই এর তাপ অনুভব করতে হতে পারে। তাঁরা জানবেন, টিস্যু পেপার থেকে থালাবাসন, কলম থেকে মোবাইল ফোন কিংবা ইট, সিমেন্টসহ প্রতিদিনের ব্যবহার্য অসংখ্য পণ্যে কর, ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে; যার ফলে সীমিত আয়ের মধ্যেও তাদের ঘাড়ে পড়বে বাড়তি খরচের চাপ।
বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এটা করদাতার জন্য কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলেও পরোক্ষ করের খড়্গ করদাতাকে এর চেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলতে পারে।
বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, গৃহস্থালিতে ব্যবহার করা হয় এমন পণ্যসহ টিফিন বক্স, পানির বোতল, অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাসন, রান্নাঘরের সরঞ্জামে বাড়তি ভ্যাট বসানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ খায় এমন খেজুরের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। চশমা ও রোদচশমার শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, পকেট টিস্যু, পেপার টাওয়েলে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। দেশে উৎপাদিত সিলিন্ডারের কাঁচামালে শুল্ক, সিগারেট, তরল নিকোটিন, বাসমতী চালের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। আর উড়োজাহাজে ভ্রমণ করলে দিতে হবে বাড়তি কর। নতুন অর্থবছরে এসব খাত থেকে রাজস্ব আয়ে মরিয়া থাকবে এনবিআর, যার সরাসরি ভুক্তভোগী হবে ভোক্তারা।
নতুন অর্থবছরে নতুন করদাতার খোঁজে ঘরে ঘরে যাবে বেসরকারি খাতের এজেন্ট। এ বিধান করা হয়েছে বাজেটে। এজেন্ট যে কর ঠিক করে দেবে, সেটিই দিতে হবে করদাতাকে। করদাতা যেটুকু কর দেবেন, তার থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাবে এজেন্টরা। এ ধরনের বিধান কর খাতে হয়রানির জন্ম দেবে এবং ঘুষ ও দুর্নীতির সুযোগ বাড়াবে বলে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে নতুন অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডির ব্যবস্থাপনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভ্যাট আদায়েও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ হলো। বিশেষজ্ঞরা এ বিধানেরও সমালোচনা করেছেন। এতেও দুর্নীতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, সাধ্য নেই, তবু নতুন অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করেছেন; যার পুরোটা সংস্থান করতে পারবেন না। ডলার-সংকট, টাকার দরপতন, রপ্তানি-রেমিট্যান্সে মন্দাভাব, আমদানি কড়াকড়িতে উৎপাদনে ধীরগতি, বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতার মতো অসংখ্য অর্থনৈতিক সমস্যা যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমিয়ে দিচ্ছে, তিনি তখন করের বোঝা বাড়িয়ে, ঘরে ঘরে কর আদায়ের এজেন্ট পাঠিয়ে, ইএফডির মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের কাজ বেসরকারি খাত দিয়ে বাড়াতে চান। আর এই করে ভর করে সংস্থান করতে চান পাঁচ লাখ কোটি টাকা। বেশির ভাগটাই এনবিআরের কর রাজস্ব থেকে নিতে চান। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। ভ্যাট থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা আর শুল্ক থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা আদায় করবেন বলে মনে করেন। এত বিপুল করের পুরোটা আদায় হলেও এতে কুলাবে না।
বাজেটের পুরো খরচের জন্য তাঁর আরও ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। এটা তিনি ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎস থেকে ধারকর্জ করে জোগাবেন বলে উল্লেখ করেছেন। চলতি বাজেটেই ঠিকমতো রাজস্ব আয় না হওয়ায় বিপুল অঙ্কের ঋণ নিতে হয়েছে ব্যাংক থেকে। আসছে অর্থবছরে রাজস্ব আয় না বাড়লে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়বে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে কর্মসংস্থান ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে এরই মধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা।
নতুন অর্থবছরে খরচে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলা হলেও ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় ১ হাজার ৩০০ প্রকল্প রয়েছে। যতই বলা হোক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে না, তারপরও এসব প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে। আর নতুন-পুরোনো মেগা প্রকল্প তো রয়েছেই। এসব প্রকল্পের জন্য বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নতুন অর্থবছরেও ঋণ নেওয়া হবে। ঋণের কিস্তি ও সুদ বাবদ বিপুল টাকা ব্যয় হবে আসছে অর্থবছরে।
আর্থিক সংকটের মধ্যে আইএমএফ থেকে শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ভর্তুকি কমাতে হবে। অথচ অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, চাইলেও শিগগির ভর্তুকি তুলে দিতে পারবেন না। এ জন্য সময় লাগবে। তাই নতুন অর্থবছরে বরং ভর্তুকি বেড়েছে। মোট ভর্তুকি পরিকল্পনা করা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। ভর্তুকির এ টাকার বড় অঙ্কই সামাজিক নিরাপত্তা, সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে খরচ করা হবে। অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ভর্তুকি কমানোর জন্য এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া সময়ে সময়ে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের একটি ফর্মুলার পথনকশা তৈরি করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, এ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ নতুন পদ্ধতিতে জ্বালানির দাম সমন্বয় করা যাবে। লোকসান কমাতে ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় করোনা-উত্তর পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থবছর অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জের হবে বলে সতর্কবাণী প্রকাশ করেছেন। তারপরও তিনি নতুন অর্থবছরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে উচ্চাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, আগামী অর্থবছরেও সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবেন। নতুন অর্থবছরে অর্থনীতিতে অস্থিরতা থাকবে উল্লেখ করেও অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার পক্ষে আত্মবিশ্বাসী। ডলার-সংকটের কারণে অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে বলে আশাবাদী তিনি।
নতুন অর্থবছর থেকে সুদের হার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হবে, খেলাপি ঋণ কমানো হবে। আর ব্যাংকের ঋণমানেও উন্নতির ব্যাপারে আশার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। অথচ এ ঘোষণার মাত্র কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। আর অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার দুদিন আগেই বিশ্বখ্যাত ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের ব্যাংকের ঋণমান কমিয়েছে। এর অর্থ হলো ব্যাংক খাত দুর্বল ভিত্তির মধ্যে রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী দেশে গরিব থাকবে না বললেও বাজেটে গরিব মানুষ, বেকার তরুণের কর্মসংস্থানের জন্য সুস্পষ্ট রূপরেখার অনুপস্থিতি চোখে পড়েছে। তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রস্তুত করতে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছেন। অথচ ১৭ কোটি মানুষের দেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশই এই শ্রেণির।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাহিদার তুলনায় এ বরাদ্দ খুবই নগণ্য। বাজেটে গরিব মানুষের জন্য বিশেষ কিছু না থাকলেও এবারের বাজেটে ধনীর জন্য ঠিকই সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। ধনীদের কাছ থেকে নিট পরিসম্পদের বিপরীতে সারচার্জ আদায় করা হয়। এত দিন ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত নিট পরিসম্পদ থাকলে করমুক্ত সুবিধা ছিল। এটা ১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এর ফলে ধনীর পরিসম্পদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ল।
তিন বছরের করোনা মহামারি। এতে লন্ডভন্ড বাইরের বিশ্ব, বাংলাদেশ। বেঁচে থাকার সঙ্গে অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের লড়াইটাও কঠিন হয়ে যায় বহু মানুষের জন্য। মাজা সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরুর আগেই বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। বিশ্ব মানচিত্রের এক কোণে রাশিয়া-ইউক্রেনের সেই যুদ্ধে আবার টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। বাইরের মতো বাংলাদেশেও হু হু করে বেড়ে গেল জিনিসপত্রের দাম। এর মধ্যে পড়ে মানুষ যখন খাবি খাচ্ছে, তখন ঘোষণা করা হলো নতুন বাজেট।
সুন্দর কথামালায় জড়িয়ে রূপকথার গল্পের মতো ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাস্তবায়ন যা-ই হোক; টাকার অঙ্কে প্রতিবছর নিজের রেকর্ড ভাঙা স্বপ্নবিলাসী অর্থমন্ত্রী ২০৪১ সালে ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে নিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালেন। অথচ দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখন নিত্য দিনযাপনের রসদ জোগাতে প্রায় দিশেহারা। তিনি এমন সময়ে দারিদ্র্য ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা শোনালেন, যখন একটি বিরাট শ্রেণি দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙতে পারছে না। তিনি এমন সময়ে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা দেখাচ্ছেন, যখন তা ১০ শতাংশের কাছাকাছি। কর-জিডিপি অনুপাত ২০ শতাংশে উন্নীত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, অথচ তা এখনো সাড়ে ৭ শতাংশের ঘরে আটকে রয়েছে। তিনি বলেছেন, সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে স্বাস্থ্যসেবা। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। আর গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ।
অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় এভাবেই মানুষকে স্বপ্নের ঘোরে ডোবালেন। অথচ রাত পোহালেই তাঁরা মুখোমুখি হবেন নতুন বাস্তবতায়; যখন জানবেন তাঁদের কারও আয় না থাকলেও শুধু করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর থাকলেই দিতে হবে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর।
অর্থমন্ত্রী ঠিকই স্বপ্ন দেখালেন, অথচ নির্বাচনের বছরেও হাঁটলেন অজনপ্রিয় পথে। বড় বাজেটের খরচ মেটানোর জন্য তিনি আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে এমনভাবে করের জাল বিছালেন, ভোক্তাদের বাজারে গেলেই এর তাপ অনুভব করতে হতে পারে। তাঁরা জানবেন, টিস্যু পেপার থেকে থালাবাসন, কলম থেকে মোবাইল ফোন কিংবা ইট, সিমেন্টসহ প্রতিদিনের ব্যবহার্য অসংখ্য পণ্যে কর, ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে; যার ফলে সীমিত আয়ের মধ্যেও তাদের ঘাড়ে পড়বে বাড়তি খরচের চাপ।
বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এটা করদাতার জন্য কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলেও পরোক্ষ করের খড়্গ করদাতাকে এর চেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলতে পারে।
বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, গৃহস্থালিতে ব্যবহার করা হয় এমন পণ্যসহ টিফিন বক্স, পানির বোতল, অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাসন, রান্নাঘরের সরঞ্জামে বাড়তি ভ্যাট বসানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ খায় এমন খেজুরের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। চশমা ও রোদচশমার শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, পকেট টিস্যু, পেপার টাওয়েলে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। দেশে উৎপাদিত সিলিন্ডারের কাঁচামালে শুল্ক, সিগারেট, তরল নিকোটিন, বাসমতী চালের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। আর উড়োজাহাজে ভ্রমণ করলে দিতে হবে বাড়তি কর। নতুন অর্থবছরে এসব খাত থেকে রাজস্ব আয়ে মরিয়া থাকবে এনবিআর, যার সরাসরি ভুক্তভোগী হবে ভোক্তারা।
নতুন অর্থবছরে নতুন করদাতার খোঁজে ঘরে ঘরে যাবে বেসরকারি খাতের এজেন্ট। এ বিধান করা হয়েছে বাজেটে। এজেন্ট যে কর ঠিক করে দেবে, সেটিই দিতে হবে করদাতাকে। করদাতা যেটুকু কর দেবেন, তার থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাবে এজেন্টরা। এ ধরনের বিধান কর খাতে হয়রানির জন্ম দেবে এবং ঘুষ ও দুর্নীতির সুযোগ বাড়াবে বলে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে নতুন অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডির ব্যবস্থাপনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভ্যাট আদায়েও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ হলো। বিশেষজ্ঞরা এ বিধানেরও সমালোচনা করেছেন। এতেও দুর্নীতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, সাধ্য নেই, তবু নতুন অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করেছেন; যার পুরোটা সংস্থান করতে পারবেন না। ডলার-সংকট, টাকার দরপতন, রপ্তানি-রেমিট্যান্সে মন্দাভাব, আমদানি কড়াকড়িতে উৎপাদনে ধীরগতি, বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতার মতো অসংখ্য অর্থনৈতিক সমস্যা যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমিয়ে দিচ্ছে, তিনি তখন করের বোঝা বাড়িয়ে, ঘরে ঘরে কর আদায়ের এজেন্ট পাঠিয়ে, ইএফডির মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের কাজ বেসরকারি খাত দিয়ে বাড়াতে চান। আর এই করে ভর করে সংস্থান করতে চান পাঁচ লাখ কোটি টাকা। বেশির ভাগটাই এনবিআরের কর রাজস্ব থেকে নিতে চান। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। ভ্যাট থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা আর শুল্ক থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা আদায় করবেন বলে মনে করেন। এত বিপুল করের পুরোটা আদায় হলেও এতে কুলাবে না।
বাজেটের পুরো খরচের জন্য তাঁর আরও ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। এটা তিনি ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎস থেকে ধারকর্জ করে জোগাবেন বলে উল্লেখ করেছেন। চলতি বাজেটেই ঠিকমতো রাজস্ব আয় না হওয়ায় বিপুল অঙ্কের ঋণ নিতে হয়েছে ব্যাংক থেকে। আসছে অর্থবছরে রাজস্ব আয় না বাড়লে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়বে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে কর্মসংস্থান ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে এরই মধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা।
নতুন অর্থবছরে খরচে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলা হলেও ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় ১ হাজার ৩০০ প্রকল্প রয়েছে। যতই বলা হোক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে না, তারপরও এসব প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে। আর নতুন-পুরোনো মেগা প্রকল্প তো রয়েছেই। এসব প্রকল্পের জন্য বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নতুন অর্থবছরেও ঋণ নেওয়া হবে। ঋণের কিস্তি ও সুদ বাবদ বিপুল টাকা ব্যয় হবে আসছে অর্থবছরে।
আর্থিক সংকটের মধ্যে আইএমএফ থেকে শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ভর্তুকি কমাতে হবে। অথচ অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, চাইলেও শিগগির ভর্তুকি তুলে দিতে পারবেন না। এ জন্য সময় লাগবে। তাই নতুন অর্থবছরে বরং ভর্তুকি বেড়েছে। মোট ভর্তুকি পরিকল্পনা করা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। ভর্তুকির এ টাকার বড় অঙ্কই সামাজিক নিরাপত্তা, সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে খরচ করা হবে। অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ভর্তুকি কমানোর জন্য এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া সময়ে সময়ে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের একটি ফর্মুলার পথনকশা তৈরি করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, এ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ নতুন পদ্ধতিতে জ্বালানির দাম সমন্বয় করা যাবে। লোকসান কমাতে ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় করোনা-উত্তর পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থবছর অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জের হবে বলে সতর্কবাণী প্রকাশ করেছেন। তারপরও তিনি নতুন অর্থবছরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে উচ্চাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, আগামী অর্থবছরেও সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবেন। নতুন অর্থবছরে অর্থনীতিতে অস্থিরতা থাকবে উল্লেখ করেও অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার পক্ষে আত্মবিশ্বাসী। ডলার-সংকটের কারণে অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে বলে আশাবাদী তিনি।
নতুন অর্থবছর থেকে সুদের হার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হবে, খেলাপি ঋণ কমানো হবে। আর ব্যাংকের ঋণমানেও উন্নতির ব্যাপারে আশার কথা জানান অর্থমন্ত্রী। অথচ এ ঘোষণার মাত্র কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। আর অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার দুদিন আগেই বিশ্বখ্যাত ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের ব্যাংকের ঋণমান কমিয়েছে। এর অর্থ হলো ব্যাংক খাত দুর্বল ভিত্তির মধ্যে রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী দেশে গরিব থাকবে না বললেও বাজেটে গরিব মানুষ, বেকার তরুণের কর্মসংস্থানের জন্য সুস্পষ্ট রূপরেখার অনুপস্থিতি চোখে পড়েছে। তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রস্তুত করতে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছেন। অথচ ১৭ কোটি মানুষের দেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশই এই শ্রেণির।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাহিদার তুলনায় এ বরাদ্দ খুবই নগণ্য। বাজেটে গরিব মানুষের জন্য বিশেষ কিছু না থাকলেও এবারের বাজেটে ধনীর জন্য ঠিকই সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। ধনীদের কাছ থেকে নিট পরিসম্পদের বিপরীতে সারচার্জ আদায় করা হয়। এত দিন ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত নিট পরিসম্পদ থাকলে করমুক্ত সুবিধা ছিল। এটা ১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এর ফলে ধনীর পরিসম্পদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ল।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে